আপত্তির জবাব

ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আহমদীয়া জামা’তের অনন্য ভূমিকা

১। কল্পিত শ্বেত-পত্রের অদ্ভুত মিথ্যা অপবাদ

পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হইতে প্রকাশিত শ্বেত-পত্র সম্বন্ধে আলোচনা হইতেছে। ইহাতে একটি এই অপবাদও বার বার করিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে যে, নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক আহমদীয়া জামা’ত ইসলামেরও দুশমন, দেশ ও জাতিরও দুশমন এবং তাহাদের বিশ্বাসঘাতকতা দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য খুব মারাত্মক বিপদের কারণ। তাহারা কেবলমাত্র ইসলামের জন্যই হুমকি ও বিপদের কারণ নহে, বরং সমগ্র মিল্লাতে ইসলামীয়া ও মুসলমান দেশগুলির জন্যও বিপদের কারণ। এই বক্তব্যের পক্ষে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হইয়াছে যে, যেহেতু তাহার (অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার) মনে করে আহমদীয়া জামাত ইসলামী দেশসমূহে বিস্তার লাভ করিতে পারে না, সেহেতু সকল মুসলমান দেশ যাহাতে ধ্বংস ও বরবাদ হইয়া অনৈসলামিক শক্তিগুলির হাতে চলিয়া যায়, এই প্রচেষ্টাই অনিবার্যভাবে আহমদীরা করিয়া থাকে।
২। প্রথম সারির মুজাহিদবৃন্দ

এই মিথ্যা অপবাদের ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণের ব্যাপারে ইহাই বলিতে হয় যে, ইহা একটি ব্যাপক বিষয়বস্তু। এই অল্প সময়ের মধ্যে ইহার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নহে। কেবলমাত্র এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে হইতেছে যে, ইসলামের উপর বা মুসলমানদের উপর যখনই কোন বিপদ আপতিত হইয়াছে তখন প্রথম সারির জেহাদকারী আহমদীয়া জামা’তের সদস্যরা ছিল, নাকি আহমদীয়া জামা’তের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপকারীরা? এই বিষয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পাতা হইতে কিছু নির্বাচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী উপস্থাপন করিতেছি।
৩। জগদ্বাসীকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্য আহ্বান

মুসলমান দেশগুলিতে আহমদীরা বিস্তার লাভ করিতে পারে না, এই জন্য তাহারা এই দেশগুলিকে নিশ্চিহ্ন করিতে চায় – ইহা একটি অদ্ভুত যুক্তি। ইহা সরাসরিভাবে মিথ্যা অনুমানের উপর দাঁড় করানো হইয়াছে এবং ইহার মধ্যে মারাত্মক স্ব-বিরোধ দেখিতে পাওয়া যায়। মুসলিম দেশগুলিতে জামা’ত উন্নতি করিতে পারে না, এই জন্য জামা’ত বিদ্বেষপরায়ণ হইয়া এই সকল দেশকে ধ্বংস করিতে চায় – এই অনুমানটিকে যদি সত্য বলিয়া স্বীকারও করিয়া নেওয়া হয়, তাহা হইলে স্বাভাবিকভাবে ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যেহেতু পাকিস্তানে জামা’ত উন্নতি করিয়াছে, সেহেতু জামা’তের তরফ হইতে পাকিস্তানের জন্য কোন বিপদ আসা উচিত নয়। তাহা হইলে তোমরা আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে যে দোষারোপ করিতেছ যে, তাহারা পাকিস্তানের উপর আঘাত হানিতেছে, ইহার বৈধতা কি? বস্তুতঃ তথাকথিত শরীয়তী আদালতেও বিভিন্ন উকিল এই যুক্তি উত্থাপন করিতে থাকে যে, এই জামা’ত তবলীগের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হইয়া চলিয়াছে। ইহা তাহারা সহ্য করিতে পারে না। ১৯৭৪ সনের আন্দোলনেও এবং ইহার পূর্বের আন্দোলনগুলিতেও যে বিষয় লইয়া সবচাইতে অধিক হৈ চৈ করা হইয়াছিল তাহা এই ছিল যে, বাধা দিয়াও আহমদীদিগকে আটকানো যাইতেছে না। তাহারা সম্প্রসারিত হইয়াই চলিয়াছে। সুতরাং কোন দেশে আহমদীয়া জামা’তের জন্য এই বিপদ কিভাবে সৃষ্টি হইয়া গেল যে তাঁহারা উক্ত দেশে বিস্তার লাভ করিতে এবং উন্নতি সাধন করিতে পারিবে না? তাহা হইলে তোমরা এই ফয়সালা কর যে, পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র নহে। এই জন্য আহমদীয়া জামা’ত এই দেশে সম্প্রসারিত হইতেছে। যদি ইহা ইসলামী রাষ্ট্র না হয়, তাহা হইলে তোমরা ইসলামের রক্ষাকর্তা ও দাবীদাররূপে কোথা হইতে পয়দা হইয়া গেলে? ইহার সহিত তোমাদের কোন সম্পর্কই নাই। ইহা অমুসলিম দেশ। ইহাতে যাহা কিছু হইতেছে, হইতে থাকুক। ইহাতে তোমাদের কি বা আসে যায়? কিন্তু যদি ইহা ইসলামী রাষ্ট্র হয় এবং যেহেতু ইসলামের নামে এই দেশ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এই দিক হইতে অনিবার্যরূপে ইহা ইসলামী রাষ্ট্র। তাহা হইলে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে যে দেশে সর্বস্তরে বিপুল সংখ্যায় সকল শ্রেণীতে আহমদীয়া জামা’ত বিস্তার লাভ করিতেছে, ঐ দেশ অর্থাৎ পাকিস্তানে আহমদীয়া জামা’তের জন্য কি আশংকা থাকিতে পারে যে, তাহারা তথায় উন্নতি করিতে পারিবে না? সুতরাং তোমাদের কি যৌক্তিকতা থাকিল যে, আহমদীয়া জামা’ত মুসলিম দেশসমূহে উন্নতি করিতে পারে না, এই জন্য তাহারা এই সকল দেশকে ধ্বংস করিয়া দিতে চায়?

এখন আমি ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পর্যালোচনা করিতেছি। জগদ্বাসীর ঠাণ্ডা মাথায় এইগুলি সম্বন্ধে চিন্তা করা উচিত। এই সকল ঘটনা ইতিহাসের পাতায় একেবারে এইরূপ কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে যে, ঐগুলিকে আজ মুছিয়া ফেলা যায় না। যুগের কলম যখন ঘটনাবলী লিখিয়া ফেলে তখন পৃথিবীর কোন শক্তি পিছনে ফিরিয়া গিয়া ঐ কলমের লেখা মুছিতে পারে না। এখন ইহারা সমগ্র বিশ্বে যত পারে হৈ চৈ করুক, নূতন ইতিহাস তৈরী করার যত প্রচেষ্টা করিতে চাহে করুক। কিন্তু যে সকল ঘটনা ভূপৃষ্ঠে একবার ঘটিয়া গিয়াছে, এখন কোন হাত ঐ সকল ঘটনাকে মুছিয়া ফেলিতে পারে না। যেহেতু ইতিহাস খুবই দীর্ঘ এবং ইহাকে সংক্ষিপ্ত করার প্রচেষ্টা করা হইলেও আমি মনে করি যে, এই বিষয়টি অত্যন্ত সুদীর্ঘ হইয়া যাইবে, সেহেতু এমন হইতে পারে যে আগামী খোৎবাতেও এই বিষয়টিকে জারি রাখিতে হইবে এবং সম্ভবতঃ তৃতীয় খোৎবাতেও ইহা জারি থাকিবে। অতএব, যদি কোন খোৎবা এই কারণে দীর্ঘ হইয়াও যায়, তথাপি আশা করিব যে বন্ধুগণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিবেন। কেননা, এখন জামা’তের স্থিতি ও ইহার কল্যাণের জন্য ইহা অতীব প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছে যে, আমাদিগকে খুবই বিস্তারিতভাবে আপত্তিকারীদিগকে ফলপ্রসূ উত্তর প্রদান করিতে হইবে এবং এইভাবে উত্তর প্রদান করিতে হইবে, যাহাতে তাহাদের সাধারণ জনগণও ইহা বুঝিতে পারে এবং তাহাদের নিকট ইহা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হইয়া যায় যে, কে মিথ্যাবাদী এবং কে সত্যবাদী?
৪। খেলাফত আন্দোলনের বিপদাবলী হইতে বাঁচার পরামর্শ

আমি খেলাফত আন্দোলনের (Khilafat Movement) প্রতি বন্ধুগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কেবলমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনই সংঘটিত হয় নাই, বরং কোন কোন বড়ই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন তুরস্কে সংঘটিত হইয়াছিল। তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের সহিত মিলিত হইয়া মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিল। এই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হইল। মিত্রপক্ষ জয়লাভ করিল এবং তুরস্কের সুলতান আবদুল হামিদকে পদচ্যুত করা হইল। অতঃপর সেখানে একটি মারাত্মক বিপ্লব সংঘটিত হইল। ইহার ফলশ্রুতিতে কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসীন হইলেন। এইভাবে তুরস্কের রাজতন্ত্র, যাহা খেলাফতের নামে চলিতেছিল, উহার পরিসমাপ্তি হইয়া গেল। তখন ভারতের মুসলমানরা খেলাফতকে জীবিত করার জন্য আন্দোলন আরম্ভ করিল। এই আন্দোলন মূলতঃ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিল। যেহেতু তাহারা এক মুসলিম খেলাফতের সমাপ্তি ঘটাইয়াছিল, সেহেতু মুসলমানদের, বিশেষভাবে ভারতের মুসলমানদের, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা উচিত। কিন্তু এই জেহাদের আওয়াজ আরবের কোন দেশ হইতে উঠে নাই। ভারতবর্ষ হইতে একটি প্রতিনিধিদল তুরস্কে প্রেরণ করা হইয়াছিল। এই দলটি মুসলমান আলেম ও কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত হইয়াছিল। প্রতিনিধি দলটি কামাল আতাতুর্কের সহিত সাক্ষাত করিল এবং তাঁহার নিকট খেলাফতের প্রস্তাব করিল এবং বলিল যে, আমরা আপনার সহিত রহিয়াছি। কামাল আতাতুর্ক খুব অবাক হইয়া তাহাদের কথা শুনিলেন এবং এই প্রস্তাবকে এই বলিয়া নাকচ করিয়া দিলেন যে, তোমরা কি কথা লইয়া আমার নিকট আসিয়াছ? আমি অতি কষ্টে তুরস্ককে এই সকল বাজে ও বাসি পচা ধ্যান-ধারণা হইতে মুক্ত করিয়াছি এবং ইহার অনাবশ্যকভাবে বিস্তৃত সীমান্তকে সংহত করিয়া, দেশকে ভিতর ও বাহিরের দিক হইতে সুরক্ষিত করিয়াছি। তোমরা এখন কোন্ ধারণায় এবং কিরূপ চিন্তা-ভাবনা লইয়া আমার নিকট আসিয়াছ? বস্তুতঃ কামাল আতাতুর্ক এই প্রস্তাবকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করিয়া দিলেন।

