আপত্তির জবাব

পাকিস্তান ও কলেমাকে নিশ্চিহ্ন করার হীন ষড়যন্ত্র

১। একটি কুরআনী সতর্কবাণী

সূরা ইব্রাহীমে আল্লাহতা’লা বলেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম! তুমি লোকদিগকে এই দিনের আযাব সম্বন্ধে সতর্ক কর বা এই দিন সম্বন্ধে সতর্ক কর, যেদিন একটি আযাব আসিবে। যে সকল লোক যুলুম করিয়াছে তাহারা নিজেদের প্রভুর দরবারে এই নিবেদন করিবে যে, হে আমাদের আল্লাহ! এই নির্ধারিত সময়কে বা এই নির্ধারিত আযাবকে কিছু সময়ের জন্য পিছাইয়া দাও। এর মধ্যে আমরা নিশ্চয়ই তোমার আহ্বান গ্রহণ করিব এবং রসূলগণের অনুসরণ করিব। তোমরা কি ঐ সকল লোক নও, যাহারা ইহার পূর্বে কসমের পর কসম করিত যে তোমাদের জন্য কোন পতন নাই?

অতঃপর আল্লাহতা’লা বলেন, তোমরা ঐ সকল লোকের গৃহেই বসবাস করিতেছ, যাহারা নিজেদের প্রাণের উপর যুলুম করিয়াছিল। তোমাদের নিকট ইহা অত্যন্ত সুস্পষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, আমরা তোমাদের নিকট ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে উপস্থাপন করিয়াছি। কিন্তু আফসোস! এই সকল লোক নিজেদের তদবীর ও কৌশলকে চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাইয়া দিয়াছে। কিন্তু আল্লাহ্ তাহাদের তদবীর ও কৌশলের সকল দিক সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন এবং তাহাদের সকল তদবীর ও কৌশলের জবাবও তাঁহার নিকট রহিয়াছে, এমনকি যদি তাহাদের নিকট তাহাদের তদবীর ও কৌশল এমনটিও হয় যে, উহা পর্বতকেও নিজ জায়গা হইতে হিলাইয়া দিতে পারে। তুমি কখনো এই ধারণা করিও না যে আল্লাহ নিজ রসূলগণের সহিত যে অঙ্গীকার করেন, তিনি তাহা ভঙ্গ করেন এবং ওয়াদা বিরোধী কাজ করেন। নিশ্চয় আল্লাহতা’লা অত্যন্ত পরাক্রমশালী এবং প্রতিশোধ গ্রহণকারী। যে দিন পৃথিবীকে অন্য একটি পৃথিবীতে পরিবর্তিত করিয়া দেওয়া হইবে এবং আকাশকেও পরিবর্তিত করিয়া দেওয়া হইবে এবং তাহারা এক ও অদ্বিতীয় এবং শাস্তিদাতা আল্লাহর দরবারে বাহির হইয়া দণ্ডায়মান হইবে, ঐ দিন তুমি অপরাধীদিগকে দেখিবে যে তাহারা শিকলাবদ্ধ অবস্থায় রহিয়াছে। তাহাদের জামা কাপড় আলকাতরা দ্বারা বানানো হইবে এবং তুমি তাহাদের চেহারা কালিমাচ্ছন্ন দেখিবে, যাহাতে আল্লাহতা’লা প্রত্যেককে তাহার কৃতকর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন এবং আল্লাহ ত্বরিত হিসাব গ্রহণকারী। ইহা লোকদের জন্য পয়গাম, যাহাতে ইহার মাধ্যমে তাহাদিগকে সতর্ক করা হয় এবং তাহারা জ্ঞাত হয় যে আল্লাহ হইলেন "ইলাহু ওয়াহেদুন” (আল্লাহই উপাস্য, তিনি এক ও অদ্বিতীয়) এবং জ্ঞানীদের কথা হইতে তাহারা উপদেশ গ্রহণ করে।

কিন্তু আমি যে কথাগুলি বলিব, তাহার একটি অংশ কার্যতঃ আল্লাহতা’য়ালার কথারই ব্যাখ্যা এবং ইহা অনুধাবণ করা জ্ঞানী ব্যক্তিগণের জন্য কোন মুস্কিল ব্যাপার হইবে না।
২। প্রথম সারির আত্মত্যাগীগণ

পাকিস্তান সরকারের শ্বেত-পত্রে আহ্‌মদীয়া জামা’তকে ইসলাম এবং মুসলিম দেশগুলির জন্য বিশ্বাসঘাতক জামা’তরূপে উপস্থাপন করা হইয়াছে। ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসে দুইটি অংশ রহিয়াছে। একটি হইল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বের ইতিহাস এবং অন্যটি হইল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের ইতিহাস। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা আমি পূর্বে নমুনা স্বরূপ উপস্থাপন করিয়াছিলাম এবং কয়েকটি ঘটনা এখন উপস্থাপন করিতেছি। প্রকৃত সত্য এই যে, যখনই পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের উপর কোন বিপদ আপতিত হইয়াছে বা কোনভাবে ধর্মীয় ব্যাপারে তাহাদের মনঃকষ্ট হইয়াছে, তখন খোদাতা’লার কৃপায় আহ্‌মদীয়া জামা’ত ঐ সকল অসুবিধা দূর করার জন্য এবং নিজেদের মুসলমান ভাইদের সাহায্যার্থে প্রথম সারির আত্মত্যাগীগণের মধ্যে ছিল। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় যে সকল জিহাদ ও সংগ্রাম শুরু হইতে থাকে, ঐগুলির জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আহ্‌মদীয়া জামা’তের প্রাপ্য এবং তাহারাই এই সকল জিহাদের পতাকাবাহী ছিল। অবশ্য অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণও ঐগুলিতে অংশ গ্রহণ করিয়াছেন এবং আহ্‌মদীয়া জামা’তের সহিত সহযোগিতা করিয়াছেন। কিন্তু যে সকল মহান আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের কল্যাণের জন্য বিগত যুগগুলিতে পাক-ভারত উপমহাদেশে চালানো হইয়াছিল, ঐ গুলিতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং অধিক হইতে অধিকতর সেবার সুযোগ আল্লাহতা’লার দয়া ও কৃপায় আহ্‌মদীয়া জামা’ত লাভ করিতে থাকে। ভারতবর্ষে যে বৎসরগুলিতে বিশেষভাবে মুসলমানদের মনঃকষ্ট দেওয়া হইয়াছিল, ঐগুলির মধ্যে ১৯২৭ সাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উক্ত সালে বিশ্ব-নিন্দিত “রঙ্গীলা রসূল” পুস্তকটি লিখা হইয়াছিল এবং আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র সত্বার উপর এতখানি ভয়ংকর ও ঘৃণ্য আক্রমণ করা হইয়াছিল যে, উহা মনে হইলে মুসলমানদের রক্ত টগবগ করিয়া উঠে। কিন্তু এই বেদনার উপশম হইতে না হইতেই এবং পুস্তকের লেখক রাজপালের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন অবস্থাতেই “বর্তমান” নামক অন্য একটি আর্য পত্রিকায় একজন হিন্দু রমণী আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সম্বন্ধে এইরূপ একটি অপবিত্র প্রবন্ধ লিখিল যে, কোন বিবেকবান মানুষও ইহা পড়িতে পারে না। মুসলমান তো মুসলমান, অন্য কেহও যদি ইহা পড়ে, সেও হতবাক হইয়া যাইবে যে, এ কিরূপ অসৎ ও পাপিষ্ঠা রমণী, যাহার কলম হইতে এইরূপ নোংরা কথা একজন ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে বাহির হইতেছে। একটি সাধারণ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধেও কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি এই ধরনের উক্তি করিতে পারে না। কিন্তু আদম সন্তানদের সেরা ব্যক্তি, যিনি সকল পবিত্র ব্যক্তির মধ্যে পবিত্রতম ছিলেন, যিনি সকল সৈয়্যদের মধ্যে সব চাইতে বড় সৈয়্যদ ছিলেন, যিনি সকল নেতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন, যাঁহার খাতিরে নিখিল বিশ্বকে সৃষ্টি করা হইয়াছে, যিনি কেবলমাত্র নিজেই পবিত্র ছিলেন না, বরং অন্যদেরকে পবিত্র করিয়াছিলেন, যিনি পবিত্রও ছিলেন না বরং পবিত্রকারীও ছিলেন এবং যাঁহার বরকত ও আশিষে নবীগণকে পবিত্র করা হইয়াছে, তাঁহার সম্বন্ধে এইরূপ অপবিত্র আক্রমণ করা হইয়াছিল যে, আমার কলমেরও শক্তি নাই যে এই আক্রমণের বিবরণ দিতে পারি। এই সময় এই শত্রুতামূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল এবং এই ব্যাপারে মুসলমানদিগকে যে মহান জিহাদ ও সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, উহার কৃতিত্ব কি কংগ্রেসী আলেমদের বা মওদুদীপন্থী আলেমদের প্রাপ্য? না, তাহা কখনও নয়। আহ্‌মদীয়া জামা’তকে আল্লাহতা’লা এই সামর্থ দান করিয়াছিলেন যে, তাহারা কেবলমাত্র এই মহান সংগ্রাম ও জিহাদে অসাধারণভাবে অংশ গ্রহণ করে নাই, বরং ইহার পূর্ণ কৃতিত্বের সৌভাগ্য তাহাদেরই হইয়াছিল। বিষয়টি দীর্ঘায়িত হইয়া যাওয়ার ভয়ে আমি সংক্ষেপে ভারতের একটি মুসলমান পত্রিকার একটি উদ্ধৃতি আপনাদের নিকট উপস্থাপন করিবার জন্য বাছিয়া লইয়াছি এবং অনুরূপভাবে আমি আপনাদের সম্মুখে দুইটি হিন্দু পত্রিকার উদ্ধৃতিও রাখিতেছি। ইহাতে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট হইয়া যাইবে যে, ইসলাম জাহানের এই বেদনাদায়ক মুহূর্তে সব চাইতে বেশী বেদনা কোন জামা’ত অনুভব করিয়াছিল এবং কাহাদের নেতা অসাধারণ কঠোরতা সহিত পালটা আক্রমণ হানিয়াছিল।
৩। মুসলমানদের উপর আহ্‌মদীয়া জামা’তের ইহসানসমূহ

গোরখপুরের “মাশরেক” পত্রিকা উহার ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সালের সংখ্যায় লিখেঃ “আহ্‌মদীয়া জামা’তের মাননীয় ইমামের উপকার ও দয়া সকল মুসলমানের উপর রহিয়াছে।”

(বর্তমান যুগে যাহারা ইহার মূল্য বুঝে না, তাহারা যদি এই সকল কথা ভুলিয়া যায় তাহা হইলে ইহা তাহাদের মর্জি। কিন্তু গোরখপুরের “মাশরেক” পত্রিকা লিখে যে, মুসলমানদের উপরতো নিশ্চয় ইহসান রহিয়াছে। যাহারা মুসলমানীত্বের গণ্ডি হইতে বাহির হইয়া যাইতে চায়, ইহা তাহাদের মর্জি যে, বাহির হইয়া যাইবে। কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত এই সকল ইহসান মুসলমানদের উপর ইহসানরূপেই বলবৎ থাকিবে) উল্লেখিত পত্রিকা লিখে:-

