আপত্তির জবাব

ভুলক্রমে বুখারী শরীফের হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের আপত্তি: মির্যা সাহেব বলেন, ‘বুখারী শরীফের ঐ সকল হাদীসসমূহ যাতে শেষ যুগের কিছু খলীফাদের ব্যাপারে সংবাদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঐ খলীফা, যার ব্যাপারে আসমান থেকে এই ডাক আসবে যে, এই হল “আল্লাহর খলীফা মাহদী”। এবার ভাব, এটা কেমন মর্যাদাবান কিতাব, যাকে কুরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ মনে করা হয়!?’ [রূহানী খাযায়েন ৬/৩৩৭] ‘আল্লামা’র মূল আপত্তি হল, বুখারী শরীফের আশ্রয় নিয়ে মির্যা সাহেব নিজের ইমাম মাহদী হবার দাবীকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেছেন অথচ এই হাদীসটি বুখারীতে নেই! সত্য দাবীর জন্য মিথ্যা বলার কোন প্রয়োজন নেই।

উত্তর: আমরা মির্যা সাহেবকে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কল্যাণে উম্মতী নবী হিসাবে মেনেছি। নবী মানুষ হয়ে থাকেন, তিনি খোদা নন। একমাত্র আল্লাহ্ সকল ভুল-ত্রুটি ও স্মৃতি-ভ্রমের ঊর্ধ্বে। নবী-রসূলরা মানবীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। তদনুযায়ী বিভিন্ন সময় তাদের স্মৃতিভ্রম ঘটতে পারে। হযরত আদম (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে লেখা আছে,

وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَى آدَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدُ لَهُ عَزْمًا

আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশনা দিয়েছিলাম, অতঃপর সে ভুলে গেল কিন্তু তার মাঝে আমি ইচ্ছাকৃত পাপ করার প্রবণতা দেখতে পাই নি (সূরা তাহা: ১১৬)। হযরত আদম (আ.)-এর এই ভুল করা সত্ত্বেও তাঁর নবী হওয়া নিয়ে কারও মনে কোন সংশয় নেই। হযরত মূসা (আ.) এবং তাঁর সাথী পথ চলতে চলতে নিজেদের মাছের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। এ সম্পর্কে কুরআনে বলা আছে,

فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا

হযরত মূসা এবং তার সহচর উভয়ে মাছটির কথা ভুলে গেলেন (সূরা কাহ্‌ফঃ ৬২)। এ স্মৃতিভ্রম সত্ত্বেও আপত্তিকারী ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের দৃষ্টিতে নিশ্চয় হযরত মূসা (আ.) সত্য নবী হিসেবেই স্বীকৃত।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন। বুখারী শরীফের কিতাবুস সালাত-এর হাদীসটি দেখুন যেখানে বলা আছে,

قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَنَسِيتَ أَمْ قَصُرَتِ الصَّلاةُ قَالَ " لَمْ أَنْسَ، وَلَمْ تُقْصَرُ ". فَقَالَ " أَكَمَا يَقُولُ ذُو الْيَدَيْنِ " . فَقَالُوا نَعَمْ . فَتَقَدَّمَ فَصَلَّى مَا تَرَكَ

একবার আসরের নামাযে দু’রাকাত পড়ে মহানবী (সা.) সালাম ফিরিয়ে দিলেন। যুল ইয়াদাইন (রাযি.) বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কি ভুলে গেছেন নাকি নামায সংক্ষিপ্ত করে দেয়া হয়েছে? তিনি (সা.) বললেন, আমি ভুলেও যাই নি আর নামায সংক্ষিপ্তও করা হয় নি। এরপর রসূলুল্লাহ্ (সা.) উপস্থিত সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, যুল ইয়াদাইন যা বলছে আসলে কি তাই? মুসুল্লীগণ বললেন, হ্যাঁ। এরপর তিনি (সা.) অবশিষ্ট নামায আদায় করলেন। (বুখারী কিতাবুস্ সালাত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুদিত বুখারী শরীফ: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬১ হাদীস নম্বর-৪৬৬)

উপরোক্ত হাদীসে রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, আমি ভুলেও যাই নি বা নামাযও সংক্ষিপ্ত করা হয় নি। অথচ সাহাবা (রা.) সাক্ষী দিলেন, ভুল হয়েছে। এরপর তিনি (সা.) ভুলটিকে সংশোধন করে নিয়ে অবশিষ্ট দু’রাকা’ত নামায আদায়ও করলেন। আর মহানবী (সা.) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন,

وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى

তিনি (সা.) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন কথা বলেন না, যা বলেন তা ওহীই হয়ে থাকে (সূরা নজম: ৪-৫)। ‘আল্লামা’ কি তাহলে মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধেও আপত্তি করবেন? পাঠক, এখানে আপত্তির কিছু নেই। এর মাধ্যমে মহানবী (সা.) বা অন্যান্য নবীরা নাউযুবিল্লাহ মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হন না বরং প্রমাণ হয় আল্লাহ্ নবীগণ মানুষ এবং তারা মানবীয় সীমাবদ্ধতা ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। এ সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান খোদা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং শত দুর্বলতা সত্ত্বেও তাদেরকে জয়ী করে দেখান। এর দ্বারা আল্লাহ্ জীবন্ত অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। যে নবী আল্লাহ্ ওহী না পেয়ে কথা বলেন না তিনি (সা.) মদিনায় খেজুরের পরাগায়ণ সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন তা কি ফলপ্রসু হয়েছিল? পরবর্তী বছর খেজুরের ফলন কম হলে সাহাবীরা যখন বললেন, রসূল (সা.)-এর কথানুযায়ী তারা পরাগায়ণ করান নি। এর উত্তরে রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছিলেন,

أَنْتُمْ أَعْلَمُ بِأَمْرِ دُنْيَا كُمْ

অর্থাৎ জাগতিক বিষয়ে তোমরাই ভাল জ্ঞান রাখ। এখন বলুন, এর আগের বছর যখন তিনি পরাগায়ণ করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন তখন কি তিনি ওহীপ্রাপ্ত ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু কোন মানুষের ওহীপ্রাপ্ত হওয়া কাউকে ইশ্বরত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায় না। তিনি মানুষই থাকেন। মানবীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁর সাফল্য ও তাঁর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন তাঁকে আল্লাহর প্রতিনিধি সাব্যস্ত করে।

তেমনিভাবে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) ও আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েও যেহেতু তিনি মানুষ ছিলেন তাই তাঁর দ্বারাও স্মৃতিভ্রম জাতীয় ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার দ্বারা যেসব ভুল হয় তা মানুষ হিসেবে আমার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে আর যেসব সত্য আমি বর্ণনা করি তা আমার প্রভুর পক্ষ থেকে। আমার প্রভু আমাকে তত্ত্বজ্ঞানের পেয়ালা পান করিয়ে পরিতৃপ্ত করেছেন। সেই সাথে এটিও বলে দিচ্ছি, আমি আমার নিজেকে ভুল করা এবং স্মৃতি-বিভ্রাট থেকে পবিত্র বলে মনে করি না’ (রূহানী খাযায়েন, খণ্ড ৮ পৃষ্ঠা-২৭২)। অতএব হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) ‘হাযা খালীফাতুল্লাহিল্ মাহ্‌দী’ হাদীসটি বুখারীতে আছে বলে যে কথা লিখেছেন, এক্ষেত্রেও আমরা সে উত্তরই দিব যা হযরত মোল্লা আলী কারী (রহ.) আল্লামা ইবনে রাবী’ সম্পর্কে দিয়েছেন আর তা হল, হয় এটি লিপিকারের ভুল, নইলে লেখকের লেখার ভুল। কেননা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) তাঁর পুস্তক ‘ইযালায়ে আওহামে’ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমি বলি, ইমাম মাহদী সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সন্দেহমুক্ত নয়, তাই শায়খাইন (অর্থাৎ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম) এগুলোকে গ্রহণ করেন নি’ (পৃষ্ঠা ৫৬৮) । অতএব বুঝা গেল, ‘হাযা খালীফাতুল্লাহিল মাহদী’ হাদীসটি যে বুখারীতে নেই একথা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) জানতেন এবং আগেই তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। আর পরবর্তীতে প্রকাশিত ‘শাহাদাতুল কুরআন’ পুস্তকে তিনি যা লিখেছেন তা স্মৃতিভ্রম বা মানবীয় দুর্বলতা হেতু ভুল অথবা কলম ফসকে লেখা (সাক্বাতে কলম) বা মুদ্রণ প্রমাদ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