ভারতবর্ষে তখন একটি আবেগ ও উত্তেজনা ছিল। কিন্তু তাহারা বিগত দিনের খবরও জানিত না। তাহারা নিজেদের পরিবেশ ও পরিমণ্ডল সম্বন্ধেও কিছু জানিত না যে, কি হইতেছে। বিগত দিনের খবরের কথা না হয় ছাড়িয়াই দিলাম। তাহারা আজিকার খবর সম্বন্ধেও ওয়াকেবহাল নহে। তাহারা নিজ অতীত সম্বন্ধেও ওয়াকেবহাল নহে। তাহারা যুগের লিখিতপাঠ পড়িতে পারে না। এইরূপ আলেমরা খুব তোর জোড়ের সহিত মুসলমানদের মধ্যে একটি প্রচণ্ড আন্দোলন চালাইতেছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের লাগাম ছিল হিন্দুদের হাতে। এই সময় এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র একটি আওয়াজই উঠিয়া চলিল এবং তাহা কাদিয়ান (ইহা ভারতের পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম, যেখানে আহমদীয়া জামা’তের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালাম জন্মগ্রহণ করেন। ইহা তখন বিশ্ব আহমদীয়া জামা’তের কেন্দ্র ছিল-অনুবাদক) হইতে উঠিয়াছিল। এই আওয়াজ অত্যন্ত জোরালোভাবে মুসলমানদিগকে বারবার পরামর্শ দিতেছিল যে, “এই আন্দোলনের দ্বারা তোমরা এতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হইবে যে, অতঃপর দীর্ঘকাল ধরিয়া তোমাদিগকে ইহার খেসারত দিতে হইবে। ইহা একটি অর্থহীন আন্দোলন। ইহা একটি কাণ্ড-জ্ঞানহীন আন্দোলন। অতএব তোমরা ইহা হইতে বিরত হও”। এই সত্য কথার ফল এই দাঁড়াইয়াছিল যে, আহমদীদের উপর কঠোর যুলুম-নির্যাতন করা হইল এবং তাহাদের বিরুদ্ধেও একটি আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠিল এবং বড়ই বেদনাদায়ক ঘটনাবলী সংঘটিত হইল, বিভিন্ন স্থানে আহমদীদিগকে বয়কট করা হইল। প্রচণ্ড গরমের দিনগুলিতে তাহাদের পানি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। গ্রীষ্মের রাত্রিতে বাহিরে শায়িত আহমদীদের উপর পাথর মারা হইত। ঐ যুগে বৈদ্যুতিক পাখার তেমন প্রচলিত ছিল না এবং লোকেরাও তুলনামূলকভাবে গরীব ছিল। বস্তুতঃ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আহমদীদিগকে বদ্ধ গৃহের অভ্যন্তরে ছেলে-মেয়ে লইয়া ঘুমাইতে হইত, অথবা ঘুমানোর চেষ্টা করিতে হইত। কেননা এই সকল লোক আহমদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাইতে ছিল এবং বলিতেছিল যে, “তোমরা কেন খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছ? আমরা ইসলামের খেদমত করিতেছি। তোমরা ইহার বিপরীত কিছু করিতেছ। অতএব তোমাদের শাস্তি হইল এই যে, তোমাদের সহিতও ইংরেজদের ন্যায় আচরণ করিতে হইবে এবং তোমাদিগকেও মারপিট করিতে হইবে।” কিন্তু ঐ সময় কাদিয়ান হইতে উত্থিত একক আওয়াজ বারবার মুসলমানদিগকে সতর্ক করিতেছিল যে, তোমরা মারাত্মক ভুল করিতেছ।
৫। মহাত্মা গান্ধীর মস্তিষ্কের আবিষ্কার

এই অসহযোগ আন্দোলন কি ছিল? ইহা এমন এক আন্দোলন ছিল যাহা ভারতের মুসলমানদিগকে অসহযোগ আন্দোলনের জালে জড়াইয়া দিয়াছিল। এই আন্দোলনটি প্রকৃতপক্ষে মহাত্মা গান্ধীর মস্তিষ্কের এক আবিস্কার। কংগ্রেস যে সকল মোল্লাকে পুরস্কারে ভূষিত করিয়াছিল, তাহাদের মাধ্যমে এই আন্দোলন চালানো হইয়াছিল। অতঃপর ইহা এত প্রচণ্ড রূপ ধারণ করিল যে সকল বড় বড় আলেম এবং সকল মুসলমান রাজনৈতিক নেতা ইহার আওতাভুক্ত হইয়া পড়িলেন। অতঃপর কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসীর মধ্যে আর কোনই পার্থক্য রহিল না। এই আন্দোলনের ব্যাপারে মিষ্টার গান্ধী নিজে যাইয়া মুসলমান আলেমদের নিকট হইতে ফত্‌ওয়া লইলেন যে, “দেখ, ইংরেজরা কত যুলুম করিয়াছে। তাহারা খেলাফত ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। অতএব হে মুসলমান আলেমরা! এই ব্যাপারে তোমাদের ফতওয়া কি? যদি ইংরেজদের সহিত মোকাবেলা করা সম্ভব না হয় তাহা হইলে জেহাদ কিভাবে করা যাইতে পারে?” অর্থাৎ একজন হিন্দু নেতা মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য ফত্‌ওয়া নিতেছেন। বস্তুতঃ গান্ধীজী যখন মুসলমানদের নিকট ফত্‌ওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তখন শীর্ষস্থানীয় পাঁচশত আলেম গান্ধীকে এই ফত্‌ওয়া দিলেন যে, এখনতো মুসলমানদের জন্য একটি রাস্তাই খোলা রহিয়াছে এবং তাহা হইতেছে এই যে, ইংরেজদের সহিত উঠা বসা ও লেনদেন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিতে হইবে এবং নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করিয়া মুসলমানদিগকে কোন ইসলামী রাষ্ট্রে হিজরত করিতে হইবে, অতঃপর সেস্থান হইতে আক্রমণ করিয়া সগৌরবে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে এবং ইংরেজদিগকে মারিতে মারিতে ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত করিতে হইবে।
৬। অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি

মোদ্দা কথা, এই ফত্‌ওয়ার উপর ভিত্তি করিয়াই অসহযোগ আন্দোলন চালানো হইয়াছিল। বস্তুতঃ এই আন্দোলনকে সফল করার জন্য উৎসাহ ও উত্তেজনা এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছিল যে, ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মুসলমানরা মরিতে ও মারিতে প্রস্তুত হইয়া গেল। এই অবস্থার বর্ণনায় মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক তাঁহার “সের গুজাস্ত” নামক পুস্তকে নিম্নরূপ লিখেন। ইহা ছিল তাহার নিজ চোখে দেখা দৃশ্য। তিনি বলেন:-

“ঐ রাত্রে কংগ্রেসের প্যান্ডেলে খেলাফত কনফারেন্সের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইল। এখন স্মরণ করিতে পারিতেছি না যে, এই সম্মেলনের সভাপতি কি গান্ধীজি ছিলেন, নাকি মৌলানা মোহাম্মদ আলী ছিলেন। যাহা হউক সকল নেতাই ইহাতে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। ষ্টেজে গান্ধীজি, শ্রীমতি তিলক, এ্যানী বেসান্ত, জয়কর, কৈলকর, মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, জাফর আলী খান, সৈয়দ হোসেন, মৌলানা আবদুল বারী, মৌলানা ফাখরে আলা আবেদী, মাওলানা হসরত মোহানী এবং আরো অনেক গণ্যমান্য নেতা উপবিষ্ট ছিলেন। মৌলানা মোহাম্মদ আলী প্রথমে ইংরেজীতে বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন। তিনি বলিলেন আমি কিছুক্ষণ ইংরেজীতে বক্তৃতা করিব। কেননা ইহাতে যে সকল দেশীয় নেতা উর্দু বুঝে না তাহারা খেলাফতের ব্যাপারে মুসলমানদের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুধাবন করিতে পারিবেন। অতঃপর আমি উর্দুতে বক্তৃতা করিব। মৌলানার বক্তৃতা ছিল অতুলনীয়। কেবলমাত্র ভাষা ও বাচনভঙ্গির মানের দিক হইতেই নয়, বরং মর্মের দিক হইতেও সম্পূর্ণ বিষয়টির উপর তাহার পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। তাঁহার আবেগ ও উচ্ছাসের মাত্রা একটি বাক্য হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, “এখন দেশ হইতে হিজরত করিয়া চলিয়া যাওয়া ছাড়া আমাদের জন্য আর কোন ধর্মীয় রাস্তা নাই।”

মহাত্মা গান্ধীই এই শরীয়তী ফত্‌ওয়া মুসলমানদের জন্য বাহির করিয়াছিলেন। মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক সাহেব বলেন যে, মৌলানা মোহাম্মদ আলী তাঁহার বক্তৃতায় বলেন:-

“এখন দেশ হইতে হিজরত করিয়া চলিয়া যাওয়া ছাড়া আমাদের জন্য আর কোন ধর্মীয় রাস্তা খোলা নাই। সুতরাং আমরা এই দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইব এবং বাড়ী-ঘর, আমাদের মসজিদগুলি (মসজিদ শব্দটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখার যোগ্য - গ্রন্থকার), এবং আমাদের বুযুর্গগণের মাজার ইত্যাদি সব কিছু আমানতরূপে আমাদের হিন্দু ভাইদের নিকট সঁপিয়া যাইব। অতঃপর আমরা বিজয়ীর বেশে এই দেশে প্রবেশ করিয়া ইংরেজদিগকে বিতাড়িত করিব এবং আমাদের আমানত আমাদের হিন্দু ভাইদের নিকট হইতে ফিরাইয়া নিব। আমি বিশ্বাস রাখি যে, যে হিন্দু ভাইদের সহিত আমরা এক হাজার বৎসর ধরিয়া একসঙ্গে বসবাস করিয়া আসিতেছি, তাহারা আমাদের এতটুকু খেদমত করা হইতে মুখ ফিরাইয়া নিবে না।” (পৃষ্ঠা ১০৭)
৭। কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা

এই “হিন্দু ভাই” কথাটিও একটি খুবই মজাদার বচন। ইহা পূর্বেও ব্যবহার করা হইয়াছে এবং বর্তমানেও ইহা পাকিস্তানে ব্যবহার করা হইতেছে। আহমদীরা ভাই নহে। কিন্তু হিন্দু ও খৃষ্টানরা হইল ভাই। তাহা কেনই বা হইবে না? “এক হাজার বৎসর ধরিয়া একসঙ্গে বসবাস করিয়া আসিতেছে!”

মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক সাহেব লিখেন:-

“তাঁহার পরে বংশীধর পাঠক নামে বেরেলবীর এক ব্যক্তি দাঁড়াইলেন। তাঁহার বক্তৃতা অত্যন্ত ভাবাবেগপূর্ণ এবং খুবই মজাদার ছিল। তিনি মৌলানা মোহাম্মদ আলীর উপর টেক্কা মারিয়া বলিলেন যে, যদি মুসলমান ভাইরা তাহাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী এই দেশ হইতে হিজরত করিয়া যাইতে বাধ্য হয়, তাহা হইলে হিন্দুরাও এখানে থাকিয়া কি করিব? (কত হৃদয়বিদারক কথা।) যদি মুসলমানেরা চলিয়া যায়, তাহা হইলে হিন্দু জাতিও হিজরতে মুসলমানদের সঙ্গী হইবে এবং আমরা পরস্পর ভাই ভাই হইয়া এই দেশকে বিরান ভূমিতে পরিণত করিয়া দিব, যাহাতে ইংরেজরা এই বিরানভূমিতে ভীত হইয়া পালাইয়া যায়।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১০৮)

মৌলানা সালেক সাহেব লিখেন:-

“ইহা কিরূপ কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা! কিন্তু আবেগের দুনিয়াতো তুলনাবিহীন হইয়া থাকে। ঐ সময় সম্মেলনের এই অবস্থা ছিল যে, কোন কোন লোক ডুকরিয়া কাঁদিতেছিল এবং ‘খেলাফত কনফারেন্স’ একটি শোকের আসরে পরিণত হইয়াছিল।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১১১)
৮। মুসলমানদের সম্মেলনে গান্ধীজীর সাদর সম্বর্ধনা

ঐ সময় গান্ধীজী কেবলমাত্র হিন্দুদের নিকটই নয়, মুসলমানদের নিকটও মহাত্মায় পরিণত হইয়াছিলেন এবং ইসলামের সহিত সম্পর্কিত বিষয়াবলী বিবেচনার জন্য তাঁহার নিকট উপস্থাপন করা হইত। বস্তুতঃ মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক সাহেব তাঁহার উপরোক্ত পুস্তকে আরও লিখেন:-

“সম্মেলন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে গান্ধীজি ‘জমিদার’ পত্রিকা অফিসে আগমন করেন। তিনি কয়েকজন খেলাফতী নেতার সহিত আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন এবং আমিও হাবিব উল্লাহ খান মোহাজের শহীদদের বিষয় সম্পর্কিত কাগজ পত্রাদি লাইয়া গান্ধীজীর নাকের ডগায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। কোন প্রকারে যখন তিনি অবসর হইলেন, তখন আমি সকল বিষয় তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলাম।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১২৪)

অর্থাৎ মুসলমান শহীদগণের কাগজপত্রাদি গান্ধীজীর দরবারে দাখিল করা হইতেছে। মৌলানা সালেক লিখেন:-

“ইতিমধ্যে সম্মেলনে যোগদানকারী হাজার হাজার লোক প্রতীক্ষার যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্মুখস্থ রাস্তায় সমবেত হইল।” জমিদার পত্রিকা অফিস তখন আহরারদের কেন্দ্র ছিল এবং আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধাচরণের আড্ডাখানা ছিল। মৌলানা সালেক লিখেন যে, “লোকেরা ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্মুখস্থ রাস্তায় আসিয়া জড় হইল এবং গগনবিদারী ধ্বনি দিতে আরম্ভ করিল, ‘মহাত্মা গান্ধীর জয়’, ‘হিন্দুস্থানের জয়’, ‘হিন্দু মুসলমানের জয়’, ‘বন্দে মাতরম’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘সতসরী আকাল’। (ইহা শিখদের প্রচলিত ধ্বনি - অনুবাদক)।

এই সকল লোকের স্বভাব ও আচরণ সদা-সর্বদাই এইরূপ। আজ আহমদীদের মসজিদ-বাড়ী ও ঘর-দুয়ারে ‘কলেমা তৈয়াব’ খচিত দেখিয়া বেদনায় ইহাদের ডুকরিয়া কান্না আসে এবং আত্মাভিমানে ইহাদের অন্তর ফাটিয়া যায়। ইহার কারণ এই যে, ইহাদের মর্জি মেজাজই অদ্ভুত। আহমদীরা যখন নিজেদের ইমাম হযরত মসীহ মাওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের জয়ের ধ্বনি দেয়, তখন এই সকল লোক আহমদীদিগকে হাজারও রকমের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং আমাদের বক্ষে অংকিত ‘কলেমা তৈয়াব’ তাহাদিগকে পীড়া দেয় যাহাতে খোদার তওহীদ ঘোষিত হয়, হযরত আকদাস মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সত্যতা ঘোষণা করা হয়। যাহা হউক, গান্ধীজী মহারাজের মুসলমানদের সম্মেলনে আগমনে তাঁহাকে মুসলমানরা যে সাদর সম্বর্ধনা জানাইয়াছিল, উহা বর্ণনা দিতে গিয়া মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক লিখেন:-

“অবশেষে গান্ধীজি উঠিলেন ও সম্মেলনে যোগদান করার জন্য রওনা হইলেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা ভীরের মধ্যে তাঁহার জন্য পথ করিয়া দিল। গান্ধীজি যখন সম্মেলন ময়দানে পৌঁছিলেন তখন আবেগ ও উত্তেজনা সীমা রহিল না। প্রথমে অন্যান্য নেতাগণ বক্তৃতা করিলেন। অতঃপর গান্ধীজি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করিলেন এবং মৌলানা জাফর আলী খানের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করিতে গিয়া এমন কথা বলিলেন, যাহা বন্ধু বান্ধবদের মাহফিলে দীর্ঘদিন যাবৎ একটি হাসির বস্তু হইয়া রহিয়াছিল (এই কথাটি আমি বাদ দিয়া যাইতেছি)। কয়েক সপ্তাহ পরে গান্ধীজি পুনরায় আগমন করিলেন। এইবার তাঁহার সঙ্গে নেতৃবৃন্দের সম্পূর্ণ দলটিই ছিল ... ...। শিখেরা মৌলানা আবুল কালামের হস্ত চুম্বন করিতেছিল, হিন্দুরা মৌলানা মোহাম্মদ আলীর চরণ ধূলা নিজেদের চোখে মুখে মাখিতে ছিল। এবং মুসলমানেরা গান্ধীজীকে এইভাবে সাদর সম্বর্ধনা জানাইতেছিল যেন কোন ‘ওলি আল্লাহ’ লাহোরকে তাঁহার পদধূলী দিয়া সম্মানিত করিল।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১২৪–১২৫)
৯। মুসলমানগণের আবেগ উচ্ছাসের অবস্থা

এই ব্যাপারটি মুসলমানদের হৃদয়ে যে আবেগ ও উচ্ছাস সৃষ্টি করিয়া দিয়াছিল উহার পরিণাম খুবই ভয়াবহ ছিল। এই অজ্ঞতাপূর্ণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অপরাধে আহমদীয়া জামা’তকে সমগ্র ভারতবর্ষে কঠোর শাস্তি দেওয়া হইতেছিল। মুসলমানদের আবেগ উচ্ছাসের যে অবস্থা ছিল, উহার চিত্র মৌলানা সালেক সাহেব এইরূপ ভাষায় অঙ্কিত করিয়াছেন:-

“সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এই অনুভূতি ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িল যে, এখন ভারতবর্ষ হইতে হিজরত করা ব্যতীত অন্য কোন পথ নাই। কাজেই স্বাধীন এলাকা এবং আফগানিস্থানে চলিয়া যাওয়া এবং সেখানে থাকিয়া ঐ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ কর, যাহা তোমাদিগকে ইংরেজদের উপর বিজয় দান করিবে এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন করিবে। আমীর আমান উল্লাহ খানও ঐ সময় তাঁহার বিভিন্ন বক্তৃতায় বলিতেছিলেন যে, তোমরা চলিয়া আস, আমি তোমাদিগকে আশ্রয় দান করিব।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১১৫)
১০। শরীয়তের অবমাননার জন্য আহমদীয়াত জামা’তের ইমামের কঠোর প্রতিবাদ

উহা কোন্ আওয়াজ ছিল, যাহা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হইয়াছিল এবং মুসলমানদের চোখ খুলিয়া দেওয়ার জন্য চেষ্টা করিয়াছিল এবং খুব স্পষ্টভাবে বার বার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করিয়া বলিয়াছিল যে, অসহযোগ আন্দোলন সব দিক হইতে ক্ষতিকর এবং অতঃপর মুসলমানদিগকে সতর্ক করিয়াছিল যে ইসলামী শরীয়তে নাম ইহাতে ব্যবহার করিও না। ইহাতে ইসলামেরও অবমাননা হয় এবং রাসূলে ইসলামেরও (সাঃ) ভয়ঙ্কর অবমাননা হয়। যদি রাজনৈতিক দিক হইতে ইহা ক্ষতিকর নাও হয়, তথাপি এই অবমাননার দরুন তেমরা অবশ্যই শাস্তি ভোগ করিবে। অতএব, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণে যে অস্ত্রই চাহ ব্যবহার কর, আমি তোমাদিগকে নিশ্চিতভাবে সত্য কথা বলিয়াই ছাড়িব। কেননা মুসলমানদের জন্য আমার সত্যিকার দরদ রহিয়াছে। অসহযোগ আন্দোলনে বার বার শরীয়ত শব্দটি ব্যবহার করা হইতেছিল এবং মুসলমানদিগকে এই কথা বলা হইতেছিল যে, ইহা শরীয়তী ফত্‌ওয়া। এই জন্য হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী রাঃ (ইনি আহমদীয়া জামা’তের দ্বিতীয় খলীফা - অনুবাদক) এই উপলক্ষে মুসলমানদিগকে সম্বোধন করিয়া বলেন:-

“মিষ্টার গান্ধীর কথাকে কেন কুরআন করীম সাব্যস্ত করা হইতেছে? ইহার নাম কেন শরীয়ত রাখা হইতেছে? বরং লোকদিগের এই কথা বল যে, যেহেতু মিষ্টার গান্ধী এইভাবে বলেন সেহেতু তোমাদিগকে এইভাবেই কাজ করিতে হইবে। এই কথা কেন বল যে, ইহা ইসলামী শরীয়তের ফত্‌ওয়া।” তিনি আরো বলেন:-

“তোমরা কি দেখিতে পাইতেছ না যে, তোমরা একটি সঠিক পথ ত্যাগ করিয়া কোথায় ঠোকর খাইয়া ফিরিতেছ? প্রথমতঃ সকল আলেম ফাযেলকে বাদ দিয়া একজন অমুসলমানকে তোমরা নেতা বানাইয়াছ। ইসলাম কি এখন এত নীচে নামিয়া গিয়াছে যে, ইহার মান্যকারীদের মধ্যে এইরূপ একজন যোগ্য ব্যক্তিও আর নাই, যিনি এই বঞ্চা-বিক্ষুব্ধ সময়ে এই নৌকাকে ঘূর্ণিপাক হইতে বাহির করিয়া ইহাকে সফলতার তীরে পৌঁছাইতে পারেন? আল্লাহ্‌তায়ালার মধ্যে কি স্বীয় ধর্মের জন্য এতখানি আত্মাভিমানও আর নাই যে, তিনি এমন বিপদের সময় এইরূপ কোন ব্যক্তি সৃষ্টি করিয়া দিবেন, যিনি মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শিষ্য এবং তাঁহার (সাঃ) দাসদের মধ্য হইতে হইবেন এবং যিনি এখন মুসলমানদিগকে ঐ রাস্তায় চালাইবেন, যাহা তাহাদিগকে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিবে? হায়! তোমাদের ধৃষ্টতা কোন্ পর্যায়ে গিয়া পৌঁছিয়াছে। পূর্বেতো তোমরা মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে মসীহ নাসেরীর (অর্থাৎ হযরত ঈসা আঃ-এর - অনুবাদক) অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিতে এখন তোমরা তাঁহাকে (সাঃ) মিষ্টার গান্ধীর অনুগ্রহের ঋণে আবদ্ধ করিতেছ।” তিনি আরো বলেন:-