“তাঁরই নির্দেশে ‘বর্তমান’ পত্রিকার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালানো হইয়াছিল! তাঁহারই জামা’ত ‘রঙ্গীলা রসূল’ এর ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছিল এবং নিজদিগকে উৎসর্গ করিয়াছিল। তাহারা জেলখানায় যাইতেও ভয় পায় নাই। তাঁহারই প্যাম্ফলেট মাননীয় গভর্ণর সাহেব বাহাদুরকে ন্যায় বিচারের দিকে ধাবিত করে। তাঁহার প্যাম্ফলেট বাজেয়াপ্ত করা হইয়াছিল, কিন্তু ইহার প্রভাব বিনষ্ট হয় নাই। সরকারের পক্ষ হইতে লিখিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, এই পোষ্টার এই জন্য বাজেয়াপ্ত করা হইয়াছে, যাহাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়। অতঃপর ন্যায়নিষ্ঠ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইহার প্রতিকার করা হইয়াছিল। বর্তমানে ভারতবর্ষে মুসলমানদের যত ফিরকা রহিয়াছে তাহাদের সব কয়টি ফিরকা কোন না কোন কারণে ইংরেজ বা হিন্দু বা অন্যান্য জাতির সম্মুখে ভীত রহিয়াছে।”

(ইহা আপনাদের স্বাধীন সংবাদ পত্রের গতকালের কথা যে সকল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ন্যায়-নীতির কিছুটা বালাই ছিল, যাহারা ইতিহাস মুছিয়া ফেলায় বিশ্বাসী ছিলেন না এবং যাহারা সত্যকে সত্য বলার সাহস রাখিতেন-তাহারা এই কথা বলিতেছিলেন)। উল্লেখিত পত্রিকা আরও লিখে:-

“মুসলমানদের সব কয়টি ফিরকা কোন না কোন কারণে ইংরেজ বা হিন্দু বা অন্যান্য জাতির সম্মুখে ভীতসন্ত্রস্ত রহিয়াছে! কেবলমাত্র আহ্‌মদীয়া জামা’তই রহিয়াছে, যাহারা প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ন্যায় কোন ব্যক্তি বা জামা’তের দ্বারা ভীত সন্ত্রস্ত নহে এবং তাহারা অকৃত্রিম ইসলামী কার্য সম্পাদন করিতেছে।”

ইহাতো মুসলিম পত্রিকা লিখিতেছিল। হিন্দু পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিতেও ঐ যুগে সব চাইতে অধিক কঠোর পালটা আক্রমণকারী ছিল আহ্‌মদীরাই। অর্থাৎ যাহাদের সহিত মোকাবেলা ছিল, এখন তাহাদের কণ্ঠে শুনুন। হিন্দুরা ঐ কাজই করিতেছিল যাহা আজ আহরাররা করিতেছে। ঐ যুগে হিন্দুরা অ-আহ্‌মদী মুসলমানদিগকে আহ্‌মদী মুসলমানদের সহিত বিরোধ বাঁধাইয়া দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছিল এবং তাহাদিগকে বার বার এই কথা বলিতেছিল যে, আহ্‌মদীরা হইল অমুসলমান। অর্থাৎ আহরারদের কাজ ঐ সময় আর্য সমাজীরা সামলাইতেছিল এবং তাহারা মুসলমানদিগকে বলিতেছিল যে, নির্বোধরা! আহমদীরাতো অমুসলমান। তাহাদের পিছনে কেন চলিয়াছ? তাহাদের পশ্চাতে চলিয়া তোমরা নিজেদের রসূলের জন্য মর্যাদাবোধ কেন দেখাইতেছ? ইহারা জীবন উৎসর্গ করিতেছে তো করিতে দাও এবং ইহাদিগকে নিশ্চিহ্ন হইতে দাও। নাউযুবিল্লাহ, এই রসূলের সহিত তোমাদের কি সম্পর্ক রহিয়াছে, যাহার জন্য আহমদীরা জীবন বাজী রাখিয়াছে? অতএব এই পত্রিকার ভাষ্য শুনুন:-

“মির্যায়ী বা আহমদী এবং অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে এতখানি মতবিরোধ রহিয়াছে যে মির্যায়ীরা মুসলমানদিগকে এবং মুসলমানেরা মির্যায়ীদিগকে কাফির সাব্যস্ত করিতেছে। এইতো গতকালের কথা। একজন মুসলমান দিল্লীর জমিয়তে ওলামার প্রেসিডেন্ট মৌলবি কেফায়েত উল্লার নিকট মির্যায়ীদের সম্বন্ধে ফত্‌ওয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। তিনি যে ফত্‌ওয়া দিয়াছেন তাহা জমিয়তে ওলামার মুখপাত্র দিল্লীর ‘আল-জমিয়াতু’ এর কলামে প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে মৌলানা কেফায়েত উল্লাহ মির্যায়ীদিগকে কাফির সাব্যস্ত করিয়া তাহাদের সহিত বেশী মেলামেশা করা অন্যায় বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছেন।”

(হযরত আকদাস মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অবমাননাকারী এই সকল লোক মুসলমানদিগকে আহ্‌মদীদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতেছে এবং এই বাণী শুনাইতেছে যে, আমরা ও তোমরা ভাই ভাই। অতএব আহ্‌মদীদের পিছনে লাগিয়া যাও। কেননা ইহারা হযরত রসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের জন্য মর্যাদাবোধ রাখে। একটি আওয়াজ আজ ধ্বনিত হইতেছে যে, ‘আমরা-তোমরা ভাই ভাই’ এবং একটি আওয়াজ বিগত দিনেও ধ্বনিত হইয়াছিল যে, ‘আমরা-তোমরা ভাই ভাই’। আজ কোন কোন নির্বোধ মুসলমানের পক্ষ হইতে এই আওয়াজ ধ্বনিত হইতেছে। কিন্তু পূর্বে বুদ্ধিমান আর্যদের তরফ হইতে এই আওয়াজ ধ্বনিত হইয়াছিল এবং বিভেদ সম্প্রসারণের জন্য ইহা ব্যবহার করা হইয়াছিল। উল্লেখিত পত্রিকা লিখে যে, ইহা মাওলানা কেফায়েত উল্লাহর ফত্‌ওয়া। ইহা আমাদিগকে ও তোমাদিগকে নির্দেশ দিতেছে যে, আহ্‌মদীদের সহিত মেলামেশা নিষিদ্ধ। কিন্তু তোমরা এই সম্বন্ধে অজ্ঞ।)

“কিন্তু মির্যায়ীদের চালাকী, সতর্কতা ও সৌভাগ্যের প্রতি লক্ষ্য কর। যে মুসলমানেরা তাহাদিগকে কাফির সাব্যস্ত করিতেছে, তাহাদের নেতা মির্যায়ী হইয়া বসিয়া রহিয়াছে। এখন লাহোরের নিন্দিত পত্রিকা ‘মুসলিম আউটলুক’ এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক কয়েদ হওয়ার দরুন সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানেরা একটি অসাধারণ, কিন্তু মনগড়া আবেগ প্রকাশ করিতেছে এবং ‘মুসলিম আউটলুকের’ অনুবর্তিতা করার জন্য অস্থির হইয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে। ‘মুসলিম আউটলুক’ পত্রিকা সম্বন্ধে এই কথা জানিতে পারিয়া আমরা অতিশয় বিস্মিত হইয়াছি যে, ইহার সম্পাদক মিষ্টার দেলোয়ার শাহ বুখারী আহমদী ছিলেন (যিনি ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধকে পাল্টা আক্রমন করিয়া ছিলেন) এবং যখন তাঁর নামে হাইকোর্টের নোটিশ আসিল, তখন তিনি মির্যা কাদিয়ানীর নিকট গেলেন, যাহাতে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন ও কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁর রায় নিতে পারেন। মির্যা তাঁকে পরামর্শ দিলেন যে, ক্ষমা চাওয়ার চাইতে কয়েদ হইয়া যাওয়াই শ্রেয়ঃ। মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মর্যাদার জন্য যদি তুমি কয়েদ হইয়া যাও, তাহা হইলে কোন পরওয়া নাই। কার্যতঃ ইহাই হইল। তাঁকে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হইল এবং তিনি খুবই সন্তুষ্টচিত্তে তাহা গ্রহণ করেন। বস্তুতঃ তাহারা বলে যে, তিনি মির্যা কাদিয়ানীর নিকট গেলেন এবং তিনি এই পরামর্শ দিলেন। মুদ্দা কথা, ইহা হইল একটি আহ্‌মদী আন্দোলন।” (গুরু ঘণ্টাল পত্রিকা, লাহোর, ১১ ই জুলাই, ১৯২৭ সাল)

কোথায় আজিকার পাকিস্তানের ইতিহাসবিদেরা, যাহারা গোটা ইসলামী ইতিহাসের চেহারা বিকৃত করার জন্য বদ্ধপরিকর? তাহাদের হস্ত দ্বারা লিখিত পাকিস্তানের ইতিহাসকেতো চেনাই যাইতেছে না। আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জন্য প্রেম ও ভালবাসায় যে আন্দোলন শুরু হইয়াছিল, উহাতে যাহাদের সহিত মোকাবেলা ছিল এবং যাহাদের উপর আঘাত হানা হইতেছিল, তাহারা বলিতেছিল, “মুদ্দা কথা, ইহা হইল একটি আহমদী আন্দোলন।”

অনুরূপভাবে “প্রতাপ” এবং অন্যান্য পত্র-পত্রিকাও এই বিষয়ে কলম ধরিয়াছিল এবং প্রকাশ্যে ইহা স্বীকার করিয়াছে যে, আসল পালটা আক্রমণ যাহাতে তাহাদের ভয়ানক বিপদ রহিয়াছে এবং ক্ষতি হইতেছে, তাহা আহ্‌মদীয়া জামাতের পক্ষ হইতে আসিতেছে।
৪। কাশ্মীরে মুসলমানদের জন্য নিঃস্বার্থ সেবা ও সাহায্য

অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যাহা ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি নেহায়েত পীড়া ও বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এবং যাহার দরুন মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক স্থিতির ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত বড় বিপদ দেখা দিয়াছিল, উহার সূচনা হইয়াছিল কাশ্মীর হইতে যখন কাশ্মীরের ডোগরা মহারাজা মুসলমানদের অধিকার হরণ করিতে আরম্ভ করিল এবং একটি ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিল যে, যেখানেই হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে মুসলমানদিগকে সকল অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া দিতে হইবে। ইহাতে মুসলমানদের মধ্যে মারাত্মক অস্থিরতার ঢেউ খেলিয়া গেল এবং ভারতবর্ষের উত্তর হইতে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত চিন্তাশীল ও দূরদর্শী ব্যক্তিগণ ইহা ভাবিতে আরম্ভ করিল যে, ইহার কিছু একটা প্রতিকার হওয়া উচিত। প্রকৃতপক্ষে ঐ যুগের বড় বড় চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি কাদিয়ানের দিকে নিবদ্ধ হইতে আরম্ভ হইল এবং তাঁহারা চিঠিপত্রের মাধ্যমে এবং দূত পাঠাইয়া হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন যে, যদি আপনি এই কাজ সামলান তাহা হইলে ইহার সুরাহা হইতে পারে। আপনি ব্যতীত এই তরী কূলে ভিড়িবে বলিয়া মনে হয় না। এই চিন্তাবিদ ও নেতাগণের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যাঁহাকে আজ আহ্‌মদীয়া জামাতের বিরুদ্ধবাদী মুসলিম নেতাগণের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকারী নেতা বলিয়া উপস্থাপন করা হইতেছে। ইনি হইলেন ডক্টর আল্লামা স্যার মোহাম্মদ ইকবাল। তিনি হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ)-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী শেখ ইউসুফ আলী সাহেবের নামে ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩০ সালে একটি চিঠি লিখেন। যেহেতু এই জাতীয় লেখা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আহ্‌মদীয়া জামা’তের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হইয়াছিল, এই জন্য সাধারণতঃ অ-আহমদী আলেমরা সাধারণ মুসলমানদিগকে বলে যে, আহ্‌মদীদের পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা কথা ছাপা হইয়াছে। অতএব আমি এই সকল রেফারেন্সের পরিবর্তে আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করার জন্য স্যার আল্লামা ইকবালের ঐ চিঠি বাছিয়া লইয়াছি, যাহা তিনি নিজের হাতে লিখিয়াছেন এবং যাহার উপর তাঁহার নিজের দস্তখত মওজুদ রহিয়াছে। তিনি লিখেন:-

