আপত্তির জবাব

নিজের কথা কুরআন-সুন্নাহ্‌র নামে চালানো

নিজের কথা কুরআন-সুন্নাহর নামে চালানো - অধ্যায়ের উত্তর। হযরত মির্যা সাহেবের উদ্ধৃত বক্তব্যের প্রথমেই বলা আছে, ‘হাদীসে বা সহীহ্ হাদীসে আছে’ স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে তিনি আক্ষরিক অনুবাদ করছেন না বরং মির্যা সাহেব অনেকগুলো হাদীসের সারাংশ তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরছেন। এখন প্রশ্ন হল, তিনি যে বিষয়গুলো কুরআন, হাদীসের দিকে আরোপ করেছেন সেগুলো কি কুরআন-হাদীসে আছে না কি সবটাই তার মনগড়া?
১. আপত্তিঃ সহীহ্ হাদীসসমূহে বর্ণিত আছে, মসীহে মাওউদ শতাব্দির শুরুতে আসার কথা এবং সে চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ হবে । (রুহানী খাযায়েন ২১/৩৫৯)

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব ভালভাবেই জানেন সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ فِيمَا أَعْلَمُعَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছ থেকে যেসব বিষয় জেনেছি তার মাঝে তিনি একথাও বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক শতাব্দির শিরোভাগে এমন এক বা একাধিক ব্যক্তি আবির্ভূত করবেন যিনি ধর্মের সংস্কার সাধন করবেন। (আবু দাউদ: কিতাবুল মালাহিম)

এই হাদীসের আলোকে এই উম্মতের বিদগ্ধ আলেমরা বিশ্বাস করতেন, চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ মাহদীই হবেন।

আহলে হাদীস আলেম সম্প্রদায়ের শিরোমণি নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব তের শতাব্দীর মুজাদ্দেদদের একটি তালিকা দেয়ার পর লিখেছেন, ‘চতুর্দশ শতাব্দী শুরু হতে আর মাত্র দশ বছর বাকি আছে। যদি এই শতাব্দীতে মাহদী ও ঈসা (আ.)-এর আবির্ভাব হয়ে যায় তাহলে তিনিই চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ ও মহাপুরুষ হবেন।’ (হুজাজুল কিরামাহ ফী আসারিল কিয়ামাহ, পৃষ্ঠা ১৩৯, শাহজাহানপুর, ভুপাল থেকে মুদ্রিত, প্রকাশকাল ১২৯১ হি.)

এখন প্রশ্ন থাকে, মাহদী ও মসীহ্ যে শতাব্দীর মুজাদ্দেদ হবেন এটা তো স্পষ্ট হল কিন্তু এই ঘটনা যে চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগেই হবে এর প্রমাণ কি?

বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য দেখুন ইবনে মাজা শরীফের কিতাবুল ফিতান অধ্যায়ের হাদীস- لايات بعد المائتين অর্থাৎ সেইসব নিদর্শন দুইশ’ বছর পর প্রকাশিত হবে। এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’তের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মোল্লা আলী আল-ক্বারী (রাহ.) লেখেন,

و يحتمل ان يكون اللام في المائتين للعهد أي بعد المائتين بعد الألف و هو وقت ظهور المهدي.

(মিরকাতুল মাসাবীহ্ শারহ্ মিশকাতিল মাসাবীহ্ কিতাবুল ফিতান বাবু আশরাতিস্ সাআ, হাদীস নম্বর-৫৪৬০)অর্থাৎ খুব সম্ভব, আল মিয়াতাইন-এ ‘লাম’ অক্ষরটি ‘আহ্‌দ যিকরি যেহনি’ র জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর অর্থ হল, এক হাজার বছরের পর দুই শ’ বছর অর্থাৎ ১২০০ বছর পর এসব লক্ষণ প্রকাশিত হবে আর সেই যুগই ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের যুগ।

অতএব হাদীস থেকে মির্যা সাহেব শুধু একাই এই যুক্তি গ্রহণ করেন নি বরং এই উম্মতের অন্যান্য আলেমরাও একই অর্থ গ্রহণ করেছেন। অতএব এ বিষয়ে আল্লামার আপত্তি ধোপে টেকে না। উদাহরণস্বরূপ আরও বলা যায়, সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যখন বলেন, এ বিষয়টি সংবিধানে আছে - তখন এটি আক্ষরিক অর্থে কেউ খুঁজতে যায় না বরং সামগ্রিক দৃষ্টিতে সংবিধানে প্রণিত নীতিমালায় বিষয়টি আছে অর্থে কথাটাকে নেয়া হয়।

‘আল্লামা’র এ বিষয়টি না জানার কথা নয়। কিন্তু সবকিছু জেনেও সাধারণ জনগণের মাঝে তিনি কেন এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াচ্ছেন তা তিনিই ভাল বলতে পারবেন!

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
২. আপত্তি: মসীহ্ (আ.) আসলে তাকে লাঞ্ছিত করা হবে, ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে। কুরআন ও হাদীসে এমন কথা আছে। (রুহানী খাযায়েন ১৭/৪০৪)

উত্তর: পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বলা আছে,

ثُمَّ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا تَتْرَى كُلَّمَا جَاءَ أُمَّةً رَسُولُهَا كَذَّبُوهُ فَأَتْبَعْنَا بَعْضَهُم بَعْضًا وَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيثَ فَبُعْدًا لِقَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ

অর্থ: এরপর আমি একের পর এক রসূল প্রত্যাদিষ্ট করে পাঠিয়েছি। যখনই কোন উম্মতের কাছে তাঁর রসূল আগমন করেছেন, তখনই তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রত্যাখ্যান করেছে (সূরা মোমেনূন: ৪৫)। অতএব প্রতিশ্রুত ঈসা নবীউল্লাহ্ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। আল্লাহ্ তা’লা এ নিয়মে কোন ব্যতিক্রম বর্ণনা করেন নি।

এরপর সূরা ইয়াসীনের ৩১ আয়াত দেখুন, আল্লাহ্ তালা বলছেন,

يَا حَسْرَةً عَلَى الْعِبَادِ مَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

অর্থ: বান্দাদের জন্য আক্ষেপ! তাদের কাছে এমন কোন রসূলই আগমন করে নি যার প্রতি তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করেছে। (সূরা ইয়াসিন: ৩১) আরও দেখুন,


كَذَلِكَ مَا أَنَّى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ

‘এমনিভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল আগমন করেছে, তারা বলেছে, যাদুকর, না হয় উন্মাদ’ (সূরা যারিয়াত: ৫৩)।

নবীদের ঘোর বিরোধিতার অমোঘ ঘোষণা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট দেয়া থাকলেও এবং ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ-এর এসব আয়াত জানা থাকা সত্ত্বেও মির্যা সাহেবের কথাগুলোকে তিনি মনগড়া কথা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন। আর বিরোধিতায় অন্ধ হরে গিয়ে মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে আপত্তি করে যাচ্ছেন। বিরোধিতায় মানুষ যে এত অন্ধ হরে যেতে পারে এটা কল্পনাও করা যায় না। আলায়সা ফীকুম রাজুলুন রাশীদ?