“হযরত মসীহ নাসেরী (আঃ) তো, যাহা হউক, একজন নবী ছিলেন। এখন যে ব্যাক্তিকে তোমরা নিজেদের ধর্মীয় নেতা বানাইয়াছ তিনিতো একজন মুমিনও নন। অতএব মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই অবমাননার ফল পূর্বের চাইতেও অধিক কঠোর রূপে তোমরা প্রকাশিত হইতে দেখিবে। যদি তোমরা বিরত না হও, তাহা হইলে এই অপরাধে তোমাদিগকে মিষ্টার গান্ধীজির জাতির গোলামী ইহার চাইতে অধিক করিতে হইবে, যতখানি গোলামী তোমরা বল যে, তোমাদিগকে হযরত মসীহ আলাইহেস সালামের উম্মতের করিতে হইয়াছে।” (পূর্ব সূত্র, পৃষ্ঠা ৮৫–৮৬)
১১। সঠিক পথ প্রদর্শনকারী শাস্তির যোগ্য সাব্যস্ত হইয়াছিল

নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক, ইহা হইল ইসলাম ও মাতৃভূমির বিশ্বাসঘাতক আহমদীয়া জামা’তের নেতৃত্বের ভূমিকা। ইহা হইল আহমদীদের নেতার ভূমিকা। ইহার বিপরীত যে সকল লোক ইসলাম ও মাতৃভূমির জন্য সহানুভূতিশীল সাজিয়া বসিয়াছিল, তাহাদের ভূমিকা ইতিপূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু অধিককাল পর্যন্ত মুসলমানদের এই স্বপ্ন টিকিয়া থাকা সম্ভব হইল না। হিজরত সম্পন্ন হইল। হাজার হাজার সরলপ্রাণ মুসলমান নিজের সারা জীবনের পুঁজি খোয়াইয়া ভারতবর্ষ হইতে হিজরত করিল। তাহারা নিজেদের সহায় সম্পত্তি নিজেদের হাতে তাহাদের হিন্দু ভাইদের নিকট সোপর্দ করিয়া গেল। তাহারা মসজিদগুলি বিরান করিয়া গেল, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়িয়া দিল এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়া দিল। এইরূপ বেদনাদায়ক পরিস্থিতি দেখা দিল যে, যাহারা বলিত ‘তোমরা ছাড়া আমরা এখানে থাকিয়া কি করিব’ ঐ সময় তাহাদের তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-কলাপ এইভাবে প্রকাশিত হইল যে, একজন মুসলমান চাকুরীতে ইস্তফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত শূন্যপদ পুরণের আবেদনে দশজন হিন্দুর দরখাস্ত আসিয়া পৌঁছিত। কোন একজন হিন্দুও মুসলমানের সহিত হিজরত করে নাই। ইহার বিপরীত যে ব্যক্তি তাহাদিগকে সঠিক পথ দেখাইতেছিলেন এবং মুসলমানদের জন্য সত্যিকার দরদ প্রদর্শন করিতেছিলেন, তাঁহাকে এবং তাঁহার অনুসারীদিগকে মুসলমানদের তরফ হইতে কঠোর শাস্তি দেওয়া হইতেছিল।
১২। আন্দোলনের ব্যর্থতায় আক্ষেপ প্রকাশ

ইহা ছিল ঐ সকল আলেমের আন্দোলন এবং তাহাদের নেতৃত্বের ফল, যাহারা একই অসদুদ্দেশ্য লইয়া আজ পাকিস্তানকে কব্জা করিয়া বসিয়াছে। যাহা হউক মুসলমানদের চৈতন্য তো আসিল, কিন্তু তাহা বড়ই বিলম্বে আসিল। বস্তুতঃ ঐ সময় মৌলানা আবুল কালাম আযাদ অসহযোগ আন্দোলনে একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। কংগ্রেসী আলেমদের মধ্যে তাঁহার একটি অতি উচ্চ মর্যাদা ছিল এবং তাঁহার সহিত আহরারী মৌলবীদের একটি গভীর যোগাযোগ ছিল। এই মৌলানা সাহেবই (অর্থাৎ মৌলানা আবুল কালাম আযাদ-অনুবাদক) লিখেন:-

“তড়িৎকর্মা ব্যক্তিদের জন্য সংকট মুহূর্ত রোজ আসে না। কিন্তু যখন আসে তখন ঐ সময়েই তাহাদের প্রকৃত পরীক্ষা হয়। এইরূপ একটি মুহূর্তই আসিয়াছিল যখন কিনা প্রথম দিকে খেলাফত আন্দোলনের সংবাদ আমাদের মস্তিষ্ককে নাড়া দিয়াছিল। ইহাই এই ব্যাপারে পরীক্ষার সময় ছিল যে, আমাদের মেধার কর্মশক্তি কতটুকু সৃষ্টি হইয়াছে? কতটুকু আমরা এই বিষয়টি সম্বন্ধে চিন্তা করিয়াছি এবং উপলব্ধি করিয়াছি এবং ইহার গুরুত্ব অনুধাবন করিতে শিখিয়াছি? কতটুকু আমাদের মধ্যে এই শক্তি সৃষ্টি হইয়াছে যে, বন্ধুদের ভুল এবং শত্রুদের হাসি বিদ্রূপে ফাঁসিয়া গিয়া সঠিক কর্মসূচী হইতে বিচ্যুত না হই। আমাদের মধ্যে যাহারা চিন্তাশীল ও কর্মতৎপর ছিলেন, তাহাদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল এবং হৃদয় ও জিহ্বায় লাগাম কষিয়া দেওয়া উচিত ছিল।“ (‘তবর্‌রাকাতে আজাদ’ মুদ্রাকর গোলাম রসুল মেহের, পৃষ্ঠা ২৩৮)

অতঃপর আরো সম্মুখে অগ্রসর হইয়া তিনি বড়ই আক্ষেপের সঙ্গে বলেন:-

“কিন্তু তাড়াহুড়া ও লাগামহীনতার দরুন বিপজ্জনক ও প্রতিকারবিহীন আঘাত আসিতে পারে। এই ব্যাপারে এক ফরাসী প্রবাদ বাক্য আছে। প্রবাদ বাক্যটি হইল এই যে, গুলী ছোঁড়া হইয়াছে তাহা অর্ধপথ হইতে ফিরিয়া আসিবে না, উহা ফিরানোর জন্য শত ডাকাডাকিই কর না কেন।” আক্ষেপের সহিত বলিতে হয় যে, গুলী ছোঁড়া হইয়াছে এবং পরীক্ষার ফলের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য কোন মোবারকবাদ নাই।“(পূর্ব সূত্র)
১৩। ভাবাবেগপূর্ণ আন্দোলনের লজ্জাস্কর পরিণতি

‘মুসলমানানে হিন্দ কি হায়াতে সিয়াসি’ (ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবন) নামে একটি পুস্তক আছে। উহাতে মোহাম্মদ মির্যা দেহলবী সাহেব এই আন্দোলনের ব্যর্থতায় আক্ষেপ করিয়া লিখেন:-

‘ইহা হিন্দুদের প্রোগ্রাম ছিল’ ... ... (বিগতকালে যখন আহমদীয়া জামা’ত তোমাদিগকে এই কথা বলিতেছিল যে ইহা হিন্দুদের প্রোগ্রাম, তখনতো তোমরা জামা’তের ইমামকে নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক, শ্রেষ্ঠ বিশ্বাসঘাতক বলিতেছিলে। এ সময়তো তোমরা এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলে না। ঐ সময়তো সত্য কথা বলার দরুন মযলুম আহমদীদিগকে শাস্তি দেওয়া হইতেছিল। কিন্তু ঐ তুফান যখন অতিক্রম করিয়া গেল তখন তোমরাই এই কথা লিখিতে আরম্ভ করিলে যে, ইহা হিন্দুদের প্রোগ্রাম ছিল - গ্রন্থকার)।

“হিন্দুরাই ইহার নেতৃত্ব দিয়াছিল। এই আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকা হিন্দুদের ক্রীড়নক ও হাতিয়ার হওয়ার চাইতে অধিক কিছু ছিল না। তাহারা ঐ সময় পর্যন্ত মুসলমানদিগকে কাজে লাগাইয়াছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত তাহাদের প্রয়োজন ছিল এবং ঐ সময় আন্দোলন বন্ধ করিয়া দিল যখন তাহাদের প্রয়োজন ফুরাইয়া গেল।”

মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক তাঁহার পুস্তক ‘সের গুজাস্ত’ - আন্দোলনের পরিণতি এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেন:-

“মানবীয় ভাবাবেগ এক অদ্ভুত বস্তু। এই নিষ্ঠাবান ও আবেগপ্রবণ মুসলমানরা কতই না আবেগ-উচ্ছাসের সহিত একটি ধর্মীয় নির্দেশ আমল করিতে গিয়া নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করিতেছিল। কিন্তু কয়েক মাস পরে যখন আমীর আমানুল্লাহ খানের সরকার এই বীর বাহিনীকে আফগানিস্তানে পুনর্বাসিত করিতে অপারগ হইয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিল তখন মুহাজিরের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ভগ্ন হৃদয়ে চোখের পানি ফেলিতে ফেলিতে ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিল। অতএব, একটি তাৎক্ষণিক আবেগের উপর ভিত্তি করিয়া যে আন্দোলনটি আরম্ভ হইয়াছিল, উহার পরিণতি হইল অত্যন্ত লজ্জাস্কর।” (সের গুজাস্ত, পৃষ্ঠা ১১৬)
১৪। শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করিতে মুসলমানগণ অসমর্থ