হ্যা, তবে এই হাদীসটি সেভাবেই ‘সহীহ’ হিসেবে পরিগণ্য যেভাবে বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস ‘সহীহ্’। কেননা, এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম সুয়ূতী (রহ.) বলেছেন এবং ‘যাওয়ায়েদে’ও বর্ণিত হয়েছে, এর সনদ সঠিক এবং এর বর্ণনাকারীগণ সিক্বাহ অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য। আর ইমাম হাকেম (রহ.) তার ‘মুসতাদরেক’-এর কিতাবুত তাওয়ারীখে এটি সংকলন করেছেন এবং বলেছেন, এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তাবলী অনুযায়ী সহীহ্ বা সঠিক। (ইবনে মাজা, কিতাবুল ফিতান বাবু খুরূজিল মাহদী, মিশর থেকে প্রকাশিত ২৬৯ পৃষ্ঠার পাদটিকা)।

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব নিজের জ্ঞানের ভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন ২০ নম্বর পৃষ্ঠায়। তিনি এখানে আপত্তি করেছেন, মির্যা সাহেব যা বলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেন, নিজের পক্ষ থেকে বলেন না। মির্যা সাহেব যদি সত্যিই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে পরিচালিত হয়ে থাকেন তাহলে তার দ্বারা এ কাজ হল কীভাবে? এটিই ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের প্রধান প্রশ্ন।

হ্যাঁ, একথা সত্য, নবী-রসূলগণ আল্লাহ্‌র হাতের পুতুল হয়ে থাকেন। যদি মির্যা সাহেব আল্লাহ্ প্রত্যাদিষ্ট হয়ে এ কথা লিখেই থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে, আল্লাহ্ তা’লা তাঁর মাধ্যমে আলেম-উলামাদের দৃষ্টি এই হাদীসের উচ্চ মান ও মার্গের দিকে আকৃষ্ট করাতে চেয়েছেন। এই হাদীস সম্পর্কে ইমাম সুয়ূতী কী বলেছেন, আরেকবার দয়া করে ওপরে দেখে নিন। এছাড়া মুসতাদরিক-এর হাদীস সম্বন্ধে একথা ‘আল্লামা’র নিশ্চয়ই জানা আছে, এটি ‘আলা শারায়েতে সাহীহাইন’ অনুযায়ী সংকলিত। এমনও হতে পারে ‘মুসতাদরিক আলা শারায়েতে বুখারী’ লেখা হয়েছিল কিন্তু লিপিকার লিখতে গিয়ে পূর্ববর্তী তিনটি শব্দ বাদ দিয়ে ফেলেছে।

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে উত্তর শেষ করছি যা বাংলাদেশের আলেম উলামারা সহজেই বুঝতে পারবেন। আমাদের দেশে তারাবীর নামাযে খতমে কুরআন পড়ার সময় কখনো কখনো হাফেয সাহেবরা ভুলে যান বা কিছু আয়াত অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়ে যায়। এটিকে হাফেয সাহেবদের প্রতারণা বলা যায় না বরং এটি তাদের স্মৃতিভ্রম মাত্র। ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের মত এত বড় বিজ্ঞ আলেম নিশ্চয় এসব জানেন। তিনি জানেন, ১৮৯১ সালে লেখা ইযালায়ে আওহামে স্পষ্টভাবে মির্যা সাহেব লিখেছেন, বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইমাম মাহ্‌দী সংক্রান্ত কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি আর আলোচ্য শাহাদাতুল কুরআন পুস্তক প্রকাশের বহু পরে রচিত পুস্তকেও এর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এসব জানা থাকা সত্ত্বেও ‘আল্লামা’ এমন আপত্তি কেন তুলছেন। তাহলে কি ‘আল্লামা’ মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য এমন কপটতাপূর্ণ নীতি ও মানদণ্ড দাঁড় করিয়েছেন?

অতএব মির্যা সাহেব মিথ্যা কথা বলে মানুষকে আহমদীয়াত তথা প্রকৃত ইসলামের দিকে আহ্বান জানান নি বরং তিনি সত্যসহকারে আবির্ভূত হয়েছেন এবং মানুষকে আল্লাহ্‌র সত্য পথে আহ্বান করেছেন। যুগে যুগে যখনই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রত্যাদিষ্টরা এসেছেন, সমসাময়িক আলেম-উলামা তাদেরকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অযথা আপত্তির পর আপত্তি করেছে। তাই ‘আল্লামা’র এসব আপত্তিও আল্লাহ্‌র বিধান পরিপন্থী কিছু নয়। আর ‘আল্লামা’ নোংরা গালি উল্লেখ করে মির্যা সাহেবের প্রতি আরোপ করেছেন। ৩৬-৪৪ পৃষ্ঠায় এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা দেখুন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।