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৩. আপত্তি: হাদীসে আছে আগত মাসীহ্ জুলকারনাইন হবে।

উত্তর: পবিত্র কুরআন এবং হাদীস থেকে জানা যায়, শেষযুগে অর্থাৎ প্রতিশ্রুত মসীহর যুগে একদিকে যেমন রূপকভাবে বা প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ মুসলমানরা ইহুদী ও খ্রিস্টান হরে যাবে তেমনি রূপকভাবে বা প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ কিছু পুণ্যবান লোকেরও আবির্ভাব হবে। আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে বলেন,


وَحَرَامٌ عَلَى قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا أَنَّهُمْ لَا يَرْجِعُونَ ( حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ

অর্থ্যাৎ যে জনপদকে আমরা একবার ধ্বংস করে দেই তাদের পুনরায় ফিরে আসা অসম্ভব, যতদিন পর্যন্ত ইয়াজুজ মাজুজকে অবমুক্ত করা না হবে এবং তারা প্রত্যেক উঁচু স্থান থেকে ধেয়ে আসবে। (সূরা আম্বিয়া: ৯৬-৯৭)

এ আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ইয়াজুজ মাজুজের উন্নতির যুগে অর্থাৎ প্রতিশ্রুত মসীহর যুগে পূর্ববর্তী মৃতদেরকে পুনরায় নিয়ে আসা হবে।

অর্থাৎ রূপক অর্থে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে (যেহেতু দৈহিকভাবে এ পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার পথ পবিত্র কুরআন ও হাদীস দ্বারা রুদ্ধ)। মৃত পুণ্যবান ও ওহীপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাঝে যুলকারনাইনও অন্যতম। এ ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শেষযুগে অর্থাৎ ইয়াজুজ মাজুজের উন্নতির যুগে এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব হবে যিনি রূপকভাবে প্রতিচ্ছায়াস্বরূপ যুলকারনাইন হবেন।

এই ভবিষ্যদ্বাণীর দিকেই ইঙ্গিত করে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) বলেন, যে ব্যক্তির রূপকভাবে ও প্রতিচ্ছায়ারূপে যুলকারনাইন হয়ে আগমনের কথা আল্লাহ তা’লা বলেছেন, আমিই সেই যুলকারনাইন। তিনি বলেন, “কতিপয় হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে, আগমনকারী মসীহর একটি লক্ষণ হল, তিনি যুলকারনাইন হবেন। মোটকথা, ঐশী ওহীর ভিত্তিতে আমিই যুলকারনাইন।” (রূহানী খাযায়েন, ২১ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)

অপর এক স্থানে বলেন, ‘কতিপয় হাদীসে মসীহ্ মাওউদের নাম যুলকারনাইন বর্ণিত হয়েছে।’ (রূহানী খাযায়েন, ২০শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৯ পাদটিকা) মহানবী (সা.) প্রতিশ্রুত মাহদীকে যুলকারনাইনের সাথে সদৃশ্যপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস:

سمعت رسول الله صل يقول ان ذا القرنين كان عبدا صالحا ...... بلغ المشرق و المغرب و ان الله تبارک و تعالی سیجزى سنته فى القائم من ولدى يبلغه شرق الارض و غيرها

অনুবাদ: হযরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে শুনেছি, তিনি (সা.) বলেছেন, যুলকারনাইন একজন পুণ্যবান বান্দা ছিলেন.... যিনি পূর্ব-পশ্চিমে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আল্লাহ তা’লা তার এই সুন্নত পুনরায় আমার সন্তান মাহদীর মাধ্যমে জারী করে দিবেন যে তার বাণীকে পূর্ব-পশ্চিমে পৌঁছে দিবে। [কামালুদ্দীন ও তামামুন নি’মাহ, মুহাম্মদ বিন আলী আলকুম্মী (মৃত্যু: ৩৮১ হি ) রচিত, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪২৪; আল্লামা মজলিসী রচিত বিহারুল আনওয়ার, বয়রুত থেকে প্রকাশিত ১২শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৫; সৈয়দ হাশেম হুসাইনী (মৃত্যু ১১০৭হি.) রচিত আল-বুরহান ফী তাফসীরিল কুরআন, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭২; মাওলানা আব্দুল গফুর রচিত আন্ নাজমুস সাকিব ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৪০, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৩, ১৩০৭ সনে পাটনা থেকে প্রকাশিত]

অতএব মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ভিত্তিহীন মনগড়া কোন কথা বলেন নি। যা হাদীসের বিভিন্ন সংকলনে বর্ণিত আছে তার বরাতেই কথা বলেছেন। ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের এ বিষয়গুলো অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সব জেনেও তিনি কেন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেটা সুধী পাঠকরাই ভাল বলতে পারবেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৪. আপত্তি: হাদীসে আছে, মসীহ ছয় হাজার সালে জন্ম নিবেন। [রূহানী খাযায়েন ২২/২০৯]

উত্তর: এখানেও ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। মির্যা সাহেব একথা বলেন নি, ‘হাদীসে আছে, মসীহ্ ছয় হাজার সালে জন্ম নিবেন।’ বরং মির্যা সাহেব পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উপস্থাপন করেছেন,