অতএব মুসলমানদের এই অদ্ভুত অবস্থা যে, কংগ্রেসী মোল্লাদের দ্বারা বার বার পরাস্ত হইয়াও তাহারা শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করিতে সমর্থ হয় না। আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে এই সকল মোল্লাদের তরফ হইতে বার বার মিথ্যা কথা বলা হইতেছে এবং প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আহমদীয়া জামা’তের খেদমত, জামা’তের প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সময়োচিত নেতৃত্ব এবং জামা’তের বন্ধুত্বের হাত হইতে এই মোল্লারা মুসলিম জনসাধারণকে সদাসর্বদা বঞ্চিত করার জন্য চেষ্টা করিয়া আসিছে। বস্তুতঃ খেলাফত আন্দোলনেরও ঐ পরিণতিই হইয়াছিল যে, ব্যাপারে আহমদীয়া জামা’ত তাহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল। যেমন আমি বর্ণনা করিয়াছি এই সকল আলেমের মিথ্যা আশ্বাসবাণীপ্রাপ্ত কাফেলা ভারতবর্ষ হইতে এইরূপ অবস্থায় যাত্রা করিল যে, তাহারা সারা জীবনের উপার্জন বিসর্জন দিল, বিষয়সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় করিয়া দিল, বা হিন্দুদের নিকট এইভাবে আমানতস্বরূপ রাখিল, যাহা তাহারা আর কখনো ফিরিয়া পায় নাই। তাহারা যে পাথেয় সঙ্গে লইয়া আফগানিস্তানে রওয়ানা হইয়াছিল, উহার সম্বন্ধে ইতিহাসবিদগণ লিখেন যে, আফগানিস্তান হইতে তাহাদের প্রত্যাবর্তন করার সময় আফগান গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন জায়গায় তাহাদের উপর অতর্কিত হামলা করিয়া তাহাদের নিকট যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাহাও লুট-তরাজ করিয়া লইল। তাহাদের মধ্যে ভয়ানক ব্যাধি বিস্তার লাভ করিল। কিছু লোক অনাহারে মারা গেল। কিছু লোক নিজেদের মালপত্র রক্ষা করিতে গিয়া মারা গেল। অবশেষে অশেষ বেদনাদায়ক অবস্থায় মুসলমানদের কাফেলা ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিল। তাহাদের মধ্যে এইরূপ লোকও ছিল, যাহারা স্বদেশে বড়ই সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন যাপন করিতেছিল। কিন্তু তাহারা মলিন ও ছিন্ন বস্ত্রে এমন অবস্থায় ফিরিয়া আসিল যে তাহাদের জীবিকা অর্জনের আর কোন পথও রহিল না।

ইহা ছিল মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল আলেম সমাজ (?) যাহাদের এই পরামর্শ ছিল এবং পরামর্শের পরিণাম এইরূপ। নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক, অপর পক্ষে ইসলাম ও মাতৃভূমির “বিশ্বাসঘাতক” (?) আহমদীয়া জামা’তের সম্মানিত লোকেরা তাহাদিগকে আন্তরিক সদুপদেশ ও সহানুভূতিপূর্ণ যে পরামর্শ দিয়াছিল উহাকে উপেক্ষা করিয়া মুসলমানেরা লজ্জাস্কর পরিণতি ভোগ করিল। আজও মিথ্যাচার ও ধোকাবাজীর ঐ একই আওয়াজ পাকিস্তানে উত্থিত হইতেছে, যাহা বিগত দিনে অসহযোগ আন্দোলনের আকারে ধ্বনিত হইয়াছিল এবং নিতান্ত লজ্জাস্কর পরিণতিতে পৌঁছিয়া যাহার অবসান হইয়াছিল।
১৫। শুদ্ধি আন্দোলন ও উহার পটভূমি

এখন আমি শুদ্ধি আন্দোলন সম্বন্ধে কিছু বলিতেছি। যখন ভারতবর্ষে শুদ্ধি আন্দোলনের দরুন ইসলামের উপর মারাত্মক বিপদ আপতিত হইয়াছিল তখন আহমদীয়া জামা’তের ভূমিকা কি ছিল এবং আহরারী মোল্লাদের ভূমিকা কি ছিল, যাহাদিগকে দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ পাকিস্তানে বিজয়ীর মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে। শুদ্ধি আন্দোলন প্রতিপন্ন করিয়া দিয়াছিল, কাহারা ইসলামের প্রতি প্রকৃত সহানুভূতিশীল এবং কাহারা মিথ্যাবাদী ছিল, কাহারা ইসলামের প্রতি মায়ের মত দরদ রাখিত এবং কাহারা কূটনীবুড়ীর মত কথা বানাইয়া বলিতেছিল। শুদ্ধি আন্দোলন কি ছিল? ইহা ছিল এই যে-ভারতবর্ষের এইরূপ একটি এলাকা, যাহা আগ্রা অঞ্চলে মালকানা নামে কথিত। সেখানে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে এবং ইহার কিছুকাল পূর্বে ও পরে হিন্দুরা এই আন্দোলন শুরু করিল যে, যেহেতু এখানকার সকল মুসলমান পূর্বে হিন্দু ছিল, কাজেই তাহাদিগকে স্বধর্মে ফিরাইয়া আনিতে হইবে। এই আন্দোলনটি সঙ্গোপনে অনেক দিন যাবৎ চলিতেছিল এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত মুসলমানেরা ইহার কোন খবরই জানিত না। যখন ইহার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রথম বারের মত ছাপানো হইল এবং কোন কোন গরীব মুসলমানের পক্ষ হইতে দেওবন্দ ও দারুন নদ্‌ওয়াকে (লক্ষ্ণৌ) সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান হইল, তখন একটি হৈ চৈ আরম্ভ হইয়া গেল এবং সর্বত্র রব উঠিয়া গেল যে, হিন্দুদের এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে হইবে এবং মুসলমানদিগকে ইসলামে কায়েম রাখার জন্য একটি জিহাদ শুরু করিয়া দিতে হইবে। ফলে তখন কাদিয়ানে উহার প্রতিক্রিয়ায় যে ব্যবস্থা নেওয়া হইয়াছিল, উহা ছিল এক মহান কার্যক্রম। কাদিয়ানে আহমদীয়া জামা’তের পক্ষ হইতে এইরূপ একটি মজবুত ও শক্তিশালী আন্দোলন শুরু করিয়া দেওয়া হইল যে, শুদ্ধি আন্দোলনের গতিই পালটাইয়া গেল এবং হিন্দুদের নতজানু হইতে বাধ্য করিল।

এই ব্যাপারে অন্যান্যদের দ্বারা যে সকল আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল, বিশেষভাবে শুদ্ধির নামে আহরাররা যে আন্দোলন চালাইয়াছিল, উহার কি পরিণতি হইয়াছিল এবং আহরাররা এই আন্দোলনে কি কীর্তি প্রদর্শন করিয়াছিল, এই বিষয়ে অ-আহমদী মুসলমান এবং হিন্দুদের পত্র- পত্রিকার উদ্ধৃতির আলোকে উহার বিবরণ দিতে চাই।
১৬। হিন্দুদের উদ্দেশ্য ও মতলব

আহমদীয়া জামা’ত ও তাহাদিগের বিরুদ্ধবাদীদের ভূমিকা সম্বন্ধে বলার পূর্বে আমি হিন্দুদের উদ্দেশ্য ও মতলব তাহাদের নিজেদের ভাষায় বর্ণনা করা জরুরী মনে করি। কার্যতঃ দিল্লী হইতে প্রকাশিত হিন্দুদের একটি খ্যাতনামা পত্রিকা “তেজ” বড়ই দৃঢ়তার সহিত এই কথা ঘোষণা করিয়াছিল যেঃ-

“হিন্দু-মুসলিম ঐক্য শুদ্ধি ব্যতীত হইতে পারে না।”

অর্থাৎ তাহারা বলিতেছে, হিন্দু-মুসলিম একতা কিভাবে কার্যকর করা সম্ভব? ইহার জন্য একটি পথই খোলা আছে এবং তাহা হইল এই যে, সকল মুসলমানকে হিন্দু হইয়া যাইতে হইবে। একতার জন্য ইহার চাইতে উত্তম আর কোন পথ নাই - গ্রন্থকার।

“যখন সকল মুসলমান শুদ্ধ (পবিত্র) হইয়া হিন্দু হইয়া যাইবে, তখন চতুর্দিকে কেবল হিন্দু আর হিন্দুই দৃষ্টিগোচর হইবে। (ইহা একটি সম্মেলনের রিপোর্ট এবং পত্রিকায় লেখা হইয়াছে যে, এই সময় খুব তালি বাজান হইয়াছিল) তখন পৃথিবীর কোন শক্তি তাহাদিগকে স্বাধীনতা লাভের পথে বাধা দিতে পারিবে না। শুদ্ধির জন্য যদি আমাদিগকে কঠিন হইতে কঠিনতর বিপদের সম্মুখীন হইতে হয়, তবুও এই আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে।” (দৈনিক তেজ, দিল্লী, ২০শে মার্চ, ১৯২৩ খৃঃ)

অতঃপর “প্রতাপ” নামক পত্রিকা নিম্নোক্ত সংবাদ পরিবেশন করিতেছে:-

“আগ্রার পার্শ্ববর্তী এলাকায় রাজপুতদিগকে দ্রুতগতিতে শুদ্ধ করা হইতেছে। এ যাবৎ চল্লিশ হাজার তিনশত মুসলমান রাজপুত মালকানি, গুজরাটি এবং জাঠ হিন্দু হইয়া গিয়াছে। এইরূপ লোক ভারতবর্ষের সর্বত্র দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাট লক্ষের কম নহে। হিন্দু সমাজ যদি ইহাদিগকে নিজেদের মধ্যে আত্মীকরণের কাজ চালু রাখে, তাহা হইলে ইহাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নাই যে ইহাদের সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছিয়া যাইবে।
১৭। সঙ্কটময় মুহূর্তে আহমদীয়া জামা’তের ইমামের ঘোষণা

ইসলামের উপর এই ভয়াবহ হামলাটিই করা হইয়াছিল। ঐ সময় কাহাদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগিয়াছিল এবং তাহারা কে ছিল, যাহারা নিজেদের যথাসর্বস্ব মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পথে কুরবান করিয়া দিয়া জিহাদের ময়দানে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল? তাহারা কি আহরার ও তাহাদের দোসররা ছিল, নাকি তাহারা আহমদীয়া জামা’তের সদস্য ছিল? আসুন, আমরা ইতিহাসের দর্পণে দেখি যে, এই উপমহাদেশে মুসলমানদের ঐ সঙ্কটময় ঐতিহাসিক মুহূর্তে ইসলামের প্রতিনিধিত্বের কর্তব্য কাহারা সম্পাদন করিয়াছিল। ঐ সময় যখন হিন্দুরা একটি এলাকায় মুসলমানদিগকে হিন্দু বানানোর বাজার গরম করিয়া রাখিয়াছিল, তখন কাদিয়ান হইতেই উহার বিরুদ্ধে উচ্চকিত আওয়ায উত্থিত হইয়াছিল। হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) (ইনি বিশ্ব আহমদীয়া জামা’তের তদানীন্তন খলীফা ছিলেন - অনুবাদক) ৯ই মার্চ, ১৯২৩ সালে এই ঘোষণা করেন:-

“এই সময় জরুরী ভিত্তিতে আমাদের দেড় শত লোকের প্রয়োজন যাহারা এই এলাকায় কাজ করিবে। এই দেড় শত লোকের প্রত্যেককে আপাততঃ তিন মাসের জন্য জীবন উৎসর্গ করিতে হইবে। আমরা তাহাদিগকে খরচ করার জন্য এক পয়সাও দেব না। তাহাদের নিজেদের ও নিজ পরিবারবর্গের ব্যয় তাহাদের নিজদিগকেই বহন করিতে হইবে। যাহারা চাকুরীরত আছে, তাহারা নিজেদের ছুটির ব্যবস্থা নিজেরাই করিবে এবং যাহারা চাকুরীজীবি নয় বরং নিজেদের ব্যক্তিগত পেশায় নিয়োজিত আছে, তাহারা উহা হইতে ফুরসত বাহির করিবে এবং আমাদের নিকট আবেদন পত্রে উল্লেখ করিবে যে, তাহার চারটি ত্রৈমাসের মধ্যে কোন্ তিন মাস কাজ করিতে প্রস্তুত আছে?