“যেহেতু আপনার জামা’ত একটি সুসংগঠিত জামা’ত এবং তদুপরি অনেক যোগ্য ও কর্মঠ ব্যক্তি আপনার জামা’তে মওজুদ রহিয়াছে, সেইজন্য আপনি অনেক কল্যাণমূলক কাজ মুসলমানদের জন্য সম্পাদন করিতে পারেন।”

“বাকি রহিল বোর্ডের বিষয়টি। ইহাও একটি অতি উত্তম চিন্তা। আমি ইহার সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অধিক কোন যোগ্য এবং আমার চাইতে কম বয়সী ব্যক্তি মনোনীত হওয়া সমীচীন হইবে। কিন্তু যদি সরকারের নিকট প্রতিনিধিবৃন্দ লইয়া যাওয়া এই বোর্ডের উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে ইহা হইতে আমাকে অনুগ্রহপূর্বক অব্যাহতি দিবেন। কেননা, প্রতিনিধি প্রেরণ নিষ্ফল প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। তদুপরি আমি অত্যন্ত অলস এবং যোগ্যতাও আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নাই। যাহা হউক, যদি সদস্যগণের মধ্যে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করেন তাহা হইলে ইহার পূর্বে অন্যান্য সদস্যগণের তালিকা প্রণয়ন করিয়া অনুগ্রহপূর্বক আমার নিকট প্রেরণ করিবেন।”

আল্লামা ইকবালের এই চিঠি ও তাঁর নিকট অন্যান্য মুসলমান আলেম এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের লিখিত পত্রাবলীর দরুন হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) একটি সম্মেলন আহ্বান করার প্রস্তাব করেন। এই সম্মেলন সিমলায় নবাব স্যার জুলফিকার আলী সাহেবের কুঠীতে ১৯৩১ সালে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সম্মেলনে যে সকল বড় বড় নেতা অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্য হইতে কয়েকটি নাম আপনাদিগকে পড়িয়া শুনাইতেছি। তাঁহারা হইলেন:- শামসুল উলামা খাজা হোসেন নেজামী, স্যার মিঞা ফজল হোসেন, স্যার মোহাম্মদ ইকবাল, স্যার জুলফিকার আলী খান, জনাব নবাব সাহেব কুঞ্চপুরা, খান বাহাদুর শেখ রহিম বখ্‌স সাহেব, সৈয়্যদ মোহাম্মদ হোসেন শাহ্‌ সাহেব, এডভোকেট মৌলবী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব গজনবী (অমৃতসর), মৌলবী নূরুল হক সাহেব মালিক, “মুসলিম আউটলুক”, সৈয়্যদ হাবিব সাহেব, সম্পাদক "সিয়াসত” এবং আরও অনেকে। এতদ্ব্যতীত কাশ্মীরের প্রতিনিধি হিসাবে দেওবন্দের ভূতপূর্ব প্রফেসর মৌলবী মিরক শাহ্‌ সাহেব এবং জম্মুর প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহ্‌ রাখখা সাহেব সাগের এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে স্যার মোহাম্মদ ইকবাল হযরত খলিফাতুল মসীহ সানীর নাম উত্থাপন করিয়া বলেন:-

“আমি এই প্রস্তাব করিতেছি যে, যদি এই কাশ্মীর আন্দোলনকে কামিয়াব করাই আমাদের লক্ষ্য হয় তাহা হইলে আহ্‌মদীয়া জামা’তের ইমাম মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ সাহেব ব্যতীত অন্য কেহ যোগ্য নয়।”

এই আওয়াজ উঠার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিক হইতে সমর্থনসূচক আওয়াজ ধ্বনিত হইতে আরম্ভ হইল এবং সর্বসম্মতিক্রমে হযরত খলীফাতুল মসীহ (রাঃ)-কে এই সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হইল। ডক্টর আল্লামা ইকবাল বলেন:-

“হযরত সাহেব, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এই কাজকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে গ্রহণ না করেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই কাজ হইবে না।” (লাহোর, ৫ই এপ্রিল, ১৯৬৫ ইং পৃঃ ১২, কলাম-২)

আহ্‌মদীয়া জামা’ত ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যে মহান কুরবানী করিয়াছে, তাহাতো এক সুদীর্ঘ কাহিনী। কাশ্মীরের সর্বত্র এবং প্রতিটি পুষ্পোদ্যানে ইহার স্মৃতি ছড়াইয়া রহিয়াছে। আহ্‌মদীয়া জামা’তের বড় বড় আলেম হইতে নিরক্ষর ব্যক্তি পর্যন্ত এবং ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে নিজেদের খরচে কাশ্মীরে যাইত এবং মুসলমানদের অশেষ সাহায্য ও সেবা করিত। তাহারা কাশ্মীরীদের উপর কোন প্রকারের বোঝা হইয়া বসিত না। তাহারা বই পুস্তকাদি বিতরণ করিত এবং কাশ্মীরের তৎকালীন রাজার যুলুমের শিকার হইত এবং কারারুদ্ধ হইত। অতঃপর আইনজীবীগণের কাফেলা ত্যাগ স্বীকার করিয়া সেখানে যাইতেন এবং যে সকল মুসলমান ভাই দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত হইত তাহাদের পক্ষে মোকদ্দমা পরিচালনা করিতেন। সুতরাং ইহা একটি অত্যন্ত বড় কাহিনী এবং এই বিষয়ের উপর শত শত পৃষ্ঠার বই লেখা হইয়াছে। ইহা অসম্ভব যে, কাশ্মীরের ইতিহাস আলোচিত হইবে এবং আহ্‌মদীয়া জামা’তের কথা উঠিবে না। কেননা আহ্‌মদীয়া জামা’তের মহান সেবার বিষয়টি আলোচিত না হইলে কাশ্মীরের ইতিহাসকে ইতিহাসই বলা যাইবে না। এখন আমি স্মরণ করানোর জন্য আপনাদের নিকট ঐ সময়ের কোন কোন মুসলিম সংবাদ-পত্র হইতে দুই-তিনটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করিতেছি। “সিয়াসত” পত্রিকার সম্পাদক মৌলানা সৈয়্যদ হাবিব সাহেব তাঁর “তাহরিকে কাদিয়ান” পুস্তকে লিখেন:-

“কাশ্মীরের মযলুমদের সাহায্যার্থে কেবলমাত্র দুটি জামা’তের সৃষ্টি হইয়াছে।”

(সৈয়্যদ হাবিবের এই পুস্তকের নাম হইতে ইহা বুঝা যায় যে, হইা একটি বিরুদ্ধাচরণমূলক পুস্তক। কিন্তু ঐ যুগে বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যেও কিছু না কিছু খোদাভীতি দেখিতে পাওয়া যাইত এবং তাহারা কখনো কখনো সত্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়া পড়িতেন। উল্লেখিত সম্পাদক এই ব্যাখ্যা দিতেছেন যে, এই সকল লোক অবশেষে কেন আহ্‌মদীয়া জামা’তের সহিত সামেল হন এবং এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, যাহার নেতৃত্ব দান করিতেছিলেন হযরত মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ সাহেব)। তিনি লিখেন যেঃ-

“কাশ্মীরের মযলুমদের সাহায্যার্থে কেবলমাত্র দুইটি জামা’তের সৃষ্টি হইয়াছে। একটি হইল কাশ্মীর কমিটি এবং অন্যটি হইল আহরার। তৃতীয় কোন জামা’ত কেহ তৈয়ার করে নাই এবং না তৈয়ার করিতে পারিত। আহরারদের উপর আমার বিশ্বাস ছিল না। এখন জগদ্বাসী স্বীকার করিতেছে যে, কাশ্মীরের এতিম, মযলুম ও বিধবাদের নামে টাকা পয়সা উঠাইয়া আহরাররা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত তাহা হজম করিয়া ফেলিয়াছে (ইহারা হইল ঐ আহরার দল, যাহাদিগকে আজ পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে)। তাহাদের মধ্যে একজন নেতাও এইরূপ ছিলেন না, যিনি পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে এই অপরাধে অপরাধী ছিলেন না। কাশ্মীর কমিটি তাহাদিগকে ঐক্যের আহ্বান জানাইয়া কর্মসূচী দিত। কিন্তু তাহাদিগকে একটি শর্ত দেওয়া হয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে এবং যথারীতি হিসাব-নিকাশ রাখিতে হইবে। তাহারা উভয় নীতিই মানিতে অস্বীকার করিল। এমতাবস্থায় কাশ্মীর কমিটির সঙ্গে থাকা ছাড়া আমার অন্য কোন উপায় ছিল না। আমি বজ্রনিনাদে ঘোষণা করিতেছি যে, কাশ্মীর কমিটির প্রেসিডেন্ট মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ সাহেব একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সহিত এবং জীবন উৎসর্গ করিয়া অত্যন্ত আবেগ উদ্দীপনার সহিত কাজ করিয়াছেন এবং নিজের অর্থও ব্যয় করিয়াছেন। এই কারণে আমি তাঁহাকে সম্মান করি।” (পৃষ্ঠা ৪২)

“ইনকিলাব” পত্রিকার সম্পাদক মৌলানা আবদুল মজিদ সালেক সাহেব তাঁর পুস্তক “সেরগুজাস্ত”-এ লিখেন যেঃ-

“যখন আহরাররা আহ্‌মদীদের বিরুদ্ধে অকারণে হাঙ্গামা বাধাইতে আরম্ভ করিয়া দিল এবং কাশ্মীর আন্দোলনে পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুন যে শক্তি সৃষ্টি হইয়াছে, যখন উহাতে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিল তখন মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ সাহেব কাশ্মীর কমিটির প্রেসিডেন্টের পদ হইতে ইস্তফা দিয়া দিলেন এবং ডক্টর ইকবাল ইহার প্রেসিডেন্ট হইলেন। কমিটির কোন কোন সদস্য এবং কর্মী কেবলমাত্র এই জন্য আহ্‌মদীদের বিরুদ্ধাচরণ আরম্ভ করিয়াছে যে, তাহারা আহ্‌মদী। এই পরিস্থিতি কাশ্মীর আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করিল।” (সেরগুজাস্ত, পৃষ্ঠা ২৪২)

এখন শুনুন, ঐ সময় হিন্দু পত্র-পত্রিকাগুলি কি লিখিতেছিল এবং হিন্দুরা মুসলমানদের কোন্ সম্প্রদায়ের নিকট হইতে বিপদ দেখিতেছিল এবং তাহাদের দৃষ্টিতে কাহারা কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য অস্থির হইয়া কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। ইহা সম্বন্ধে "মিলাপ” পত্রিকা ১লা অক্টোবর, ১৯৩১ সালের সংখ্যায় ৫ম পৃষ্ঠায় লিখে:-