وَإِنَّ يَوْمًا عِندَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ

অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের প্রভুর একদিন তোমাদের গণনায় একহাজার বছর (সূরা হজ্জ: ৪৮)। আমাদের দিনের সংখ্যা মোট সাতটি। অতএব মোট সাত হাজার বছর। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) যে শেষযুগে আসবেন এ বিষয়ে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। মির্যা সাহেব লিখেছেন, বিভিন্ন হাদীস দিয়েও প্রমাণিত হয় যে, মসীহ্ ষষ্ঠ হাজার বছরে আবির্ভূত হবেন। আর মুফাসসেরগণ হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত পাঁচ হাজার বছরের কিছু অধিক নির্ধারণ করেছেন। এই সাত হাজার বছরের উল্লেখ হাকীম তিরমিযীর ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীস এবং ‘তারীখে ইবনে আসাকির’ গ্রন্থে হযরত আনাস বিন মালেক বর্ণিত হাদীস দিয়ে বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মদ (সা.)-এর পর একহাজার বছরের একটি চক্র সমাপ্ত হবার পর প্রতিশ্রুত মসীহ্র আগমনের কথা। মির্যা সাহেব উক্ত উদ্ধৃতির মাঝেই নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ভুপালের পুস্তক ‘হুজাজুল কিরামার’ বরাত দিয়ে বলেন, আবির্ভাবকাল সর্বোচ্চ চতুর্দশ শতাব্দী নির্ধারণ করা হয়েছে।

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ একদিকে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন অপরদিকে অপবাদ আরোপকারীদের চর্বিত চর্বণ উপস্থাপন করতে গিয়ে মূল উদ্ধৃতি না পড়ে আপত্তির পর আপত্তি করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৫. আপত্তি: একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্যদেশের নবীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, প্রত্যেক দেশেই নবী আগমন করেছে। তিনি আরও বলেন, ভারতে একজন কাল রংয়ের নবী এসেছিলেন তার নাম কাহেন। [রূহানী খাযায়েন ২৩/৩৮২]

উত্তর: এই উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে তিনি আপত্তি করেছেন কোন হাদীস গ্রন্থে এই বাক্যের কোন হাদীস নাই। পাঠকবৃন্দ, রেফারেন্স দেয়ার পূর্বে এ উদ্ধৃতির প্রেক্ষাপট জানা দরকার। হযরত মির্যা সাহেব এ স্থলে ইসলামের বিরুদ্ধবাদীদের সামনে ইসলামের একটি বিশেষ সৌন্দর্য্য তুলে ধরেছেন।

হযরত মির্যা সাহেব বলেন, অন্যান্য ধর্মের অবস্থা হল, তাদের গ্রন্থ পড়, তাদের অনুসারীদের মতবাদ শুন তারা বলে, আল্লাহ্ কেবল আমাদের জাতিতেই, আমাদের দেশেই হেদায়াত দেয়ার ধারা অব্যাহত রেখেছেন আর অন্য কোন জাতিকে হেদায়াত দান করেন নি। অন্য কোন জাতিতে আল্লাহ্ পথপ্রদর্শক পাঠান নি। বিষয়টি এমন যেন, রাব্বুল আলামীন আল্লাহ্ সমস্ত বিশ্বকে বাদ দিয়ে কেবল একক একটি জাতির খোদা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর এমন বিশ্বাস আল্লাহর পবিত্র অস্তিত্বের মর্যাদা পরিপন্থী। অথচ আল্লাহ্ তা’লা সূরা ফাতেহায় বলেন, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র যিনি সকল বিশ্ব-জগতের প্রতিপালক। তাই বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ক্ষেত্রে আল্লাহ সারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক। যেভাবে তিনি সব জাতির বাহ্যিক চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থা করেছেন তেমনইভাবে তিনি প্রত্যেক জাতির আত্মিক চাহিদা নিবারণের ব্যবস্থাও করেছেন। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লা আরও বলেছেন,

‘প্রত্যেক জাতিতেই আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে সতর্ককারী এসেছেন’ (সূরা ফাতের: ২৫)। এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, ওয়ালি কুল্লি কাওমিন হাদ (সূরা হাজ্জ: ৩৫) প্রত্যেক জাতিতে পথপ্রদর্শক এসেছেন। এরপর আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, আমি প্রত্যেক জাতিতে রসূল পাঠিয়েছি। আর এই শিক্ষা দিতে তাদেরকে পাঠিয়েছিলাম তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং শয়তানকে পরিহার করে চলবে। (সূরা নহল: ৩৭)

পরবর্তীকালে সেই ঐশী শিক্ষায় বিকৃতি হয়েছে। অনেক শিক্ষা বিলুপ্ত হয়েছে এবং অনেক শিক্ষা নিজেদের পক্ষ থেকে বানানো হয়েছে। তাদের প্রতি অনেক অনৈতিক কথা আরোপ করা হয়েছে। হযরত মির্যা সাহেব বলেন:

পবিত্র কুরআনের বিশেষ সৌন্দর্য হল, আল্লাহ্ তা'লা নিজেকে কোন বিশেষ জাতিতে সীমাবদ্ধ করেন নি। প্রত্যেক জাতিতে পথপ্রদর্শক এসেছে বলে কুরআন স্বীকার করে। প্রত্যেক জাতিতে আগমনকারী নবী এবং পথপ্রদর্শকদের সম্মান প্রতিষ্ঠা করে। এমনকি পবিত্র কুরআন বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন মোমেন হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রত্যেক জাতিতে আগত প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষকে না মানবে। এটি হল মূল বিষয়বস্তু। এটি হল সেই প্রেক্ষাপট যাতে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আর এতে আপত্তিকারীরা আপত্তি করে। এখানে মির্যা সাহেব হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন,

كان في الهند نبياً اسود اللون

হিন্দুস্তানে কালো রঙের এক নবী ছিল যার নাম ছিল কাহেন। এই হাদীস ‘তারীখে হামদান দায়লামী’র বাবুল কাফে রয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ যেহেতু এগুলো জানে না তাই জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই আপত্তি বার বার লিখে প্রচার করা হচ্ছে। কালো রং-এর একজন নবী যে ছিলেন একথা হযরত আলী (রা.)-ও বর্ণনা করেছেন।

عن علي رضي الله عنه إن الله تعالى بعث نبياً أسود

হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ তা’লা কালো রং-এর নবী আবির্ভূত করেছিলেন (আল-কাশাফ: ৩য় খণ্ড)। হযরত আলী (রা.) এই সংবাদ কোথায় পেলেন? নিশ্চয় তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছেন। আসমাউর রিজাল-এ লেখা আছে, আহলে বায়তের সদস্যরা যখন কোন হাদীস বর্ণনা করতেন তখন এটি রসূল (সা.) বলেছেন বলে তারা উল্লেখ করতেন না। বরং তাদের ক্ষেত্রে ধরেই নেয়া হত, এরা যা বর্ণনা করেন মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেই তা বর্ণনা করেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৬. আপত্তি: যেহেতু সহীহ হাদীসে আছে, ইমাম মাহদীর কাছে একটি কিতাব থাকবে যার মধ্যে ৩১৩ জন সাথীর নাম থাকবে। সে ভবিষ্যদ্বাণী আজ পূরণ হল। (রূহানী খাযায়েন ১১/৩২৪) আপত্তিকারীর আপত্তি হল, এই উক্তির ভিত্তি কী?