অর্থাৎ কমপক্ষে এক বৎসরের প্রোগ্রাম জরুরী ভিত্তিতে আরম্ভ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সুতরাং প্রথম তিন মাসের জন্য দেড় শত ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল। অতঃপর পরবর্তী তিন মাসের জন্য আরো দেড় শত ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল। বস্তুতঃ হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) বলেন:-

“এই পরিকল্পনার অধীনে যাহারা কাজ করিবে, তাহাদের প্রত্যেককে নিজের কাজ নিজেকেই করিতে হইবে। যদি তাহাদের নিজেদের রান্না করিতে হয়, তাহা হইলে তাহারা তাহাও করিবে। যদি তাহাদেরকে জঙ্গলে ঘুমাইতে হয়, তাহা হইলে তাহারা জঙ্গলেই ঘুমাবেন। যাহারা এই পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছে, তাহারা আসুক। তাহাদের নিজেদের ইজ্জত ও ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণা বিসর্জন দিতে হইবে।” (আল্‌ ফযল, ১৫ই মার্চ, ১৯২৩ খৃঃ)
১৮। ইমামের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত ‘লাব্বায়েক’ (আমি উপস্থিত)

আহমদীয়া জামা’ত নিজেদের ইমামের আহ্বানে যে স্বতঃস্ফূর্ত লাব্বায়েক বলিয়াছিল, উহা এইরূপ আশ্চর্যজনক যে, কুরবানকারী জামা’ত ও জাতিসমূহের মধ্যে চিরকালের জন্য ইহা স্মরণীয় হইয়া থাকিবে এবং আহমদীয়া জামা’তের ইতিহাসে ইহা এইরূপ একটি ঘটনা, যাহা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। কি বৃদ্ধ-কি যুবক, কি পুরুষ-কি নারী, কি শিশু-কি বালক, কি ধনী-কি গরীব, বস্তুতঃ সকলেই এই পথে এইরূপ মহান কুরবানী পেশ করিয়াছিল যে, এই সকল ঘটনাবলী সম্বন্ধে শত শত পৃষ্ঠাব্যাপী একটি গ্রন্থ রচনা করা যাইতে পারে। দীর্ঘ সময় লাগিয়া যাওয়ার আশঙ্কায় আমি কেবলমাত্র দুই-তিনটি ঘটনা নমুনা-স্বরূপ উপস্থাপন করিয়া ক্ষান্ত হইব:-

একজন আহমদী মহিলা লিখেন যে, “হুযূর আমি কেবলমাত্র কুরআন মজীদ পড়তে পারি ও সামান্য উর্দু জানি। আমি আমার পুত্রের নিকট শুনিয়াছি যে, মুসলমানেরা ধর্মত্যাগী হইতেছে এবং হুযূর সেখানে যাওয়ার জন্য আদেশ দান করিয়াছেন। আমাকেও যদি আদেশ দান করা হয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমি প্রস্তুত হইয়া যাইব এবং মোটেই বিলম্ব করিব না। খোদার কসম খাইয়া বলিতেছি যে, আমি সর্বপ্রকারের কষ্ট স্বীকার করিতে প্রস্তুত রহিয়াছি।” ছোট ছোট মেয়েরা, যাহাদের অন্য কিছু ছিল না, তাহারা নিজেদের কানফুলও খুলিয়া পেশ করিল, দরিদ্র স্ত্রীলোকেরা, যাহাদের জীবিকার উপায় ছিল একটি মাত্র ছাগল, তাহারা ছাগল আনিয়া হাজির করিল। ঐ সকল বৃদ্ধা স্ত্রীলোক, যাহারা আহমদীয়া জামা’তের বৃত্তির উপর জীবিকা নির্বাহ করিত এবং উক্ত বৃত্তির অর্থ হইতে টাকা বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল (ঐ যুগে দুই টাকা মস্ত ব্যাপার ছিল) এবং দীর্ঘ সময়ে এই দুই টাকা জমাইয়াছিল, তাহারা হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ)-এর নিকট এই দুই টাকা পেশ করিতে আসিয়া বলিল যে, আমার মাথায় যে দোপাট্টা রহিয়াছে তাহাও জামা’তের দেওয়া, আমার এই কাপড়ও জামা’তের বৃত্তি হইতে ক্রয় করিয়াছি, আমার জুতাও জামা’ত দিয়াছে, আমার নিজের বলিতে কিছুই নাই, আমি কি পেশ করিব? হুযুর আমার নিকট মাত্র দুই টাকা আছে। জামা’তের বৃত্তির অর্থ হইতে আমি নিজের কোন প্রয়োজনের জন্য ইহা জমা করিয়াছিলাম। আমি ইহা পেশ করিতেছি, যাহাতে কোন না কোন ভাবে অত্যাচারী শুদ্ধি আন্দোলনের গতি পরিবর্তিত হইয়া যায়।" (কারযারে শুদ্ধি, পৃষ্ঠা ৪৬)
১৯। দৃষ্টান্তবিহীন কুরবানীর দৃশ্য

ইহাই ছিল কুরবানীর আবেগ, যাহার প্রকাশ আহমদীয়া জামা’ত ঘটাইয়াছে। শুদ্ধি আন্দোলনের বিরুদ্ধে উত্থিত জনরবে জামা’ত যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণে সব কিছু কুরবান করার জন্য প্রস্তুত হইয়া গেল। যেমন একজন বাঙ্গালী বন্ধু হুযুরের খেদমতে চিঠি লিখেন। তাঁহার নাম ছিল কারী নঈমুদ্দিন সাহেব। তিনি একজন বৃদ্ধ পিতা হিসাবে হুযুরের নিকট আবেদন করেন:-

“যদিও বি, এ, ক্লাশের ছাত্র আমার পুত্র মৌলবী যিল্লুর রহমান সাহেব এবং মতিয়ুর রহমান সাহেব আমাকে বলে নাই, তথাপি আমি অনুমান করিতেছি যে, রাজস্থানে যাইয়া তবলীগ করার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার জন্য হুযূর গতকাল যে ঘোষণা করিয়াছেন এবং যে অবস্থায় সেখানে থাকার শর্তাবলী আরোপ করিয়াছেন, তাহাতে তাহাদের হৃদয়ে সম্ভবতঃ এই কথা উদয় হইয়া থাকিবে যে, যদি তাহারা নিজদিগকে স্বেচ্ছায় হুযুরের নিকট পেশ করে তাহা হইলে তাহাদের বৃদ্ধ পিতা হিসাবে আমি কষ্ট পাইব। কিন্তু আমি হুযুরের সম্মুখে খোদাতায়ালাকে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি যে, তাহাদের যাওয়া ও কষ্ট স্বীকার করার ব্যাপারে আমার মধ্যে সামান্য দুঃখ বা ব্যথার সঞ্চারও হইবে না। আমি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলিতেছি যে, যদি তাহারা দুই ভাই খোদার রাস্তায় কাজ করিতে গিয়া মারাও যায়, তবুও ইহাতে আমি এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করিব না। বরং আমি খোদাতায়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব। আমার পুত্র কেবলমাত্র দুই জনই নয়। আমার তৃতীয় পুত্র মাহবুবুর রহমান রহিয়াছে। যদি ইসলামের সেবা করিতে গিয়া সেও মারা যায় এবং যদি আমার দশটি পুত্র থাকিত তাহারাও যদি মারা যাইত, তবুও আমি দুঃখ করিতাম না। সম্ভবতঃ কাহারো কাহারো এইরূপ ধারণা হইতে পারে যে, পুত্রদের কষ্টে আনন্দিত হওয়া কোন তাজ্জব ব্যাপার নয়, কেননা কোন কোন লোকের এইরূপ মানসিক অস্থিরতা থাকে যে, তাহারা নিজেদের আপনজনের মৃত্যুতেও হাসিতে থাকে। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রত্যয়ের সহিত বলিতেছি যে, যদি আমিও খোদার রাস্তায় মারা যাই, তাহা হইলে ইহা আমার জন্য প্রকৃত আনন্দের কারণ হইবে।” (আল-ফযল, ১৫ই মার্চ, ১৯২৩ খৃঃ)
২০। স্বভাব ও প্রকৃতরূপ কখনো বদলায় না

ইহারা (অর্থাৎ আহমদীরা - অনুবাদক) ছিল ইসলাম ও মাতৃভূমির “বিশ্বাসঘাতক” যাহারা বিগত দিনেও এই ধরনের “বিশ্বাসঘাতক” ছিল এবং আজও এই ধ্বনের “বিশ্বাসঘাতক”-ই রহিয়াছে। তাহাদের স্বভাব বদলায় নাই। তোমাদের তলোয়ার তাহাদের স্বভাব বদলাইতে পারে না, তোমাদের বর্শা তাহাদের স্বভাব বদলাইতে পারে না এবং তোমাদের তীক্ষ্ণ-ধার ভাষা যাহা দিনরাত আহমদীদের হৃদয়ে ছুরির মত বিধিতেছে, উহাও তাহাদের স্বভাব বদলাইতে পারে না। যে ধরনের “বিশ্বাসঘাতকতা” আমরা বিগত দিনে করিতেছিলাম আজও আমরা ঐ একই ধরনের “বিশ্বাসঘাতকতা” করিব এবং তোমরা বিগত দিনে যে ধরনের “ইসলামের সেবা” করিতেছিলে, আজও তোমরা ঐরূপ “সেবাই” করিতেছ। এই দুইয়ের আচরণের কোন পার্থক্য ঘটেনাই।
২১। আহমদীরা শুদ্ধি আন্দোলনের মোড় ফিরাইয়া দিল

প্রশ্ন হইল এই যে, এই ধর্মীয় যুদ্ধ কি ছিল এবং এই যুদ্ধ কাহাদের পক্ষ হইতে হিন্দু জাতির জন্য বিপদ রূপে দেখা দিয়াছিল এবং কাহারা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত শুদ্ধি আন্দোলনের মোড় ফিরাইয়া দিয়াছিল এই ব্যাপারে তাহাদের মুখ হইতে শুনুন, যাহাদের উপর আঘাত হানা হইতেছিল। হিন্দুদের নামকরা পত্রিকা “তেজ”, দিল্লী, যাহা গতকালও বড় বড় ঘোষণা করিতেছিল যে, কিভাবে হিন্দুরা শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে পঞ্চাশ ষাট লক্ষের পরিবর্তে এক কোটি মুসলমানকে হিন্দু বানাইয়া ফেলিবে, উক্ত পত্রিকা এই কথা লিখিতে বাধ্য হইল:-