“মির্যা কাদিয়ানী এই উদ্দেশ্যে অল্ ইণ্ডিয়া কাশ্মীর কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন, যাহাতে কাশ্মীরের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করিয়া দেওয়া যায় এবং এতদুদ্দেশ্যে তিনি কাশ্মীরের প্রতিটি গ্রামে প্রপাগাণ্ডা করিয়াছেন। ... ... তাহাদিগকে অর্থ কড়ি দিয়াছেন, তাহাদের নিকট আইনজ্ঞ প্রেরণ করিয়াছেন, গণ্ডগোল সৃষ্টি করার জন্য বক্তা প্রেরণ করিয়াছেন এবং সীমলায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণের সহিত ষড়যন্ত্র করিতে থাকেন।”

পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে আমি বলিতেছি যে, যে জামা’তকে তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বলিয়া সাব্যস্ত করিতেছ, তাহাদের সম্বন্ধে একটু খোদার ভয় কর। অন্যেরা তো এই জামা’তের বিরুদ্ধে সদা-সর্বদা এই অভিযোগ আনিতে থাকে যে, এই জামা’ত মুসলমানদের অধিকার আদায় ও হিত সাধন করার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়া থাকে। কুরআনী ভাষায় যদি এই জামা’ত “উজনুন” হয়, তাহা হইলে তাহারা হইল "উজুনুন খাইরেল্লাকুম” অর্থাৎ তোমাদের হিত ও কল্যাণ সাধনার্থে তাহারা কান-কথা শুনে এবং তোমাদের অকল্যাণের জন্য কান-কথা শুনেনা।

হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ)-এর উল্লেখ করিতে গিয়া "মিলাপ” পত্রিকা ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩১ সালের সংখ্যায় লিখে যেঃ-

“কাশ্মীরে কাদিয়ানী (অর্থাৎ হযরত খলীফাতুল সানী রাঃ - অনুবাদক) দুষ্টামীর আগুন লাগাইয়াছে। বক্তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। উর্দু এবং কাশ্মীরি উভয় ভাষাতেই ছোট ছোট প্যাম্ফলেট ও পুস্তিকা ছাপানো হইয়াছে এবং এইগুলি হাজার হাজার ছাপাইয়া বিনামূল্যে বিতরণ করা হইয়াছে। উপরন্তু টাকা পয়সাও বিতরণ করা হইয়াছে। (৫ম পৃষ্ঠা)
৫। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও জেহাদে আহ্‌মদীয়া জামা’তের দৃষ্টান্তমুলক ভূমিকা

উপমহাদেশের ইতিহাসে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুগ, যাহাকে মুসলমানদের অদৃষ্টগঠনকারী যুগ বলা যাইতে পারে এবং যখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত কঠোর জেহাদ ও সংগ্রাম করা হইতেছিল, উহা ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বের যুগ। ঐ সময় মুসলমানেরা জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ঐ সময় মুসলমানদের এইরূপ একটি আশ্রয়স্থলের প্রয়োজন ছিল, যেখানে তাঁহারা বিরুদ্ধবাদী শক্তিগুলির প্রভাব হইতে নিরাপদ থাকিতে পারিবে, যেখানে তাহাদের ধর্মের কোন বিপদ থাকিবে না, রাজনীতির কোন বিপদ থাকিবে না এবং জীবিকার্জনের কোন বিপদ থাকিবে না। বস্তুতঃ এই আশ্রয়স্থলের অন্বেষণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুসলমান চিন্তাবিদ কিছু চিন্তা-ভাবনা করেন, কিছু স্বপ্ন দেখেন এবং কিছু নকশা অংকন করেন এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তানের নকশা এইভাবে অংকিত হইল, যেন উহা সমগ্র মিল্লাতে ইসলামিয়ার ধ্বনি ছিল। ঐ অশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুগে আহ্‌মদীয়া জামাতের কি ভূমিকা ছিল, যাহাদের সম্বন্ধে আজ এই কথা বলা হইতেছে যে তাহাদের জন্য (অর্থাৎ আহ্‌মদীদের জন্য) মুসলিম দেশসমূহ বিপজ্জনক। এই জন্য কোন মুসলিম দেশ প্রতিষ্ঠায় আহ্‌মদীয়াতের সমর্থনতো দূরের কথা, কোন মুসলিম দেশ কায়েম থাকুক, ইহাও তাহারা সহ্য করিতে পারে না। তাহা হইলে দেখা প্রয়োজন, এই অশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুগে আহ্‌মদীয়া জামা’ত কি করিতেছিল এবং যে জামা’তকে আজ পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে তাহাদের ভূমিকা কি ছিল। এই বিষয়ে আমি অ-আহ্‌মদী পত্র-পত্রিকা হইতে কতিপয় উদ্ধৃতি উপস্থাপন করিতেছি। কেননা আজ ইতিহাসের চেহারা বিকৃত করা হইতেছে। পাকিস্তানের মুসলমানেরা এবং বিশ্ব মুসলিম একবার দেখুক, প্রকৃত মুসলিম কে ছিল এবং সত্যিকারার্থে কাহারা মুসলমানদের প্রতি প্রকৃত সহানুভূতিশীল ছিল, মুসলমানদিগকে ভালবাসিত এবং তাহাদের জন্য জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী ছিল। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত সৈয়্যদ রইস জাফরী তাঁহার “হায়াতে মোহাম্মাদ আলী জীন্নাহ্” (মোহাম্মদ আলী জীন্নাহ্‌র জীবনী) পুস্তকে “আসহাবে কাদিয়ান আওর পাকিস্তান” (কাদিয়ানের অধিবাসীবৃন্দ ও পাকিস্তান) শিরোনামে লিখেন:-

“এখন পাকিস্তানের ব্যাপারে আরও একটি বড় সম্প্রদায় কাদীয়ানবাসীদের পলিসি ও আচরণ পেশ করা হইতেছে। কাদিয়ানবাসীদের দুইটি জামা’তই মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং মিষ্টার জীন্নার রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বীকৃতিদানকারী এবং প্রশংসাকারী ছিল।”

ঐ যুগে মুসলমানদিগকে এই জেহাদ ও সংগ্রামে যে অসাধারণ দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল, উহার ইতিহাসতো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমানদের রক্তে এত অধিক পরিমানে হোলি খেলা হইয়াছিল যে, এই গোটা ইতিহাসকে একত্রিত করাতো সম্ভবপরই নয় এবং কোন হৃদয় এই বেদনাদায়ক ঘটনা-বলীর মধ্য দিয়ে পুনরায় অতিক্রম করার শক্তি রাখে না। কিন্তু ইহাই দেখিতে হইবে যে, যখন সক্রিয় জেহাদের সময় আসিল তখন মুসলমান সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আহরার ও জামা’তে ইসলামীর কি ভূমিকা ছিল এবং আহ্‌মদীয়া জামা’তের কি ভূমিকা ছিল? ঐ সময়টি কেবলমাত্র তবলীগি জেহাদের সময় ছিল না। ঐ সময়টি ছিল দৈহিক জেহাদের সময় এবং তলোয়ারের জেহাদের সময়ও আসিয়া গিয়াছিল। মুসলমান নারীদের মানইজ্জতের উপর যুলুমের এক হোলি খেলা চলিতেছিল এবং শিশুদিগকে আছাড় মারিয়া বর্শায় বিদ্ধ করা হইতেছিল। মোট কথা, লু্ঠিত কাফেলা গুলির সহিত যুলুমের এত মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করা হইয়াছিল যে, ইহা সবিস্তারে বর্ণনা করিতে কেহ পছন্দ করিবে না। যাহা হউক, সব মুসলমান সাধারণভাবে এই ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত আছে। আমি কেবলমাত্র এই কথা বলিতে চাহিতেছি যে, যখন সক্রিয় জেহাদের সময় আসিল তখন কাহারা মুসলমানদের জন্য জেহাদের প্রথম সারিতে যুদ্ধ করিতেছিল। ‘এহসান’ পত্রিকাটি একটি আহরারী পত্রিকা ছিল। বর্তমানে ইহা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। উক্ত পত্রিকা উহার ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালের সংখ্যায় লিখে:-

“কাদিয়ানের যুবকরা মিলিটারীর যুলুম নির্যাতন সত্বেও ভীত নয়। স্ত্রীলোক, শিশু এবং বৃদ্ধদিগকে এখান হইতে বাহির করিয়া দেওয়া তাহাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। তাহারা সম্পূর্ণরূপে অবগত আছে যে, মৃত্যু তাহাদিগকে ধীরে ধীরে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া আসিতেছে। নেহেরু সরকার বলিত যে, কোন মুসলমানকে পূর্ব পাঞ্জাব হইতে বাহির হইয়া যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হইবে না। কিন্তু তিনি কাদিয়ানের মুসলমানদিগকে সে স্থান হইতে বলপূর্বক বাহির করিয়া দিতে এবং তাহাদিগকে ধ্বংস করিয়া দিতে বদ্ধপরিকর (আজ এই কথা বলা হইতেছে যে, আহ্‌মদীরা ভারতের এজেন্ট) । “মহক্‌মা হিফাজতে কাদিয়ান” (কাদিয়ান প্রতিরক্ষা বিভাগ) এর অধীনে কর্মরত যুবকেরা কোন কোন সময় এক নাগাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করিয়া যাইতেছে এবং দিনরাত পাহারা দিতেছে।”

আমি নিজেও খোদাতা’লার ফজলে ইহাতে অংশ গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং আমার স্মরণ আছে যে, কোন কোন সময় এক নাগাড়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমানোর কোন উপায় ছিল না, কেননা পরিস্থিতিই এইরূপ ছিল। তদুপরি খোদ্দাম (অর্থাৎ স্বেচ্ছাসেবক) কম ছিল এবং কাজ ছিল বেশী। কোন কোন সময় যদি অল্প কিছুক্ষণের জন্য ঘুমানোর সময় পাওয়া যাইত, তখন মনে হইত যে আমরা পাপ করিতেছি এবং এইরূপ অনুভব করিতাম যে, আমরা কেন শুইয়া রহিয়াছি। অর্থাৎ আহমদী যুবকদের অনুভূতি তখন এইরূপই ছিল! এতদ্ব্যতীত কেবলমাত্র কাদিয়ানেই নহে, বরং ইহার চতুর্দিকে যত মুসলমান গ্রাম ছিল, তাহাদিগকে বাঁচাইতে এবং তাহাদের জন্য সংগ্রাম করার উদ্দেশ্যে কাদিয়ান হইতে মোজাহেদরা ঐ সকল গ্রামে যাইত। ইহা ঐ যুগের ঘটনা। বস্তুতঃ পত্রিকাটি আরও লিখে:-

“কোন কোন সময় এক নাগাড়ে চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি করিয়া যাইতেছে এবং দিনরাত্রি পাহারা দিতেছে। যদিও অনিদ্রা ও কষ্টের দরুন তাহাদের শরীর দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, তথাপি তাহারা মৃত্যুর ভয়ে পলায়নের পরিবর্তে মৃত্যুর মোকাবেলা করিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তথায় কোন মুসলমান মিলিটারী নাই। হিন্দু মিলিটারী ও শিখ পুলিশেরা তাহাদিগকে ভীতি প্রদর্শন করিতেছে ও ধমকাইতেছে! হিন্দু ক্যাপটেন গুলিভর্তি পিস্তল হাতে লইয়া ত্রাস বিস্তার করার জন্য এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করিতে থাকে।”