উত্তর: মহানবী (সা.) বলেছেন, মাহদী এমন এক গ্রাম থেকে প্রকাশিত হবেন যার নাম কাদিয়া। আল্লাহ্ সেই মাহদীর সমর্থন করবেন এবং দূর দূরান্ত থেকে আল্লাহ্ তাঁর ভক্তদের একত্র করবেন তাদের সংখ্যা বদরের যুদ্ধের সংখ্যার সমান হবে অর্থাৎ তিন শত তের হবে এবং তাদের নাম, ঠিকানা ও বৈশিষ্ট্যসহ ছাপা আকারে তার কাছে একটি বই থাকবে। (হযরত শেখ আলী হামযা ইবনে আলী আল মালেক আত-তুসী রচিত জাওয়াহেরুল আসরার, কলমি নুসখা পৃষ্ঠা ৪৩)

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব! মির্যা সাহেব কোন ভিত্তিহীন কথা বলেন নি। আপত্তি করার আগে এসব গ্রন্থ একবার পড়ে নেয়ার প্রয়োজন ছিল। শুধু এই একটি গ্রন্থেই নয় আরো গ্রন্থে এই বর্ণনা রয়েছে। যেমন:

يجمع الله تعالى له من اقاصى البلاد على عدة أهل بدر ثلاثمائة وثلاثة عشر رجلا - معه صحيفة مختومة فيها عدد اصحابه بأسمائهم و انسابهم و بلدانهم وطبائعهم و حلاهم و کناهم کدادون مجدون في طاعته

‘আল্লাহ তা’লা মাহদীর জন্য বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের সংখ্যার অনুরূপ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৩১৩ জন সাহাবী একত্র করবেন এবং সেই মাহদীর কাছে একটি মুদ্রিত পুস্তক থাকবে যাতে এসব সাহাবীর নাম, ঠিকানা ও বৈশিষ্ট্য এবং বিবরণ লিখিত থাকবে। আর তারা তাঁর আনুগত্যে ক্রমাগত উন্নতি করতে সচেষ্ট থাকবে। (আল্লামা আলকুম্মি রচিত উয়ুনু আখবারির্ রিদা, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫; শেখ মুহাম্মদ বাকের আল মাজলিসী রচিত বিহারুল আনওয়ার খণ্ড ৫২ পৃষ্ঠা ৩১০-৩১১ বয়রুত থেকে প্রকাশিত)

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৭. আপত্তি: শত আওলিয়া নিজ ইলহাম দ্বারা সাক্ষ্য দিয়েছেন চতুর্দশ শতাব্দির مجدد হবেন মাসীহ (আ.)। সহীহ হাদীস ডেকে ডেকে বলছে, তিনি ১৩তম শতাব্দির পরে প্রকাশ পাবেন। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩৪০)

উত্তর: আল্লামা আব্দুল মজিদ সাহেব-এর একটি আপত্তির ভিত্তিতে ইতিপূর্বে প্রমাণ করা হয়েছে মাহদী ও মসীহ্ (আ.) চৌদ্দশতাব্দীর শিরোভাগে আসবেন। এখন এখানে ‘আল্লামা’ যেহেতু আওলিয়ার নাম চেয়েছেন তাই এখানে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরছি। এখানে এমন কয়েকজনের নাম তুলে ধরছি যাদেরকে ‘আল্লামা’ না চেনার কথা নয়।

ক) প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ্ ওলী (৫৬০ হিজরী) তিনি তাঁর বিখ্যাত ফারসী কবিতায় শেষ যুগের অবস্থা বর্ণনা করেছেন, তিনি লিখেছেন,

অনুবাদ: যখন ১২০০ বছর অতিক্রম করবে তখন আমি অদ্ভূত অদ্ভূত দৃশ্য দেখি। যুগের মাহদী এবং এযুগের ঈসা উভয়কে ঘোড়ায় আরোহনরত অবস্থায় দেখেছি। (আরবাঈন ফী আহওয়ালিল মাহদীঈন, মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ সংকলিত পৃষ্ঠা ২, ৪ প্রকাশকাল ১২৬৮ হিজরী সন)

খ) হযরত শাহ ওলীউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১১৪-১১৭৫ হিজরী)

عَلَّمَنِي رَبِّي جَلَّ جَلالُهُ أَنَّ القَيَامَةَ قَدِ اقْتَرَبَتْ وَالْمَهْدِيُّ تَهَيَّا لِلْخُرُوجِ - اتفہیمات الالهیه جلد ۲ صفحہ ۱۲۰ تفہیم نمبر ۱۴۶ شاہ ولی اللہ اکیڈمی دہلی )

আমার প্রভু আমাকে জানিয়েছেন, কিয়ামত সন্নিকট এবং মাহদী আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন।

গ) নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব হযরত শাহ ওলীউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভীর বিষয়ে লিখেন, ‘হযরত শাহ্ ওলী উল্লাহ্ ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের সময় চেরাগ দীন শব্দে বর্ণনা করেছেন, যা কিনা হুরুফে আবজাদ হিসাবে একহাজার দু’শত আটষট্টি ১২৬৮ হিজরী হয়। (হুজাজুল কিরামাহ্ ফী আসারিল কিয়ামাহ্ পৃষ্ঠা ৩৯৪) আশা করি মির্যা সাহেবের কথা যে ভিত্তিহীন নয় তা আপত্তিকারী এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৭. আপত্তি: শত আওলিয়া নিজ ইলহাম দ্বারা সাক্ষ্য দিয়েছেন চতুর্দশ শতাব্দির مجدد হবেন মাসীহ (আ.)। সহীহ হাদীস ডেকে ডেকে বলছে, তিনি ১৩তম শতাব্দির পরে প্রকাশ পাবেন। (রূহানী খাযায়েন ৫/৩৪০)