“বেদ হইল ঐশী বাণী এবং সর্ব প্রথম ঐশী ধর্মগ্রন্থ এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান। কাদিয়ানীরা বলে যে, কুরআন শরীফ খোদার বাণী এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হইলেন খাতামান্নাবীঈন। তাহাদের কঠোর পরিশ্রমের এই ফল দাঁড়াইল যে, কোন খৃষ্টান বা মুসলমান এখন ধর্মের খাতিরে আর্য সমাজে প্রবেশ করে না।” (তেজ পত্রিকা, দিল্লী, ২৫শে জুলাই, ১৯২৭ খৃঃ)
২২। শুদ্ধি আন্দোলন প্রতিরোধে আহমদীগণ ছাড়া অন্য কাহাকেও দেখা যায় নাই

দেখুন উপরোক্ত পত্রিকা জিহাদের ময়দানে ইসলামের পক্ষ হইতে কাদিয়ানীদিগকে ছাড়া অন্য কোন যোদ্ধাকে দেখে নাই। ঐ সময় এই আহারারী যোদ্ধারা কোথায় ছিল যখন হিন্দুদের পক্ষ হইতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত তোড়জোড়ের সহিত শুদ্ধি আন্দোলন চালানো হইয়াছিল। ঐ সময় এই ময়দানে কেবল আহমদীরাই ছিল। তাহারা এই আন্দোলনের দিক পরিবর্তন করিয়া দিয়াছিল। এই “তেজ” পত্রিকা আরও লিখে:-

“আমার ধারণানুযায়ী সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সব চাইতে অধিক বস্তুনিষ্ঠ, ফলপ্রসূ এবং অবিরাম গতিতে কার্য সম্পাদনকারী জামা’ত হইল আহমদীয়া জামা’ত এবং আমি সত্যসত্যই বলিতেছি যে, আমরা ইহাদের প্রতি সব চাইতে বেশী উদাসীন এবং আজ পর্যন্ত আমরা এই বিপজ্জনক জামা’তকে বুঝিতে চেষ্টা করি নাই।” (তেজ পত্রিকা, দিল্লী, ২৫শে জুলাই, ১৯২৭ খৃঃ)
২৩। নির্লজ্জতার একশেষ

এখন দেখুন, ঐ যুগে হিন্দুরা তো থর থর করিয়া কাঁপিতে ছিল, যখন তাহারাই কোটি কোটি লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ছিল এবং আহমদীয়া জামা’তের লোক সংখ্যা আজিকার তুলনায় খুবই অল্প ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে আহরারী মৌলবী এবং পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের পক্ষ হইতে আহমদীয়া জামা’তকে কখনো হিন্দুদের এজেন্ট এবং কখনো খৃষ্টানদের এজেন্ট বলিয়া আখ্যায়িত করা হয় এবং কখনো ইহুদীদের তল্পীবাহকরূপেও আখ্যায়িত করা হয়। কিছুতো খোদার ভয় কর! মিথ্যা কথা বলার তো কোন একটা সীমা থাকা উচিত!

“হিন্দু ধর্ম ও ইসলাহী তাহরীক” (হিন্দু ধর্ম ও সংস্কার আন্দোলনসমূহ) নামে একটি পুস্তক আছে। ইহার রচয়িতা লিখেন:-

“আর্য সমাজ শুদ্ধি অর্থাৎ অপবিত্রকে পবিত্র করার এক পদ্ধতি চালু করিয়াছে (মুসলমানদিগকে হিন্দু বানাইয়া নেওয়া - গ্রন্থকার)। এইরূপ করার দরুন আর্য সমাজের সহিত মুসলমানদের একটি তবলিগী দল অর্থাৎ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ বাঁধিয়া গেল।”

ঐ সময় কি করিতেছিল ইসলামের এই ধ্বজাধারীরা, বিশ্বস্ত লোকেরা এবং জীবন উৎসর্গকারীরা? আহমদীয়া জামা’তের উপর ইসলামের এই ধ্বজাধারীরা দিন-রাত অপবাদ দিতেছে যে, তোমরা জিহাদের বিরুদ্ধে ফতওয়া দিয়া ইসলামের বিশ্বাসঘাতক বলিয়া প্রমাণিত হইয়া গিয়াছ। প্রশ্ন হইল এই যে, যখন ধর্মের জন্য জিহাদের কার্যকর ময়দান উন্মুক্ত হইল তখন উক্ত ময়দানে দৃঢ়তার সহিত বিচরণকারী কাহারা ছিল? আহমদী সিংহ ছিল, নাকি তোমরা ছিলে, যাহারা আহমদীদের উপর মিথ্যা অপবাদ লাগাইতেছ? এই অভিযানের ময়দানে দুশমনেরা তোমাদের কোন চিহ্ন দেখিতে পায় নাই। এই অভিযানে যদি তাহারা কাহাকেও দেখিয়া থাকে, তবে তাহারা আহমদীদিগকে দেখিয়াছে। বস্তুতঃ উপরোক্ত পুস্তকের রচয়িতা লিখেন:-

“আর্য সমাজের সহিত মুসলমানদের একটি তবলিগী দল অর্থাৎ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ বাঁধিল। আর্য সমাজ বলিত যে, বেদ হইল ঐশী বাণী সর্বপ্রথম ঐশী ধর্মগ্রন্থ এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান। কাদিয়ানীরা বলে যে, কুরআন শরীফ খোদার বাণী এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হইলেন খাতামান্নাবীঈন।” (পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪)
২৪। সত্য যখন প্রকাশিত হইয়া গেল তখন ইহা মানিয়া নাও

উপরোক্ত উদ্ধৃতিটির শেষাংশ আমি পূর্বেও পড়িয়া শুনাইয়াছি। এই কথা বলার জন্য আমি ইহা পুনরায় পড়িয়াছি যে, কত সুস্পষ্ট বাস্তব সত্য, চোখে চোখ রাখিয়া আজিও এই সকল লোককে সতর্ক করিতেছে যে, তোমরা যাহা কিছু মর্জি বল না কেন, কিন্তু ইসলামের উপর যখনই কোন দুঃসময় নামিয়া আসিবে এবং বিপদের মেঘ ছাইয়া ফেলিতে আরম্ভ করিবে তখন একমাত্র আহমদীয়া জামা’তই রহিয়াছে, যাহারা ইতিপূর্বেও মোকাবেলা করার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও সর্বদা ইসলামের প্রতিরক্ষায় সকলের চাইতে অধিক অগ্রসর হইয়া আত্মত্যাগ করিবে।

শুদ্ধি আন্দোলনের ব্যাপারে “আরিয়া পত্রিকা” (আর্য পত্রিকা), বেরেলী, ১লা এপ্রিল, ১৯২৩ সালের সংখ্যায় লিখে:-

“এই সময় মালকানার রাজপুতদিগকে তাহাদের পুরাতন রাজপুত বংশে ফিরিয়া যাইতে বাধাদানকারী যতগুলি ইসলামী আঞ্জুমান এবং জামা’ত কাজ করিতেছে, তাহাদের মধ্যে কাদীয়ানের আহমদীয়া জামা’তের তৎপরতা ও প্রচেষ্টা যথার্থই প্রশংসনীয়।”

গৌরখপুরের ‘মাশরেক’ পত্রিকাটি একটি মুসলমান পত্রিকা ছিল। সম্ভবতঃ ইহা এখনও আছে, আমার ঠিক স্মরণ নাই। এই পত্রিকা ১৫ই মার্চ, ১৯২৩ সালের সংখ্যায় লিখে:-

“আহমদীয়া জামা’ত উল্লেখযোগ্য রূপে আর্য ধ্যান-ধারণার উপর খুব বড় ধরণের আঘাত হানিয়াছে এবং আহমদীয়া জামা’ত পরোপকার ও দরদের যে উদ্যমে তবলীগ ও প্রচারকার্যে সচেষ্ট রহিয়াছে, তাহা এই যুগে অন্যান্য জামা’তে দৃষ্টিগোচর হয় না।”
২৫। মুসলিম আহমদীয়া জামা’তের ইসলামের জন্য অপূর্ব খেদমত

যাহা হউক, আহমদী জামা’ত শুদ্ধি আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অভিযান চালাইয়াছিল এবং দেশের পত্র-পত্রিকাসমূহ এই ব্যাপারে বহুল আলোচনা করিয়াছিল। অবশ্য আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, অন্যান্য জামা’ত ময়দানে বাহির হয় নাই। আলেমদের বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন ফিরকা ও দল ময়দানে ছুটাছুটি করিয়াছে নিশ্চয়ই। কিন্তু শত্রুরা তাহাদের আঘাত অনুভব করে নাই। তাহাদের পারস্পরিক মতবিরোধও এইরূপ ছিল যে, ময়দানে গিয়াও অধিকাংশ সময় তাহারা নিজেদের ঝগড়ায় লিপ্ত ছিল। বস্তুতঃ “জমিদার” পত্রিকা ২৪শে জুন, ১৯২৩ সালের সংখ্যায় এই সকল ঘটনার উল্লেখ করিতে গিয়া লিখে:-

“ধর্মত্যাগ সমস্যাটি সম্বন্ধে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যে পরিস্থিতি অবগত হওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে ইহা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত ইসলামের অপূর্ব খেদমত করিতেছে।”

এখন যেহেতু শুদ্ধি অভিযানের তৎপরতা খুব তীব্র, কাজেই আহমদীরা মুসলমান হইয়া গিয়াছে, তাহারা ইসলামের খাতিরে জিহাদ করিতেছে এবং তাহাদিগকে প্রকাশ্যে দেখা যাইতেছে। ধোকা দেওয়ার কোন অবকাশই ছিল না। ইহাই ঐ পত্রিকা, যাহা বিভিন্ন সময় আহমদীদিগকে বার বার ইসলামের গণ্ডির বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিতেছিল। কিন্তু ঐ সময় ইহা আহমদীদিগকে মুসলমান বলিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। যদি ইহা এইরূপ না করিত, তাহা হইলে জগদ্বাসী তাহাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করিত। বস্তুতঃ উল্লিখিত পত্রিকা লিখে:-

“আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত ইসলামের অপূর্ব খেদমত করিতেছে। তাহাদের দিক হইতে যে পরোপকারীতা, একাগ্রচিত্ততা, পুণ্য-উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহা যদি বর্তমান যুগে ভারতবর্ষে দৃষ্টান্তবিহীন নাও হয়, তবু তাহা নিঃসন্দেহে অসাধারণ সম্মান ও প্রশংসার অবশ্যই যোগ্য।”
২৬। ঐতিহাসিক সত্য কখনো মুছিয়া যায় না

এই দেখুন “অমুসলমানদের” (অর্থাৎ তাহাদের দ্বারা আহমদীরা যে নামে আখ্যায়িত - অনুবাদক) স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য! কত উত্তম গুণাবলী-পরোপকারীতা, একাগ্রচিত্ততা, পূণ্য-উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা তাহাদের মধ্যে রহিয়াছে। যদি ইহাই অমুসলিম বৈশিষ্ট্য হয়, তাহা হইলে তোমরাও ইহাকে আপন করিয়া নাও। কেননা ইহা জীবনের বৈশিষ্ট্য। ইহা ছাড়া জাতি জীবিত হয় না। কেন তোমরা হুঁসে আস না? বাস্তবতার দুনিয়ায় কেন তোমরা পদার্পণ কর না? জীবত থাকার রহস্য ও পদ্ধতি কি আমাদের নিকট হইতে শিখিয়া নাও। সুতরাং এই স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের যাহারা অধিকারী, তাহাদিগকে দুশমনরাও দেখিতে পাইতেছিল। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মুসলমান, যাহারা আহমদীয়াতের বিরুদ্ধাচরণে জীবনপাত করিতেছিল, তাহাদিগকে কি দুশমনেরা দেখিতে পাইতেছিল? না, কখনো না। “জমিদার পত্রিকা” আরও লিখে:-