অতঃপর একই পত্রিকা ২রা অক্টোবর, ১৯৪৭ সালের সংখ্যায় আরও লিখে:-

“লম্বা চওড়া কথা লিখার সময় নাই। ... ... বর্তমানে আমরা কম বেশী ৫০ হাজার মানুষ (অর্থাৎ এই পত্রিকায় কোন অ-আহ্‌মদী মুসলমানের চিঠি ছাপানো হইয়াছে, যিনি ঐ সময় কাদিয়ানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি লিখেন যে,) কাদিয়ানে আশ্রয় লইয়া বসিয়া রহিয়াছি। আমরা আহ্‌মীদের তরফ হইতে বাঁচিয়া থাকার জন্য খাদ্য পাইতেছি। কেহ কেহ বাসস্থানও পাইয়াছে। কিন্তু এই জনবসতিতে এত বাড়ী ঘর-দুয়ার কোথায়? হাজার হাজার লোক আকাশের ছাদের নীচে মাটির বিছানায় পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারা তাপ-দাহও ভোগ করিতেছে এবং বৃষ্টিতেও ভিজিতেছে।”

এতদ্ব্যতীত পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হইতে "কারওয়ানে ছখ্‌ত জান” নামে একটি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে দেশ বিভাগের ইতিহাসের বিবরণ রহিয়াছে। পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের তরফ হইতে প্রকাশিত এই পুস্তক কাদিয়ানের কথা বলিতে গিয়া লিখিতেছে:

“এই স্থান ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুপরিচিত হওয়া ছাড়াও ইহা আহ্‌মদীয়া জামা’তের কেন্দ্র হওয়ার দরুন বিখ্যাত। ইহার চারিপাশের গোটা এলাকা শিখদের বাসস্থান। বস্তুতঃ দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় বিশ ত্রিশ মাইল দূরের মুসলমানেরাও কাদিয়ান শরীফে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আসিয়া গেল।”

গতকাল পর্যন্ত ইহা “কাদিয়ান শরীফ” ছিল। কিন্তু আজ তোমরা রাবওয়াকেও পৃথিবীর সব চাইতে অপবিত্র শহর রূপে আখ্যায়িত করিতেছ, নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক। তোমরা আরও বলিতেছ যে, যেভাবে ইহুদীদের ইসরাইল, তেমনিভাবে রাবওয়া হইল মির্যাইল, নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক। ঐ সময়তো তোমাদের কণ্ঠ হইতে সত্য কথা বাহির হইয়াছিল যে, কাদিয়ান বলিও না, ইহাতো হইল কাদিয়ান শরীফ। এখানে খোদার প্রিয়জনেরা বসবাস করিতেছে। খোদার প্রিয়জনেরা এই এলাকা আবাদ করিয়াছে এবং ইসলামের জন্য আত্ম-বিলীনকারী ব্যক্তিগণ এই এলাকায় আবাদ রহিয়াছেন। যতদিন পর্যন্ত এই সকল স্মৃতি এই এলাকার সহিত বিজড়িত থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত সুধীজন ইহাকে সর্বদা ‘কাদিয়ান শরীফ’ নামেই স্মরণ করিতে থাকিবেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সৌজন্যেরও প্রশংসা করিতে হয় যে, তাহারা সত্য প্রকাশ করিতে গিয়া এই আহরারী মৌলবীদিগের কোন পরোয়া করেন নাই।

উপরোক্ত পত্রিকায় আরও লেখা হয়, “এই সংখ্যা বাড়িতে বাড়িতে ৭৫ হাজার পর্যন্ত পৌঁছিয়া গেল।”

এই প্রসঙ্গে হযরত খলিফাতুল মসীহ রাবে আইঃ বলেন, আমার স্মরণ আছে যে, এই সকল আশ্রয় প্রার্থীকে নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করা হইতেছিল। যেহেতু বিপজ্জনক অবস্থা দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, সেইজন্য হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) বড়ই দূরদর্শীতার সহিত পরিস্থিতি অনুধাবন করিয়া সালানা জলসার প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশী গম সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ খোদাতা’লার ফজলে কাদিয়ানে একজন মুসলমানকেও অনাহারে মরিতে দেওয়া হয় নাই। বরং অভাবীদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়া যৌতুকের মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদও তাহাদের মধ্যে বিতরণ করা হইয়াছে। হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস (রাঃ) নিজের বেগমের মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ বিতরণ করিয়া এই কাজের সূচনা করেন। হযরত বেগম সাহেবার যেহেতু মালীর কোট্‌লার নবাব পরিবারের সহিত আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, সেইজন্য এই সকল পোষাক পরিচ্ছদের মধ্যে কোন কোনটি এত মূল্যবান ও প্রাচীন খান্দানী পোষাক ছিল যে, নষ্ট হইয়া যাওয়ার ভয়ে তিনি নিজেও ঐগুলি পরিধান করিতেন না। কিন্তু হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস (রাঃ) সকলের সম্মুখে এবং সর্বাগ্রে নিজ গৃহের কাপড়ের বাক্স খুলিতে আরম্ভ করেন এবং দেখিতে দেখিতেই ঐ সকল গরীব, যাহারা এইরূপ পোষাকের কথা স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না, তাহাদের মধ্যে এইগুলি বিতরণ করিয়া দেন এবং এই সকল পোষাক গ্রহণকারী প্রায় সকলেই অ-আহ্‌মদী মুসলমান ছিল। অতঃপর প্রত্যেক গৃহের প্রত্যেক কক্ষের প্রতিটি বাক্স খোলা হইল এবং যাহা কিছু ছিল সবই নিজেদের বিপদগ্রস্ত অ-আহমদী মুসলমান ভাইদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইল। অবশেষে আমি যখন কাদিয়ান হইতে বাহির হইলাম, তখন আমার নিকট একটি খাকী রঙ্গের থলিয়া ছিল। উহার মধ্যে মাত্র এক জোড়া কাপড় ছিল। ইহার অর্থ এই নয় যে, আমি কোন জিনিস আনিতে পারি নাই, বরং আমাদের সব কয়টি গৃহই খালি হইয়া গিয়াছিল। কেননা যাহা কিছু ছিল সবই বিতরণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল)।

“যেহেতু এই আশ্রয়প্রার্থীদিগকে যালিম ও লুণ্ঠনকারী শিখেরা সম্পূর্ণরূপে কপর্দকহীন ও নিঃস্ব করিয়া দিয়াছিল, এবং কাদিয়ানের অধিবাসীরা এই সকল হতভাগ্যের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছিল, কাজেই এত বড় দলের জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা কোন মামুলী কাজ ছিল না, বিশেষভাবে এইরূপ সময় যখন বাঁচিয়া থাকার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দিয়াছিল। বস্তুতঃ এই নিরক্ষর মেহমানরা কাদিয়ানের ভরণপোষণে ততদিন ছিল, যতদিন সরকার তাহাদিগকে ইহা করিতে বাধা প্রদান না করিল।” (কারওয়ানে শখ্‌ত জান, পৃঃ ১৪২, নাসের এদারাহ রাবেতা কুরআনী দফতর মহাসেবাত দফা পাকিস্তান, মার্চ ১৯৫১ খৃঃ)

“জমিদার” পত্রিকা উহার ১৯৪৭ সালের ৩রা অক্টোবর সংখ্যায় লিখে যেঃ-

“গুরুদাসপুর জেলার সীমিত সংখ্যক বাড়ীতে যদিও মুসলমানরা ঠাসাঠাসি অবস্থায় রহিয়াছে, তথাপি তিনটি ক্যাম্প খুবই বড়। (১) বাটালার আশ্রয় প্রার্থীদের অবস্থা খুবই খারাপ, (যাহাকে গতকাল পর্যন্তও ‘বাটালা শরীফ’ বলা হইতেছিল, কিন্তু যখন কার্যতঃ পরীক্ষার সময় আসিল তখন মুখ হইতে “শরীফ” শব্দটি বাহির হইল না। কেননা সেখানে মুসলমানদের দেখা শোনার কেহই ছিল না। ইহা সম্বন্ধে বলা হইতেছে যে) মাথা লুকাইবার জন্য না আছে কোন আশ্রয়, আহারের জন্য না আছে কোন খাদ্য দ্রব্য। হিন্দু সৈন্যরা কিয়ামতের অবস্থা সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে। অলংকারাদি এবং মালপত্র অনবরত ডাকাতি হইতেছিল। এখনতো স্ত্রীলোকদের মান-ইজ্জতের উপরও হস্তক্ষেপ করা হইতেছে। (২) দ্বিতীয় ক্যাম্প রহিয়াছে শ্রী গোবিন্দপুরায়। সেখানকার অবস্থাও বাটালার চাইতে কম ভয়াবহ নহে। (৩) তৃতীয় ক্যাম্প রহিয়াছে কাদিয়ানে। ইহাতে সন্দেহ নাই যে, মির্যায়ীরা কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য খিদমত করিয়াছে।”

“জমিদার” পত্রিকা আরো লিখে:-

“বর্তমানে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী আহ্‌মদীদের গৃহ হইতে রুটি খাইতেছে। কাদিয়ানের মুসলমানেরা সরকারের নিকট রেশনের জন্য আবেদন করে নাই এবং সরকার (অর্থাৎ একজন দারোগা ও কয়েকজন সিপাহী) কাদিয়ান হইতে খাদ্য শস্য আত্মসাৎ করিয়া সেখানকার অধিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদিগকে অনাহারে মারিতে চাহিতেছে। পৃথিবীতে কোন জাতির উপর ইহার চাইতে অধিক যুলুম নির্যাতন করা যাইতে পারে কি?” (‘জমিদার’ ১৬ই অক্টোবর, ১৯৪৭ ইং।)
৬। কোন কোন তথাকথিত মুসলমানদের দুঃখজনক ভূমিকা

হাঁ, আমি বলি যে, ইহার চাইতেও অধিক যুলুম নির্যাতন করা যাইতে পারে। ইহা একটি বাস্তব সত্য যে, অন্যদের হাতের যুলুম যতই তীব্র হউক না কেন, তাতে এত দুঃখ পাওয়া যায় না যতখানি দুঃখ অনুভব করা যায় আপনজনের হাতে কষ্ট পাইলে, বিশেষতঃ যে হাতের নিকট হইতে আশা করা হয় যে, উহা রক্ষা করিবে এবং যে মুখের নিকট হইতে আশা করা যায় যে, উহা সমর্থন জানাইবে। কিন্তু তাহা না করিয়া ঐ হাত যখন বিরুদ্ধাচরণের জন্য উঠিতে আরম্ভ করে এবং ঐ মুখ যখন কথার ছুরি চালাইতে আরম্ভ করে এবং আপনজনদের বিরুদ্ধাচরণ করিতে শুরু করে। আমি “জমিদার” পত্রিকার এই কলামিষ্টকে বলিতেছি যে, হাঁ, ঐ দুঃখ ইহার চাইতেও অধিক বেশী হইয়া থাকে এবং ঐ দুঃখ তোমাদের নিকট হইতে আসিয়াছে, ঐ দুঃখ মজলিসে আহরারদের নিকট হইতে মুসলমানরা পাইয়াছে এবং প্রত্যক্ষভাবে জামা’তে ইসলামীর নিকট হইতে ঐ দুঃখ মুসলমানরা পাইয়াছে। কোন হিন্দু বা শিখের হাতে পাওয়া দুঃখ এতটা নির্মম ছিল না, যতটা নির্মম ছিল আপনজনের হাতে পাওয়া দুঃখ। যদি আপনারা ভুলিয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনাদিগকে স্মরণ করানোর জন্য আমি জামা’তে ইসলামী সম্বন্ধে অ-আহ্‌মদী মুসলমানদের কতিপয় উদ্ধৃতি আপনাদের নিকট উপস্থাপন করিতেছি। কিন্তু ইহার পূর্বে মৌলবী মওদুদীরই একটি উদ্ধৃতি আমি উপস্থাপন করিতেছি। অতঃপর অন্যদের উদ্ধৃতি তাঁহার সম্বন্ধে উপস্থাপন করিব। ঐ যুগ ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেহায়েতই গুরুত্বপূর্ণ যুগ। যখন মুসলমানেরা জীবন-মরণ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল, তখন আহ্‌মদীয়া জামা’ততো কুরবানীতে অংশ গ্রহণ করিতেছিল সেই বিষয়ে আন্দোলনের দরুন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল, সেই বিষয়ে মওদুদী সাহেবের ধারণা কি ছিল এবং তাঁহার ফতওয়া কি ছিল ইহা সম্বন্ধে উল্লেখিত মাওলানা লিখিতেছেন :-