উত্তর: আল্লামা আব্দুল মজিদ সাহেব-এর একটি আপত্তির ভিত্তিতে ইতিপূর্বে প্রমাণ করা হয়েছে মাহদী ও মসীহ্ (আ.) চৌদ্দশতাব্দীর শিরোভাগে আসবেন। এখন এখানে ‘আল্লামা’ যেহেতু আওলিয়ার নাম চেয়েছেন তাই এখানে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরছি। এখানে এমন কয়েকজনের নাম তুলে ধরছি যাদেরকে ‘আল্লামা’ না চেনার কথা নয়।

ক) প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ্ ওলী (৫৬০ হিজরী) তিনি তাঁর বিখ্যাত ফারসী কবিতায় শেষ যুগের অবস্থা বর্ণনা করেছেন, তিনি লিখেছেন,

অনুবাদ: যখন ১২০০ বছর অতিক্রম করবে তখন আমি অদ্ভূত অদ্ভূত দৃশ্য দেখি। যুগের মাহদী এবং এযুগের ঈসা উভয়কে ঘোড়ায় আরোহনরত অবস্থায় দেখেছি। (আরবাঈন ফী আহওয়ালিল মাহদীঈন, মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ সংকলিত পৃষ্ঠা ২, ৪ প্রকাশকাল ১২৬৮ হিজরী সন)

খ) হযরত শাহ ওলীউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১১৪-১১৭৫ হিজরী)

عَلَّمَنِي رَبِّي جَلَّ جَلالُهُ أَنَّ القَيَامَةَ قَدِ اقْتَرَبَتْ وَالْمَهْدِيُّ تَهَيَّا لِلْخُرُوجِ - اتفہیمات الالهیه جلد ۲ صفحہ ۱۲۰ تفہیم نمبر ۱۴۶ شاہ ولی اللہ اکیڈمی دہلی )

আমার প্রভু আমাকে জানিয়েছেন, কিয়ামত সন্নিকট এবং মাহদী আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন।

গ) নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব হযরত শাহ ওলীউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভীর বিষয়ে লিখেন, ‘হযরত শাহ্ ওলী উল্লাহ্ ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের সময় চেরাগ দীন শব্দে বর্ণনা করেছেন, যা কিনা হুরুফে আবজাদ হিসাবে একহাজার দু’শত আটষট্টি ১২৬৮ হিজরী হয়। (হুজাজুল কিরামাহ্ ফী আসারিল কিয়ামাহ্ পৃষ্ঠা ৩৯৪) আশা করি মির্যা সাহেবের কথা যে ভিত্তিহীন নয় তা আপত্তিকারী এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
৯. আপত্তি: হাদীস শরীফে আছে, আদম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার বয়স ৭ হাজার বছর। (রূহানী খাযায়েন ১৭/২৪৫)

উত্তর: ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের আপত্তি হল, মির্যা সাহেব নাকি নিজের মনগড়া কথা কুরআন-সুন্নাহর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। তার বইয়ের ভূমিকায় তিনি সাধারণ আহমদীরা এবং এ জামাতের মুরব্বীরাও হযরত মসীহে মাওউদ (আ.)-এর বইপুস্তক পড়ে নি বলে মন্তব্য করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজে হযরত মির্যা সাহেবের সমস্ত বই পড়েছেন, এবং পড়েছেন বলেই তাঁর লেখার বিষয়ে আপত্তি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি তুলে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন, এটি কোথায় উল্লেখ আছে? ‘আল্লামা’ যদি নিজে পড়ে আপত্তি করতেন তাহলে এমন প্রশ্ন তিনি কখনই করতে পারতেন না। দেখুন, যে পৃষ্ঠা থেকে আপত্তি হিসাবে উদ্ধৃতিটি তুলে ধরা হয়েছে ঠিক সেখানেই মির্যা সাহেব এর একাধিক রেফারেন্স নিজেই লিখে দিয়েছেন! এই সাত হাজার বছরের উল্লেখ হাকীম তিরমিযীর ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীস এবং ‘তারীখে ইবনে আসাকির’ গ্রন্থে হযরত আনাস বিন মালেক বর্ণিত হাদীস দিয়ে বর্ণনা করেছেন। মির্যা সাহেব সেখানেই স্পষ্টভাবে এসবের বিশদ বর্ণনা তুলে ধরেছেন। হাদীসের বিভিন্ন উদ্ধৃতির বিষয়ে দুই পৃষ্ঠাব্যাপী পাদটিকায় তিনি আলোচনাও করেছেন। ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ এ পৃষ্ঠাটি পড়েই যদি আপত্তি লিখে থাকেন তাহলে এ অবান্তর প্রশ্নটি তিনি কেন করলেন? আর যদি না পড়েই আপত্তি করে থাকেন তাহলে তার বইয়ের প্রারম্ভে তার আহমদীয়া সাহিত্য বিষয়ে পাণ্ডিত্য প্রকাশ না করলেই তিনি ভাল করতেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
১০, ১১ ও ১২. আপত্তি: কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফসহ পূর্বেকার কিতাবে আছে যে, মসীহের যুগে একটি গাড়ী আবিষ্কৃত হবে যা আগুনের দ্বারা চলবে, সে গাড়ীটি হল রেল। (রূহানী খাযায়েন ২০/২৫)

উত্তর: মহানবী (সা.)-এর যুগে বিদ্যমান বিভিন্ন বাহনের উল্লেখ করার পর পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন,

وَخَلَقْنَا لَهُم مِّن مِّثْلِهِ مَا يَرْكَبُون

আর আমি তাদের জন্য এমনই আরও কিছু (বাহন) বানিয়েছি যাতে তারা আরোহণ করবে (সূরা ইয়াসীন: আয়াত ৪৩)। এমন আরও আয়াত পবিত্র কুরআনে রয়েছে যা দ্বারা বোঝা যায় ভবিষ্যতে অনেক আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হবে।

হাদীসে শেষ যুগের উল্লেখ করে সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস সংকলিত হয়েছে আর তা হল,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاللَّهِ لَيَنْزِلَنَّ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَادِلًا فَلَيَكْسِرَنَّ الصَّلِيبَ وَلَيَقْتُلَنَّ الْخِنْزِيرَ وَلَيَضَعَنَّ الْجِزْيَةَ وَلَتُتْرَكَنَّ الْقِلَاصُ فَلَا يُسْعَى عَلَيْهَا

হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীস: রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, মসীহ্ ইবনে মরিয়ম ন্যায়বিচারক হয়ে আবির্ভূত হবেন এরপর তিনি ক্রুশ ভঙ্গ করবেন এবং শুকর বধ করবেন এবং জিযিয়া কর রহিত করবেন। আর তখন উট পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হবে। একে কেউ বাহন হিসেবে ব্যবহার করবে না অর্থাৎ এতে চড়ে সফর করবে না।

চিন্তা করে বলুন, মানুষ কখন একটি ব্যবহার্য জিনিষ পরিত্যাগ করে? এর উত্তর হল, কেবল তখনই যখন মানুষ এর চেয়েও উন্নততর কোন জিনিষ পেয়ে যায়। বিশ্বের উন্নত সব যানবাহন আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য, আজ ভ্রমণের জন্য উট পরিত্যক্ত হয়েছে। আবার শেষ যুগের আলামত হিসাবে যেসব হাদীসে দাজ্জালের উল্লেখ রয়েছে সেখানে দাজ্জালের একটি গাধার উল্লেখ আছে যা আগুন ও পানি খেয়ে চলবে। আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের কাছে স্পষ্ট, শেষ যুগের দাজ্জাল হল খ্রিস্টান পাদ্রী ও তাদের অনুসারীরা এবং তাদের প্রধান বাহন ছিল রেলগাড়ী যা এখনও আছে। অতএব মির্যা সাহেব পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকেই কথা বলেছেন। বিবেক খাটানোর শক্তি থাকলে সহজেই বুঝতে পারবেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
১৩. আপত্তি: একটি হাদীসে আছে, শেষ যুগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াতে আবার আসবেন। (রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৮৪, দ্র. টিকা)

উত্তর: সূরা জুমআর প্রারম্ভে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন,

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ ( وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ )
(সূরা জুমুআ: ২-৪)

এটি একটি সূক্ষ্ম ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত আয়াত। যাতে বলা হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম আবির্ভাব ঘটেছে নিরক্ষর আরবদের মাঝে যাদেরকে তিনি আল্লাহ্ আয়াত পাঠ করে শুনাচ্ছেন, পবিত্র করছেন, তাদেরকে ধর্মের বিধি-বিধান ও এর ব্যাখ্যা শেখাচ্ছেন। যদিও ইতিপূর্বে তারা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, এবং তিনি তাকে প্রেরণ করবেন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত অন্য আরেক জাতির মাঝে যারা যুগের দিক থেকে এখনও তাদের সাথে মিলিত হয় নি। এবং তিনি মহা পরাক্রমশালী পরম প্রজ্ঞাময়।

হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমরা এই আয়াত শোনার পর প্রশ্ন করলাম, ‘মানহুম ইয়া রাসূলাল্লাহ্’ এরা কারা যাদের মাঝে আপনি পুনরায় আসবেন? একবার প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যায় নি, দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যায় নি। তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে মহানবী (সা.) সকল আরব সাহাবীদের বাদ দিয়ে একমাত্র অনারব সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বললেন,

لَوْ كَانَ الْإِيمَانُ عِنْدَ الثَّرَيَّا لَنَا لَهُ رِجَالٌ أَوْ رَجُلٌ مِنْ هَؤُلَاءِ

অনুবাদ: ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রে চলে গিয়ে থাকলেও এদের এক বা একাধিক ব্যক্তি তা অবশ্যই নিয়ে আসবেন। (বুখারী শরীফ, কিতাবুত তফসীর)

রসূলে আকরাম (সা.) এই হাদীসে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাঁর সেই আগমনের অর্থ দৈহিক ও আক্ষরিক অর্থে আগমন নয়। বরং তাঁর এক শিষ্য তাঁর মাঝে বিলীন হয়ে আগমন করবেন। আর তাঁর আগমন মূলত রূপক অর্থে মহানবী (সা.)-এর আগমন হবে। তিনি ঈমানশূন্য যুগে আসবেন এবং পারস্য বংশীয় হবেন। ‘আল্লামা’ জানতে চেয়েছিলেন, মুহাম্মদ (সা.) পুনরায় আসবেন এটি হাদীসেকোথায় আছে? তাকে অনুরোধ করছি, বুখারী শরীফের কিতাবুত তফসীরের উপরোক্ত হাদীসটি দয়া করে দেখে নিবেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
১৪. আপত্তি: মির্যা সাহেব লিখেছেন, পূর্বেকার নবীগণের কাশফ এই কথার উপর সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, তিনি (মির্যা সাহেব) চতুর্দশ শতাব্দির শুরুতে জন্ম নিবেন। (রূহানী খাযায়েন ১৭/৩৭১) আপত্তি হল, রূহানী খাযায়েনের প্রথম এডিশনগুলোর মধ্যে “পূর্বেকার নবীগণ” ( انبیاء گزشته ) এই কথাটি ছিল। পরের মুদ্রণগুলোতে তা কেটে “পূর্বেকার ওলীগণ” ( اولیاء گزشته ) শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। আর এ পরিবর্তন করে কাদিয়ানী বন্ধুগণই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি অসত্য কথা লিখেছেন।

উত্তর: বিষয়টি মোটেও এমন নয় বরং বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ স্থলে মির্যা সাহেবের জীবদ্দশায় প্রকাশিত এডিশনে ‘আউলিয়ায়ে গুযাশতা’ শব্দই ছিল কিন্তু পরবর্তী এডিশনে ভুলবশত ‘আম্বিয়ায়ে গুযাশতা’ মুদ্রিত হয়েছে।

হযরত মির্যা সাহেব লিখেছেন, ‘ইসলামের বর্তমান দুর্বলতা এবং শত্রুর ক্রমাগত আক্রমণ প্রয়োজন সাব্যস্ত করছে এবং পূর্ববর্তী আওলিয়াদের দিব্য-দর্শনও এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, সেই মহাপুরুষ চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাবে আবির্ভূত হবেন।’