“যেখানে আমাদের খ্যাতনামা পীর এবং সাজ্জাদনশীন হযরতগণ বেকার ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছেন, সেখানে এই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ আহমদীয়া জামা’ত মহান সেবা সম্পাদন করিয়া দেখাইয়া দিয়াছে।”

এখন এই গোটা ইতিহাসকে বদলাইয়া ফেল। ইহাতো লিপিবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। ঘটনাবলীর কলম ইহাকে লিপিবদ্ধ করিয়াছে। তোমাদের নিজেদের হাতে নিজেদের কলমে লিখিত ভাষায় এই বাস্তব সত্য সত্যায়িত হইয়াছে। এখন হৈ চৈ ও হৈ-হল্লা করিতে থাক। কিন্তু এই ঐতিহ্যাটিক সত্যকে কখনো ধরা পৃষ্ঠ হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না।
২৭। আহমদীয়া জামা’তের সেবার প্রকাশ্য স্বীকৃতি

ঝিলামের শেখ গোলাম হোসেন সাহেব একজন অ-আহমদী মুসলমান ছিলেন। সেখানে (অর্থাৎ মালাকানায় - অনুবাদক) বিভিন্ন জামা’তের পক্ষ হইতে যাহারা কাজ করিতেছিল, ইনিও তাহাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তথা হইতেই ‘জমিদার’ পত্রিকাকে একটি চিঠি লিখেন। ‘জমিদার’ পত্রিকা এই চিঠি তাহাদের ২৯শে জুন, ১৯২৩ সালের সংখ্যায় প্রকাশ করে।

শেখ গোলাম হোসেন সাহেব ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্পাদককে সম্বোধন করিয়া লিখেন:-

“কাদিয়ানী আহমদীরা উচ্চ পর্যায়ের পরোপকারীতা প্রদর্শন করিতেছে। তাহাদের প্রায় একশত প্রচারক দলীয় আমীরের নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রামে পরীক্ষায় অবস্থান করিতেছে। এই সকল লোকেরা উল্লেখযোগ্য কাজ করিয়াছে। এই সকল মোবাল্লিগ (প্রচারক) সফর খরচ না লইয়া বিনা বেতনে কাজ করিতেছ। আমরা যদিও আহমদী নই, তথাপি আহমদীদের মহান কাজের প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারি না। আহমদীয়া জামা’ত মহা পরোপকারের যে প্রমাণ দিয়েছেন, ইহার দৃষ্টান্ত প্রাথমিক যুগের মসলমানগণ ব্যতীত অন্য কাহারও নিকট হইতে পাওয়া মুস্কিল।”

হযরত মসীহ মাওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালাম যখন বলেন, “সাহাবা (রাঃ) ছে মিলা যব মুঝকো পায়া” (অর্থাৎ যখন আমাকে পাইয়াছে তখন সাহাবাগণের সহিত মিলিত হইয়াছে-অনুবাদক) তখন মৌলবীরা বড় ক্রোধান্বিত হইয়া পড়ে এবং বড়ই উত্তেজিত হইয়া বলে যে, এই ব্যক্তি কি কথা বলিয়া দিল? কিন্তু কার্যতঃ তখন ইসলামের প্রতি রক্ষার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং ইসলামকে সমর্থন করার সময় আসে তখন তোমরা উপরোক্ত কথাও তোমাদের উপরোক্ত বক্তব্যে রাখিতে বাধ্য হইয়া পড়। খোদার ফিরিশতাগণ তোমাদের কলম হইতে ঐ কথাগুলিই বাহির করেন যে, হাঁ আহমদীরা হইল ঐ সকল লোক যাহাদিগকে দেখিলে অর্থাৎ তাহাদের নিঃস্বার্থ সেবা এবং আত্মত্যাগের আবেগ দেখিলে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদিগের কথা স্মরণ হয়। যে সকল অতীতকালের বুযুর্গ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে পাইয়াছিলেন, তাহাদিগকে “প্রাথমিক যুগের মুসলমান” বলা হইয়া থাকে। বস্তুতঃ শেখ গোলাম হোসেন সাহেব লিখেন:-

“আহমদীয়া জামা’ত যে মহান পরোপকারের প্রমাণ দিয়াছে ইহার দৃষ্টান্ত প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ ব্যতীত অন্য কাহারও নিকট হইতে পাওয়া মুস্কিল। তাহাদের প্রত্যেক প্রচারক, কি গরীব, কি ধনী—পথ খরচ ও খাদ্য বাবদ কোন অর্থ না পাইয়া কর্মক্ষেত্রে তৎপর রহিয়াছে। ভয়ংকর গরম ‘লু’ হাওয়ার মধ্যে তাহারা নিজেদের আমীরের আজ্ঞানুবর্তীতায় কাজ করিতেছে।" (ঝিলাম হাই স্কুলের হেডমাস্টার শেখ গোলাম হোসেন সাহেবের বর্ণনা)

এইরূপ আরো অনেক উদ্ধৃতি ও রেফারেন্স রহিয়াছে। যেগুলি বিভিন্ন মুসলিম পত্র-পত্রিকার পক্ষ হইতে বা মুসলমান স্বনামধন্য পুরুষদের তরফ হইতে এই বিষয়ে প্রকাশ্য স্বীকৃতিস্বরূপ লিপিবদ্ধ থাকিয়াছে যে, আহমদীয়া জামা’ত শুদ্ধি আন্দোলনে ইসলামের খেদমতে দায়িত্ব পালন করিয়াছে।
২৮। আহমদীদিগকে বাদ দিয়া সন্ধির কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হইতে পারে নাই

কিন্তু আহমদীয়া জামাতের প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে ঐ দাম্ভিক আর্য সমাজী নেতৃবৃন্দ, যাহারা সর্বদা মুসলমানদের সহিত এই ব্যাপারে কথা বলিতেও ঘৃণাবোধ করিত এবং ইসলামের উপর একতরফা হামলা করিতেছিল, যখন তাহারা পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হইয়া পড়িল, তখন তাহারা বুঝিল যে এখন সন্ধি করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। বস্তুতঃ সন্ধির জন্য তাহারা যে কনফারেন্স ডাকিয়াছিল, তাহাতে বিভিন্ন ফেরকার শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যখন একত্রিত হইলেন তখন এক অদ্ভুত মজার ব্যাপার ঘটিল যে, এই সম্মেলনে আহমদীয়া জামা’ত ব্যতীত অন্য সব ফিরকাকে আমন্ত্রণ জানানো হইয়াছিল। যদি ইহাতে কাহারো নাম না থাকিয়া থাকে, তাহা হইলে একমাত্র আহমদীয়া জামা’তেরই নাম ছিল না। বস্তুতঃ হিন্দু এবং মুসলমান নেতৃবৃন্দ যখন সন্ধির শর্তাবলী প্রণয়ন করার জন্য একটি সভাকক্ষে সমবেত হইলেন তখন হিন্দুরা আহমদীদির কোন প্রতিনিধি দেখিতে না পাইয়া মুসলমান নেতাগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা এ কি কথা বলিতেছ? যোদ্ধারা সভাকক্ষের বাহিরে বসিয়া রহিয়াছে। তোমাদের সঙ্গে সন্ধি করিয়া আমরা কি করিব? তোমরাতো হইলে ঐ সকল লোক, যাহাদিগকে আমরা মালকানার ময়দানে দেখিতে পাই নাই। যাহাদিগকে আমরা ভয় করি এবং যাহাদের তরফ হইতে আমাদের উপর আক্রমণ করার আশংকা রহিয়াছে, তাহারাতো স্বাধীন থাকিবে। বস্তুতঃ তৎক্ষণাৎ কনফারেন্স স্থগিত করিয়া দেওয়া হইল এবং হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) এর খেদমতে কাদিয়ানে টেলিগ্রাম যোগে ক্ষমা প্রার্থনা করা হইল এবং আবেদন করা হইল যে, অতি সত্বর আপনার প্রতিনিধি প্রেরণ করুন। ইহা ব্যতীত এই কনফারেন্স সফল হইতে পারে না। ইসলামের এই ইতিহাস চিরকালের জন্য রচিত হইয়া গিয়াছে। ইহাতো এখন মুছিবে না এবং ইহাকে মুছিয়া ফেলা সম্ভব নয়। কোন যুগ-একনায়ক এই শক্তি রাখে না যে, সে এই লিপিবদ্ধ ইতিহাস এবং খোদার বিধানকে বদলাইয়া দিতে পারে। ইহা খোদার শক্তির এইরূপ অমোঘ বিধান, যাহা ব্যক্ত হইয়া পড়িয়াছে। একটি সেনাবাহিনীতে দূরের কথা, সমগ্র বিশ্বের সকল সামরিক শক্তি একত্রিত হইলেও এই লিপিবদ্ধ ইতিহাস মুছিয়া ফেলিতে পারে না। কেননা ইহা ধরা পৃষ্ঠে চিরকালের জন্য অংকিত হইয়া গিয়াছে।
২৯। আহমদীয়া জামা’তের মহান ভূমিকা

ইহাই হইল আহমদীয়া জামা’তের ভূমিকা। এই ভূমিকা বিগত দিনেও এইরূপ ছিল। আজিও এইরূপই রহিয়াছে এবং অনাগত ভবিষ্যতেও এইরূপই থাকিবে। হে বিরুদ্ধবাদীরা! তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে যত দুশমনী করিতে চাও, করিতে থাক এবং অকৃতজ্ঞতার যত প্রমাণ দিতে চাও, দিতে থাক। কিন্তু যে খোদার শক্তিমান মুষ্ঠিতে আমার প্রাণ সেই খোদার কসম খাইয়া আমি বলিতেছি যে, আগামীতে তোমাদের উপর যে বিপদ আপতিত হইবে, তাহাতেও আহমদীয়া জামা’ত প্রথম সারিতে দণ্ডায়মান হইবে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত সকল তীর নিজেদের বক্ষে ধারণ করিবে। আমাদের চাইতে অধিক বিশ্বস্ত ইসলামের আর কোন সেবক নাই, মুসলমান জাতির জন্য আমাদের চাইতে অধিক কোন দরদী নাই। আমাদের চাইতে অধিক মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ধর্মের প্রতি আত্মবিলীনকারী আর কোন প্রেমিক নাই। অতীতও তোমাদিগকে এই কথাই বলিয়া দিয়াছে, কিন্তু তোমরা প্রতিবারই তাহা ভুলিয়া থাক এবং আগামীতে আসন্ন দুঃসময়ও তোমাদিগকে এইরূপই বলিবে। আফসোস! যদি তোমাদের চক্ষু খুলিত এবং তোমরা দেখিতে পাইতে যে, কে তোমাদের বন্ধু এবং কে তোমাদের দুশমন।

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।