“এখানে রামদাসের পরিবর্তে আবদুল্লাহ, খোদার আসনে বসিলে তাহা ইসলাম হইবে না, বরং জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদও খোদার বিধানে ততখানি অভিশপ্ত, যতখানি অভিশপ্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ।” (মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ, দ্বিতীয় অংশ, পৃষ্ঠা ১২৫)

দেখুন, মুসলমানদিগকে কংগ্রেসের দাসে পরিণত করার জন্য কতই না বাহানা তালাশ করা হইতেছে। মওদুদী সাহেবের মতে কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের সমর্থনে সকল মুসলমানের শক্তি প্রয়োগ করা উচিত; কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদ বড়ই অভিশপ্ত। ইহার নিকটেও যাওয়া উচিত নয়। অতঃপর তিনি বলেন:-

“হিন্দুদের সহিত আমাদের কোন সাম্প্রদায়িক বিরোধ নাই এবং ইংরেজদের সহিতও আমাদের কোন বিরোধ নাই। আমাদের সংগ্রামের বুনিয়াদ হইল মাতৃভূমি। ঐ সকল রাষ্ট্রের সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক নাই, যেখানে তথাকথিত মুসলমান খোদা হইয়া বসিয়া আছে।”

যতদিন পর্যন্ত ঐ সকল রাষ্ট্রে তেল বাহির হয় নাই, ততদিন পর্যন্ততো কোন সম্পর্ক ছিল না। এখন তেলের সম্পর্ক যখন বাহির হইয়া গেছে, তখন এই বেচারারা কি করিবে! ইহাতো এইরূপ ঘটনা, যেমন হযরত খলীফাতুল মসীহ আউয়াল (রাঃ) (ইনি বিশ্ব আহ্‌মদীয়া জামা’তের প্রথম খলীফা ছিলেন। তাঁহার নাম হযরত হাফেজ হাকিম নুরুদ্দীন (রাঃ)-অনুবাদক) বলিতেন যে, একদা একজন মোল্লা বিবাহের উপর বিবাহ পড়াইয়া দিলেন। হযরত খলীফাতুল মসীহ আউয়ালের হৃদয়ে উক্ত মোল্লার জন্য বড় মর্যাদাবোধ ছিল। কেননা, তিনি নেকীর জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি বলিলেন, আমি মানিতে পারি না যে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে। লোকেরা নিবেদন করিল প্রকৃতপক্ষে এইরূপই ঘটিয়াছে। তিনি উক্ত মোল্লাকে ডাকিয়া ঘটনাটি যাচাই করেন। বস্তুতঃ তিনি (রাঃ) তাহাকে ডাকাইলেন এবং যথার্থতা নির্ধারণে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, “মাওলানা সাহেব আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে লজ্জা বোধ করিতেছি। ইহা হইতেই পারে না যে, আপনি বিবাহের উপর বিবাহ পড়াইয়া দিয়াছেন। কিন্তু লোকেরা ইহাই বলিতেছে।” তখন মোল্লা নিবেদন করিল, “আপনি অকারণে আমাকে অভিযুক্ত করিতেছেন। প্রথমে আমার কথাতো শুনুন।” তিনি (রাঃ) বলিলেন, “হাঁ, বলুন ব্যাপারটা কি?” মোল্লা নিবেদন করিল, “আমিও এই কথায় বিশ্বাসী যে বিবাহের উপর বিবাহ হইতে পারে না।” অতঃপর সে পাঞ্জাবী ভাষায় বলিল, “ইহা ঠিক যে, বিবাহের উপর বিবাহ হইতে পারে না। কিন্তু যদি এক পার্টি চড়ুই পাখীর সমান মুদ্রা (তখনকার যুগে রূপার মুদ্রার প্রচলন ছিল - অনুবাদক) হাতে গুঁজিয়া দেয়, তাহা হইলে মৌলবী বেচারা কি করিব।” সুতরাং ইহারা হইল জামা’তে ইসলামী, যাহারা গতকাল পর্যন্ত এই সকল মুসলমান রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্ক রাখিত না। তাহাদের মতে এই সকল রাষ্ট্রে মুসলমান খোদা সাজিয়া বসিয়া রহিয়াছিল। এখন এই সকল দেশে তেল বাহির হইয়াছে। এমতাবস্থায় এই বেচারা কি করিবে! তাহারা সম্পূর্ণরূপে নাচার। ধর্ম এক জিনিস এবং ধন-সম্পদ অন্য জিনিস। কাজেই যখন ধন-সম্পদের ব্যাপার আসিয়া উপস্থিত হয় তখন মৌলবী বেচারারা কি করিবে! বস্তুতঃ মৌলবী মওদুদী বলেন:-

“সংখ্যা লঘুদের হিফাযত করার আমাদের প্রয়োজন নাই (ইসলামের মুজাহিদদের অদ্ভুত ধারণা) এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হউক - ইহাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়।... … যাহা কিছু হাত ছাড়া হয়, হইতে দাও। সৈয়্যদনা মসীহ আঃ-এর কথা অনুযায়ী জুব্বা যদি হাত ছাড়া হয়, তাহা হইলে জামা পরিত্যাগের জন্যও প্রস্তুত হইয়া যাও।” (মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ, তৃতীয় অংশ, পৃঃ ১৪৭ হইতে ১৪৯)

হে যালিম! ঐ সময় সৈয়্যদনা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শিক্ষা কেন তোমার স্মরণ হয় নাই যে, যে মুসলমান নিজের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করিতে গিয়া মৃত্যু বরণ করে, সে শহীদ হইয়া থাকে। তোমার কেন স্মরণ হইল না যে, ঐ সময় কত মুসলমান স্ত্রীলোকের মান-ইজ্জত বিপদাপন্ন ছিল, তাহাদের সম্ভ্রম বিপদাপন্ন ছিল, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নামের মর্যাদা ক্ষুন্ন হইতেছিল, মুসলমান জাতির টিকিয়া থাকার প্রশ্ন ছিল এবং মুসলমান জাতির স্থিতির প্রশ্ন ছিল। ঐ সময় সৈয়্যদনা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কোন বাণী তোমার স্মরণ হয় নাই। ঐ সময় তোমার যাহা স্মরণ হইল তাহা সৈয়্যদনা মসীহ আঃ-এর এই কথা যে – ‘জুব্বা যদি হাত ছাড়া হয়, তাহা হইলে জামাও পরিত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হইয়া যাও।’ কিন্তু আজ তোমরা আমাদের সম্বন্ধে এই কথা বল যে, আমরা জিহাদ বিরোধী।

অতঃপর মওদুদী সাহেব আরও বলেন:-

“যাহারা এই ধারণা পোষণ করে যে, যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রাধান্য হইতে স্বাধীন হইয়া যায় এবং সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায় তাহা হইলে এইভাবে খোদায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হইয়া যাইবে - তাহাদের এই ধারণা ভ্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে ইহার দরুন যাহা কিছু অর্জিত হইবে, তাহা হইবে কেবলমাত্র মুসলমানদের কাফিরী সরকার (আজ যে সরকারের সমর্থনে ইহারা বলিতেছে যে খোদার ফরমান জারী হইতেছে, বিগত দিন পর্যন্ত ইহারা এই কথা বলিতেছিল যে) যাহা কিছু অর্জিত হইবে, তাহা কেবল মুসলমানদের কাফিরী সরকার মাত্র। ইহার নাম খোদায়ী সরকার রাখায় এই পবিত্র নামের অবমাননা করা হয়।” (মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ, তৃতীয় অংশ, পৃঃ ১৭৫-১৭৬)

“নাওয়ায়ে ওয়াক্ত” পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হামিদ নিযামী সাহেব জামা’তে ইসলামী সম্বন্ধে সত্য কথা বলিয়াছেন এবং খুব জোরের সহিত এই ধারণা ব্যক্ত করিয়াছেন যেঃ-

“আমরা অভিযোগ করিতেছি যে, কায়েদে আযম ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদুদীর প্রতিহিংসা আজও পূর্বের মতই কায়েম রহিয়াছে। আমরা অভিযোগ আনিতেছি যে, মাওলানার আন্দোলন কখনো একটি ইসলামী ও ধর্মীয় আন্দোলন নয়। তিনি হোসেন বিন সাব্বাহের ন্যায় রাজনৈতিক চাল চালিয়েছেন এবং ধর্মকে সমুন্নত করার পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করাই তাঁহার লক্ষ্য।” (নাওয়ায়ে ওয়াক্ত, ১৫ই জুলাই ১৯৫৫ ইং, পৃষ্ঠা ৩)

যখন মৌলবী মওদুদী সাহেবের নিজের লেখা হইতে এই সকল কথা সপ্রমাণিত হয়, তখন এই সকল অভিযোগ রদ করার কোন অবকাশতে দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু কেবলমাত্র ইহার উপর নির্ভর করার প্রয়োজন নাই। বরং আরও বিশ্লেষণ করিয়া দেখা প্রয়োজন যে, কাহারা পাকিস্তানের বন্ধু, কাহারা দুশমন, কাহারা সহোদর এবং কাহারা বৈমাত্রেয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৩ সালে আহমদী বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধে তদন্ত করার জন্য একটি আদালত গঠন করে। ইহার বিচারকগণের মধ্যে জাষ্টিস মুনীর অন্যতম ছিলেন। তাঁহার নাম সমগ্র বিশ্বে খ্যাত। তিনি একজন অতি উচ্চ পর্যায়ের আইনজ্ঞরূপে সুপরিচিত। এই আদালতের অন্যতম বিচারক ছিলেন জাষ্টিস কায়ানী। তাঁহারা উভয়েই এই আদালতের সদস্য ছিলেন। তাঁহারা নিজেদের রিপোর্টের ৩৬১ পৃষ্ঠায় জামা’তে ইসলামী সম্বন্ধে লিখেন:-

“জামা’তে ইসলামী মুসলিম লীগের ও পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকাশ্য ও খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণকারী ছিল। যখন হইতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তখন হইতে ইহারা এই দেশকে ‘নাপাকিস্তান’ আখ্যায়িত করিয়া আসিতেছে। এই জামা’ত দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও ইহার শাসকগণের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে। আমাদের নিকট জামা’তের যে সকল লেখা উপস্থাপন করা হইয়াছে, উহাদের মধ্যে এইরূপ একটি লেখাও নাই, যাহার মধ্যে পাকিস্তান দাবীর দূরতম ইঙ্গিতও রহিয়াছে।”