আসল কথা হল, হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) আরবাঈন-২ বা অন্য কোন পুস্তকে এ বিষয়ে ‘আম্বিয়া গুযাশতা’ অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীগণ শব্দ লেখেন নি বরং ‘আউলিয়া গুযাশতা’ লিখেছেন। হযরত মির্যা সাহেবের যুগে মুদ্রিত আরবাঈনের দু'টি এ্যাডিশনে যথাক্রমে ২৩ ও ২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আউলিয়া গুযাশতা’ শব্দই মুদ্রিত আছে। হ্যাঁ নতুন এডিশনে যা ‘বুক ডিপো’ ছাপিয়েছে তাতে ভুলবশত: ‘আউলিয়ার’ স্থলে ‘আম্বিয়া’ শব্দ লেখা হয়েছিল। এটা মোটেও একজন আলেমের জন্য আপত্তি করার ভিত্তি হতে পারে না। হযরত মির্যা সাহেবকে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী ও মসীহ্ (আ.) হিসেবে মান্য করি যাঁর আগমনবার্তা স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব তাঁর লেখার মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতি ঘটানো আর যাই হোক আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি ১৯৩০ সালেই বিরুদ্ধবাদী আলেমদেরকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের জামাতের রেকর্ডে এ বিষয়টি সংরক্ষিত।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮) আপত্তি: মক্কা মদীনায় রেলের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। (রূহানী খাযায়েন ১৯/১০৮, ১৭/৪৯) তিন বছরে মক্কা মদীনায় রেলের রাস্তা তৈরি হবে। (রূহানী খাযায়েন ১৭/১৯৫) “মসীহের সময় ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।” এ সকল হাদীসসমূহে পরিষ্কারভাবে ইংরেজ সরকারের প্রশংসা পাওয়া যায়। (রূহানী খাযায়েন ১৫/১৪৫)

উত্তরঃ মক্কা ও মদীনার মাঝে রেল চালু হবার বিষয়ে এটা অজ্ঞতাপ্রসূত একটি আপত্তি। ‘হিজায রেল’ একটি বাস্তব পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের নাম। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সৌদী বাদশাদের অধীনে বর্তমান আরবের মূল অংশ তথা মক্কা-মদীনা পরিচালিত হত না বরং তুর্কি সুলতানের অধীনে মক্কা ও মদিনা পরিচালিত হত। তুর্কি সাম্রাজ্যের বিস্তৃত এলাকায় ‘হিজায রেল প্রকল্প’ একটি প্রধান প্রকল্প ছিল। তদনুযায়ী দামেস্ক থেকে হিজায পর্যন্ত নেরোগ্যাজ রেল লাইন বসানো হয়েছিল। এর পরবর্তী ধাপে মদীনা থেকে মক্কায় এর রেল লাইন বসানোর কথা ছিল। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) ১৯০২ সালে জানতেন, তুর্কি সাম্রাজ্য এই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মূল পরিকল্পনা তারও কয়েক দশক আগে। উসমানী রাজা তুর্কিস্তানী দ্বিতীয় আব্দুল হামীদ এর আমলে ১৯০০ সালে হিজায রেলের নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। ১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে রেললাইন মদিনা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল। তুর্কি সাম্রাজ্য আরবের উত্তরে অবস্থিত। এদের ক্ষমতা দামেস্ক হয়ে মদিনা ও মক্কা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। লরেন্স অব আরাবীয়া এই হিজায রেলকে স্থানীয় আরবদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বার বার আক্রমণ করত যার কারণে এর নিরাপত্তার সমস্যা ছিল সেই শুরু থেকেই। বিশাল অর্থ সংকটের কারণে তুর্কি বাদশাহ আব্দুল হামীদ শেষ পর্যন্ত এ ব্যয়বহুল কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন নি। ১৯২০ সালের পর এই প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়। শেষ যুগের লক্ষণাবলির মাঝে একটি লক্ষণ হল, দ্রুতগ্রামী বাহন আবিষ্কার হওয়া। সেই প্রসঙ্গে হযরত মির্যা সাহেব বলেছিলেন, এই লক্ষণ মক্কা মদিনায়ও প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ‘আল্লামা’র অবগতির জন্য জানাচ্ছি, তুর্কি সরকারের প্রকল্প ভেস্তে গেলেও বর্তমান সৌদী সরকার আগামী কয়েক বছরের মাঝেই মক্কা-মদিনায় রেল সংযোগ চালু করার কাজ হাতে নিয়েছে। যদি তাদের তেল রপ্তানির বণিজ্য ঠিকভাবে চলে তাহলে একটু ধৈর্য রাখুন, হযরত মির্যা সাহেবের ১৯০২ সালের লেখার বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাবেন। ‘হিজায রেলের’ একটি স্টেশন যা মদিনায় স্থাপিত হয়েছিল তার চিত্রটিও দেখে নিন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
১৯. আপত্তি: কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ধর্মযুদ্ধ হারাম। (রূহানী খাযায়েন ১৯/৭৫) অথচ কুরআন বলছে: “তোমাদের উপর লড়াই ফরয করা হয়েছে।” كتب عليكم القتال (সূরা বাকারা ২১৬)

উত্তর: ‘আল্লামা’-র চমৎকার যুক্তি। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করেই চোখ বন্ধ করে ‘জেহাদ-জেহাদ’ বলে মানুষের মগজধোলাই করতে থাকাই কি মহানবীর ইসলাম? খোদাভীরু মুসলমানরা অনেক গভীরে গিয়ে ইসলাম পালন ও কুরআন হাদীস চর্চা করে থাকেন। ‘আল্লামা’-র উপস্থাপিত যুক্তির আলোকেই প্রশ্ন করছি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা'লা বলেছেন كتب عليكم الصيام তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে (সূরা বাকারা: ১৮৪)। কিন্তু ব্যতিক্রম হিসাবে আল্লাহ্ তা’লা অসুস্থ এবং মুসাফিরদের উল্লেখ করেছেন। ‘আল্লামা’! বলুন, অসুস্থ ও মুসাফির অবস্থায় কেউ কি রমজানে রোযা রাখতে পারে? আবার শর্ত হল, রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। আমরা কি সেই ফরজ কাজটি রজব মাসে করতে পারি? প্রত্যেকটি ইবাদতের কিছু শর্ত রয়েছে। পবিত্র কুরআন থেকে কর্তিত দু’চারটি শব্দ তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষণিকের জন্য উস্কে দেয়া যায় কিন্তু প্রকৃত সত্যকে লুকানো যায় না। দেখুন, যাকাত আবশ্যক করা হয়েছে, আমরা কি নিঃস্ব, সর্বহারা অভাবীদেরকে যাকাত প্রদানে বাধ্য করতে পারি? যাকাত আদায় না করলে আমরা কি তাদের দোষারোপ করতে পারি? আবার দেখুন, নামাযকে ফরয করা হয়েছে। তাই বলে কি আমরা নিষিদ্ধ সময়ে সেই নামায আদায় করতে পারি? এ সবের উত্তর হল, না। যে জিনিষ যে শর্তে ফরয বা আবশ্যক করা হয়েছে সে শর্তেই সেই ফরয কাজ সম্পাদন করতে হবে। পবিত্র কুরআনে ফরযের ঘোষণা আছে এবং থাকবে। কিন্তু আল্লাহ্ প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ী এসব ইবাদতের বাস্তবায়ন নির্ধারণ করতে হবে। ঠিক এ নীতি অনুসারে মির্যা সাহেব সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনে যেসব শর্তাবলী রাখা আছে তার আলোকে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যেহেতু পবিত্র কুরআনে বর্ণিত শর্ত পূর্ণ হয় না, তাই এ যুগে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষেধ। যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে পবিত্র কুরআন বর্ণিত জিহাদ আখ্যা দিচ্ছে তারা চরম ভুল করছে। এ প্রেক্ষাপটে এ যুগে সশস্ত্র জিহাদ বৈধ নয়।