আজিও পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হইতেছে এবং পূর্বেও জামা’তে ইসলামী নিজেদের কোন কোন লেখা উপস্থাপন করিতেছিল যে, তাহারা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল না। বস্তুতঃ তদন্তকারী আদালতে জামা’তে ইসলামীর তরফ হইতে ঐ সকল লেখা যখন উপস্থাপন করা হইল, তখন ঐগুলি সম্বন্ধে তদন্ত রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করা হইতেছে যে:-

“উহাদের মধ্যে এইরূপ একটি লেখাও নাই, যাহার মধ্যে পাকিস্তান দাবীর দূরতম ইঙ্গিতও রহিয়াছে। ইহার বিপরীত আদালতের নিকট এইরূপ লেখা মওজুদ রহিয়াছে, যাহার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জামা’তে ইসলামী পাকিস্তান দাবীর বিরুদ্ধাচরণকারী ছিল।”

ইহাইতো ছিল জামা’তে ইসলামীর ভূমিকা, যাহারা আহমদীয়া জামা’তের প্রথম সারির দুশমন। আহমদীয়া জামা’তের দুই নম্বরের দুশমন হইল মজলিসে আহরার, যাহারা বর্তমানে আমাদের হতভাগ্য সরকারের উপর চাপিয়া বসিয়াছে। এই মুসলিম দেশ (পাকিস্তান) প্রতিষ্ঠার সময় আহরার জামা’তের কি ভূমিকা ছিল? ঐ সময় যখন মুসলমানেরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে জাতীয়তার সংগ্রাম ও জিহাদে নিয়োজিত ছিল এবং তাহাদের স্থিতির জন্য একটি বড়ই কঠোর সংগ্রাম করিতে হইতেছিল, তখন আহারারী আলেমরা মুসলমানদিগকে যে শিক্ষা প্রদান করিতেছিল, উহা সম্বন্ধে কতিপয় উদ্ধৃতি আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করিতেছি। আমীরে শরীয়ত আতাউল্লাহ শাহ্‌ বোখারী লিখেন:-

“তোমরা হিন্দুদিগকে ভয় পাইতেছ যে, তাহারা তোমাদিগকে খাইয়া ফেলিবে (তাহাদিগকে ভয় পাওয়ার কোন প্রয়োজন নাই এবং না কোন পৃথক দেশের প্রয়োজন আছে)। আরে! যাহারা মুরগীর একটি রানও খাইতে পারে না তাহারা তোমাদিগকে কিভাবে খাইয়া ফেলিবে? হিন্দুদেরই তোমাদিগকে ভয় পাওয়া উচিত। কেননা তাহারা তোমাদের চাইতে দুর্বল। তাহারা মাত্র ছয়টি প্রদেশে রহিয়াছে; তোমরা রহিয়াছ সকল সীমান্তে।” (রইসুল আহরার, পৃষ্ঠা ২০৫)

তিনি আরও বলেন:-

“সুবাহানাল্লাহ! বলা হইতেছে যে, হিন্দুরা আমাদিগকে খাইয়া ফেলিবে। মুসলমানেরা গোটা উট খাইয়া ফেলে, গোটা মহিষ খাইয়া ফেলে। তাহাদিগকে হিন্দুরা কিভাবে খাইয়া ফেলিবে?”
(সৈয়্যদ আতাউল্লাহ শাহ্ সাহেব বোখারী এবোটাবাদে প্রদত্ত বক্তৃতা, তরজমানে ইসলাম পত্রিকা, লাহোর ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬১ ইং, পৃষ্ঠা ১২) এই হইল তাহাদের জেহাদ! তাহারাতো খাওয়ার বেলায় গাজী। উট এবং মহিষতো খাইয়া থাকে। কিন্তু যখন অন্য জাতি কার্যতঃই ইহাদিগকে খাইয়া ফেলিতে আসে, তখন ইহারা জেহাদের ধারে কাছেও থাকে না। ঐ সময় যদি কেহ ইহাদিগকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের জীবন ও সম্পদ কুরবান করার জন্য আগাইয়া আসে, তাহারা আহ্‌মদীয়া জামা’তের যুবক ও মোজাহিদবৃন্দ। প্রত্যেক যুগে এই ঘটনাই ঘটিয়াছে এবং বার বার ইহার পুনরাবৃত্তি হইয়াছে। আপনারা জেহাদের ময়দানের অনেক দূরেও কোন আহরারীকে বা জামা’তে ইসলামীর লোককে দেখিতে পাইবেন না। তাহাদের কতজন প্যালেষ্টাইনে গিয়া খেদমত করিতেছে? তাহাদের কতজন কাশ্মীর আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করিয়াছে? তাহাদের কতজন কাশ্মীর আন্দোলনের পরবর্তী যুদ্ধেঅংশ গ্রহণ করিয়াছে? একটি ক্ষেত্র দেখাইয়া দিন, যেখানে ইসলাম বা মুসলমানদের বিপদে এই সকল লোক প্রথম সারিতো দূরের কথা, শেষ সারিতে দাঁড়াইয়াও সংগ্রাম করিয়াছে? ইকবালের নাম আজ জপা হইতেছে এবং বলা হইতেছে যে, তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁহার পাকিস্তানী ধারণা একটি ইলহামী (ঐশী বাণীর) মর্যাদা রাখে। কিন্তু গত কাল এই সকল লোক কি বলিতেছিল? এই আহরারীরাই বলিতেছিল:-

"নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের ধারণা একটি ‘রাজনৈতিক ইলহাম’। কিন্তু ইহা খোদার ইলহাম নহে; বরং ইহা ‘বাকিংহাম প্রাসাদের ইলহাম’। ডক্টর ইকবাল যখন অতি সম্প্রতি লণ্ডন হইতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাঁহার উপর এই ইলহাম অবতীর্ণ হইয়াছিল।” (“তাহরিকে পাকিস্তান পর এক নজর,” পৃষ্ঠা ২৮-২৯, হযরত আল্লামা আল্-হাজ্ব মোহাম্মাদ হাফেজুর রহমান সাহেব সৈয়্যহারবী, নাযেমে আলা, মরকযীয়া জমিয়াতুল ওলামায়ে হিন্দ)

ইলহাম কাহার তরফ হইতে হইয়া থাকে এবং কি ইলহাম হয় ইহার সকল গুঢ়রহস্য তো আহরাররাই অবগত আছে। উক্ত ইলহাম কি আল্লাহ্‌র তরফ হইতে হইয়াছিল, নাকি বাকিংহাম প্রাসাদ হইতে হইয়াছিল - ইহা আহরাররা তৎক্ষণাৎ জানিয়া ফেলে, কেননা উভয় স্থানে তাহাদের পাহারাদার রহিয়াছে। বস্তুতঃ আজকাল তাহারা বলে, পাকিস্তান সম্বন্ধে এই ইলহাম আল্লামা ইকবালের নিকট আল্লাহ্‌তা’য়ালার পক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু গতদিন পর্যন্তও তাহারা বলিতেছিল যে, ইহা বাকিংহাম প্রাসাদের ইলহাম। মৌলবী জাফর আলী খান সাহেব “চমনস্তান” পুস্তকে একজন বিখ্যাত ও স্বীকৃত আহরারী নেতা মৌলবী হাবিবুর রহমান সাহেবের (ইনি ঐ যুগে মজলিসে আহরারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন) কথা উল্লেখ করিতে গিয়া বর্ণনা করেন, তিনি কিভাবে মুসলমানদের মোকাবেলায় হিন্দুদের খেদমত করিয়াছেন এবং হিন্দু নেতাদিগকে মুসলমানদের প্রিয়ভাজন করিয়া তোলার জন্য কিরূপ আশ্চর্যজনক কীর্তি-কলাপ করিয়াছেন। এইগুলির মধ্যে একটি কীর্তির বিবরণ দিতে গিয়া তিনি লেখেন:-

“মিরাটে মজলিসে আহরারের প্রেসিডেন্ট মৌলবী হাবিবুর রহমান লুধিয়ানবী এতই উত্তেজিত হইয়া পড়েন যে, তিনি দাঁত পিষিতেছিলন এবং ক্রোধান্বিত হইয়া নিজের ঠোঁট কামড়াইতেছিলেন যে, দশ হাজার জিন্নাহ, শওকত ও জাফরকে জওহরলাল নেহরুর জুতার অগ্রভাগের জন্য কুরবানী করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।” (চমনস্তান, পৃষ্ঠা ১৬৫)

ইহা ছিল তাহাদের জেহাদের আবেগ ও উদ্দীপনা। অতঃপর মৌলবী হাবিবুর রহমান সাহেব যখন ধর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়েন, তখন আকাশ চক্ষু মেলিয়া কি দৃশ্য দেখিয়াছিল তাহাও লক্ষ্যণীয়। এই প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটি ‘রইসুল আহরার’ পুস্তকের ৭৪ ও ৭৫ পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত হইয়াছে:-

“১৯২৮ সালে অল ইণ্ডিয়া মুসলিম কাশ্মীর কনফারেন্স লুধিয়ানায় অনুষ্ঠিত হয়। মৌলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানবী খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ সাহেবের মাধ্যমে পণ্ডিত মতিলাল নেহরুকে কাশ্মীর কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট করেন।”

ইহা শুনার মত ব্যাপার যে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর পিতা পণ্ডিত মতিলাল নেহরুকে কাশ্মীর কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট করা হইয়াছে। আরও লেখা হইয়াছে যে:-

“কনফারেন্সে বড় বড় মুসলমান কাশ্মীরী ব্যবসায়ী পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর গাড়ী নিজেদের হাত দ্বারা টানিয়াছিল। এক লক্ষ হিন্দু ও মুসলমান এই কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। ইহা ঐ সময় ছিল যখন নেহরু রিপোর্টের দরুন পাঞ্জাবে হিন্দু, শিখ ও মুসলমানেরা পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর কঠোর বিরোধিতা করিতেছিল। কিন্তু আহরারী নেতা মাওলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানবীর এই রাজনৈতিক কৌশল বাতাসের গতির পরিবর্তন করিয়া দিল।”

দেখুন, আহরাররা কিরূপ ইসলামের মহান মোজাহেদ সৃষ্টি করিয়াছে। এখানেই শেষ নহে। ঐ যুগে পূর্ববঙ্গে কি হইতেছিল - উহার কাহিনী যদি আপনারা ১৯৫৫ সালের ২৬শে মার্চ করাচীর ‘তুলুয়ে ইসলাম’ পত্রিকার ১১ পৃষ্ঠা পড়িয়া দেখেন তাহা হইলে অবাক হইবেন যে এই সকল লোক ঐ সময় সেখানে কি করিতেছিল। বস্তুতঃ লেখা হইয়াছে যে:-