মির্যা সাহেব কেবল এদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, আত্মরক্ষামূলক সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য যেসব শর্ত রাখা আছে সেগুলো- এ যুগে এবং এই সরকারের ক্ষেত্রে পূর্ণ হয় না। তাই এ যুগে সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ নিষিদ্ধ। বিষয়টি কেবল এতটুকু। শর্ত প্রযোজ্য না হওয়ার কারণে শেষ যুগের মসীহ্ ও ইমাম মাহদী (আ.) যে যুদ্ধ রহিত করবেন তার ইঙ্গিত নিম্নোক্ত হাদীস থেকেও জানা যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يُوشِكُ مَنْ عَاشَ مِنْكُمْ أَنْ يَلْقَى عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ إِمَامًا مَهْدِيًّا وَحَكَمًا عَدْلًا فَيَكْسِرُ الصَّلِيبَ وَيَقْتُلُ الْخِنْزِيرَ وَيَضَعُ الْجِزْيَةَ وَتَضَعُ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا

অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীস: মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের (মুসলমানদের) মধ্যে যারা জীবিত থাকবে তারা ঈসা ইবনে মরিয়মকে ন্যায়-মিমাংসাকারী ইমাম মাহদীরূপে দেখবে। তিনি ক্রুশ (মতবাদ) ভঙ্গ করবেন, শূকর বধ করবেন এবং ধর্মযুদ্ধ রহিত করবেন।’ (মুসনদ আহমদ) মুসনাদ আহমদের উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, শেষ যুগে আগমনকারী প্রতিশ্রুত মসীহ্ যুদ্ধ স্থগিত করবেন। কিন্তু আত্মশুদ্ধির জিহাদ, পবিত্র কুরআন প্রচার ও প্রসারের জিহাদ, কলমের জিহাদ, ধনসম্পদ ত্যাগের জিহাদ অব্যাহত আছে ও থাকবে। এতে চালাকি করে কেবল অস্ত্র-যুদ্ধ যে হারাম তা উদ্ধৃত করা হয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে যে স্পষ্ট একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে তা ‘আল্লামা’ যেন বেমালুম ভুলে গেলেন!

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
২০. আপত্তি: ১৮৫৭ সালে কুরআন আসমানে উঠানো হবে বলে কুরআনে বক্তব্য আছে। (রূহানী খাযায়েন ৩/৪৯০, দ্র. টিকা)

উত্তর: ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ খুব ভালভাবেই জানেন, কুরআনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি বাহ্যিক উপকরণের উল্লেখ করে আধ্যাত্মিক বা গভীরতর বিষয়ের অবতারণা করে। মুসলমানদের চরম অবক্ষয় প্রসঙ্গে আল্লাহ বলে রেখেছেন, আল্লাহ্ ঊর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে পুনর্জীবিত করেন আবার তিনি সেই পানি উধাও করে দিতেও সক্ষম। এ কথার উল্লেখ তিনি এভাবে করেছেন, وَإِنَّا عَلَى ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ এখানে বাহ্যিক পানির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক পানিরও উল্লেখ রয়েছে। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মুসলমানদের জন্য এ বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। এ আয়াতেরই ‘হুরূফে আবজাদের’ (আরবী অক্ষরগুলোর সংখ্যমান) হিসেবে ১৮৫৭ সনটি নিরূপিত হয়।

যে কুরআন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে সেই কুরআনকেই পুনর্বাসিত করার জন্য, এবং অবক্ষয়ের পর মুসলমানদেরকে পুনর্জীবিত করার লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা’লা আল কুরআনের মর্ম ও তত্ত্ব উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া ‘আল্লামা’ নিশ্চয়ই জানেন মহানবী (সা.) ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীকে সর্বোত্তম শতাব্দী বলে উল্লেখ করেছেন। আবার সূরা সাজদার প্রথম রুকুতেই বলে রেখেছেন, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এমন এক দিনে জগৎ থেকে উঠে যাবে যা মানুষের গণনায় এক হাজার বছরের সমান। ৩০০ + ১০০০ = ১৩০০। অর্থাৎ ১৩০০ হিজরী সনে ইসলাম চরম দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় থাকবে। আর এটি ১৮৫৭ সনের অনতিবিলম্ব পরের যুগ।

যখন ইসলামের এহেন চরম দুর্দশা তখন إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ অর্থাৎ নিশ্চয় আমরা এই যিকর তথা কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর হেফাজত করব। (সূরা হিজর: আয়াত ১০) এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মহান সংস্কারক পাঠিয়ে আল্লাহ ইসলামের শিক্ষাকে পুনরুদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ তো মির্যা সাহেবের বই পড়ে আপত্তি লিখেছেন। মির্যা সাহেব কোন হিসাবে ১৮৫৭ সন নির্ধারণ করেছেন তা উদ্ধৃত টিকার মাঝেই লেখা আছে। পাঠকের কাছে স্পষ্ট, ‘আল্লামা’ স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব আপত্তি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।