“১৯৪৬ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হইল। এই নির্বাচন পাকিস্তানের নামে হইতেছিল। নির্বাচন উপলক্ষে কলিকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানের অনেক মুসলিম লীগ নেতা পূর্ববঙ্গ সফর করেন এবং জনগণের নিকট পাকিস্তানের প্রয়োজনীতার কথা ব্যাখ্যা করিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। মুসলিম লীগ নেতাগণের প্রভাব লক্ষ্য করিয়া এবং জনগণকে পাকিস্তান সমর্থনের প্রতি ঝুঁকিয়া পড়িতে দেখিয়া হিন্দুরা নিজেদের কেনা মৌলবীদিগকে মুসলিম লীগ নেতাগণের শক্তিকে খর্ব করার জন্য প্রেরণ করিল। “জাফরী আত্মার” এ সকল বলিষ্ঠ দেহধারী মৌলবীরা নিজেদের বক্তৃতায় মুসলিম লীগ নেতাগণের উপর কুফরের ফতওয়া লাগাইয়া দিল। ইহারা পাকিস্তান আন্দোলনকে ইংরেজদের রোপিত বৃক্ষ বলিয়া আখ্যা দিল এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারের চেষ্টা করিল, যাহাতে এই আন্দোলন জনগণের নিকট গৃহীত না হয়।”

এখন আমি আহ্‌রারদের সম্বন্ধে জাষ্টিস মুনীর ও জাষ্টিস কায়ানীর রিপোর্ট হইতে দুই একটি উদ্ধৃতি পড়িয়া শুনাইতেছি। ইহা হইতে আপনারা অনুমান করিতে পারিবেন যে, তাহারা জামা’তে ইসলামীর ন্যায় কোন তওবা করে নাই এবং পাকিস্তানের ধারণাকে পূর্বেও গ্রহণ করে নাই এবং পরেও গ্রহণ করে নাই। বরং তাহারা লোকদিগকে পূর্বের ন্যায় ধোকা দিতে ও প্রতারণা করিতে থাকে এবং নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যাবলী চরিতার্থ করার জন্য ইসলামের পবিত্র নাম ব্যবহার করিতে থাকে। বস্তুতঃ জাষ্টিস মুনীর-কায়ানী রিপোর্টের ১৫০ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে:-

“আহরারদের অতীত হইতে সুস্পষ্ট যে, তাহারা দেশ বিভাগের পূর্বে কংগ্রেস ও অন্যান্য জামা’তের সহিত মিলিত হইয়া কাজ করিতেছিল, যাহারা কায়েদে আযমের সংগ্রাম ও জেহাদের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হইতেছিল। ... ... এই জামা’ত এখন পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে অন্তর হইতে মানিয়া নেয় নাই।” (মুনীর-কায়ানী রিপোর্টে ১৯৫৩ সালের দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে)।

আহরারদের উদ্দেশ্যাবলীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়:-

“মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করা এবং পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা সম্বন্ধে জনগণের আস্থা বিনষ্ট করাই হইল এই সকল লোকদের উদ্দেশ্যে। ধর্মের পোষাক পরিয়া মতভেদের আগুন জ্বালাইয়া দেওয়া এবং মুসলমানদের ঐক্যকে নসাৎ করিয়া দেওয়াই হইল এই গোলমালের লক্ষ্য এবং ইহা সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে।” (তদন্ত রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ১৫০)

অতঃপর এই রিপোর্টেরই ২৭৮ পৃষ্ঠায় নিম্নলিখিত ভাষায় আহরারদের উল্লেখ করা হইয়াছে:-

“আহরারদের আচরণ সম্বন্ধে আমরা নরম ভাষা ব্যবহার করিতে অপারগ। ইহাদের কর্ম পদ্ধতি বিশেষভাবে অপবিত্র ও ঘৃণ্য। কারণ ইহারা একটি পার্থিব উদ্দেশ্যে একটি ধর্মীয় বিষয়কে ব্যবহার করিয়া এই বিষয়টির অবমাননা করিয়াছে।”

অতঃপর এই একই রিপোর্টের ২৭৫ পৃষ্ঠায় আহরার নেতা মৌলবী মোহাম্মদ আলী জলন্ধরীর উল্লেখ করিতে গিয়া লিখা হয় যে:-

“মৌলবী মোহাম্মদ আলী জলন্ধরী ১৫ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৩ সালে লাহোরে বক্তৃতা করিতে গিয়া স্বীকার করেন যে, আহরাররা পাকিস্তানের বিরোধী ছিল। এই বক্তা দেশ বিভাগের পূর্বে এবং দেশ বিভাগের পরেও পাকিস্তানের জন্য ‘পলিদিস্তান’ (অপবিত্রস্থান) শব্দটি ব্যবহার করিতেন এবং..... সৈয়্যদ আতাউল্লাহ শাহ বোখারী এক বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তান একটি ‘পতিতা স্ত্রীলোক।’ আহরাররা ইহাকে অপারগ ও বাধ্য হইয়া গ্রহণ করিয়াছে।”
৭। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য আরও একটি অপবিত্র আন্দোলন

ইহা হইল ইসলামের মোজাহিদদের কীর্তি। কিন্তু তাহাদের কীর্তির কাহিনী এখনো শেষ হয় নাই। বরং তাহাদের সংগ্রাম ও জিহাদ এখন একটি জটিল যুগে প্রবেশ করিয়াছে। আহরারীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছে। কখনো তাহারা আহ্‌মদীয়া জামা’তকে লইয়া বাহানা বানাইয়াছে এবং কখনো অন্য কোন বাহানা তালাশ করিয়া পাকিস্তানকে বিনাশ করার জন্য যে সকল প্রচেষ্টা তাহাদের করার ছিল, তাহা তাহারা করিয়াছে। কিন্তু প্রত্যেকবার আল্লাহ্‌তা’লার দয়া পাকিস্তানকে রক্ষা করিয়াছে এবং তাহারা লাঞ্ছনাকর পরাজয় বরণ করিয়াছে এবং নিজেদের লক্ষ্য সিদ্ধি করিতে অকৃতকার্য ও ব্যর্থ হইয়াছে। কিন্তু এখন এই আন্দোলন একটি মারাত্মক বিপজ্জনক যুগে প্রবেশ করিতেছে এবং প্রবেশ করিয়াছে। পাকিস্তানের প্রাণতো হইল কলেমা তওহীদ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”। ইহার শক্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হইয়াছে এবং এই কলেমা তওহীদকে নিশ্চিহ্ন করিতে পারিলেই পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। অতএব এই হতভাগ্যরা অবশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে যে, কলেমা তওহীদকে নিশ্চিহ্ন করিতে হইবে। তাহাদের এই কথাতো ঠিক; কিন্তু তাহাদের পদক্ষেপ নেহায়েতই অপবিত্র, ঘৃণ্য এবং অবমাননাকর। ইহাই মনে হইতেছে যে, এখন একটি পরিকল্পনার অধীনে তাহারা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে যে, এই দেশকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যদি কলেমা তওহীদকে নিশ্চিহ্ন করিতে হয়, তাহা হইলে তাহারা তাহাই করিয়া ছাড়িবে। বস্তুতঃ এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে একটি সাধারণ আন্দোলন চালানো হইয়াছে। কিন্তু এই দেশের নিতান্ত দুর্ভাগ্য যে ঐ সকল লোক, যাহারা দেশ রক্ষার জন্য মনোনীত ছিল, যাহাদের উপর এই কাজ ন্যস্ত করা হইয়াছিল যে, যেদিক হইতেই পাকিস্তানের আত্মার উপর বিপদ আসুক না কেন তাহারা ইহার মোকাবেলায় সংগ্রাম করিবে এবং ইহার প্রতিরক্ষায় নিজেদের সব কিছু কোরবান করার জন্য প্রস্তুত হইয়া যাইবে, আজ তাহাদিগকেই এজেন্ট বানাইয়া কলেমা তওহীদ অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রাণের উপর হামলা করা হইতেছে। এই ব্যাপারে আমাদের নিকট যে সকল ঘটনা প্রকাশিত হইতেছে, ঐগুলি হইতে মনে হইতেছে হযরত আকদাস মসীহ মাওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের একটি ইলহাম পূর্ণ হওয়ার যুগ আসিয়া গিয়াছে এবং জগদ্বাসীর মতামত ও ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন হইতেছে। বস্তুতঃ কলেমা নিশ্চিহ্ন করার আন্দোলনের ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক এইরূপ চিঠি-পত্র ও সংবাদাদি পাওয়া যাইতেছে যে, পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা যখন পুলিশকে কলেমা নিশ্চিহ্ন করার জন্য আদেশ দিল তখন তাহারা মসজিদে উপস্থিত হইল। কিন্তু আহ্‌মদীদের বিগলিত দো’আর ফলে তাহাদের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল এবং তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ কলেমা নিশ্চিহ্ন করিতে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিল।

বস্তুতঃ একদা একজন ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার সহিত আগত পুলিশ বাহিনীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিল যে, ইহারা (আহ্‌মদীরা) ইউনিফর্মধারী লোক ছাড়া অন্য কাহাকেও কলেমা নিশ্চিত করিতে দিবে না। ইহারা তো জীবন বাজী রাখিয়া বসিয়াছে, কিন্তু ইহারা বলে যে, যদি সরকার নিশ্চিহ্ন করে তাহা হইলে ইহারা বাধা দিবে না। কেননা এমতাবস্থায় আল্লাহ্ ও সরকারের মধ্যে বুঝাপড়া হইবে। যখন উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেট মাত্র এতটুকু বলিল তখন এস, এইচ, ও, বলিল যে, ইহাতো পরে দেখা যাইবে; প্রথমে বলুন যে কলেমা কে নিশ্চিহ্ন করিবে? তিনি বলিলেন, নিশ্চয় তোমাকেই নিশ্চিহ্ন করিতে হইবে এবং এইজন্যই তোমাকে সঙ্গে করিয়া আনা হইয়াছে। ইহাতে এস, এইচ, ও, বলিল, এই রহিল আমার পেটি এবং এই রহিল আমার ষ্টার, যেখানে মর্জি নিয়া যান। কিন্তু খোদার কসম আমি কলেমা নিশ্চিহ্ন করিব না এবং আমার বাহিনীর কেহই কলেমা নিশ্চিহ্ন করিবে না। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন, কলেমা কে নিশ্চিহ্ন করিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সকল কথা অর্থহীন যে, কিভাবে কলেমা নিশ্চিহ্ন করা হইবে। এই ধরণের একটি ঘটনাই ঘটে নাই! পাকিস্তানের সর্বত্রই এইরূপ অনেক ঘটনা ঘটিতেছে। যে পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানে সবচাইতে অধিক কুখ্যাত বলিয়া সর্বজন বিদিত এবং যাহাদিগকে যালেম, নিষ্ঠুর, ধর্মহীন ও নির্লজ্জ বলা হইয়া থাকে এবং সব ধরণের মন্দ নামে আখ্যায়িত করা হইয়া থাকে, কিন্তু কলেমার প্রতি ভালবাসা এত মহান এবং কলেমার শক্তি এত আশ্চর্যজনক যে, তাহাদের হৃদয়েও পরিবর্তন সূচিত হইতেছে। এক স্থান হইতেই নয় বিভিন্ন স্থান হইতে বারবার এই সংবাদ পাওয়া যাইতেছে যে, পুলিশ কলেমা নিশ্চিহ্ন করিতে সরাসরি অস্বীকার করিয়াছে এবং এই কথা বলিয়াছে যে, অন্য কাহাকেও পাকড়াও কর, যে কলেমা নিশ্চিহ্ন করিবে; আমরা ইহার জন্য প্রস্তুত নই।

অনুরূপভাবে কোন ম্যাজিষ্ট্রেট সম্বন্ধে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে যে, তাহারা বড়ই চিন্তামগ্ন অবস্থায় নত মস্তকে আগমন করিল, ক্ষমা ভিক্ষা চাহিল এবং নিবেদন করিল যে, আমরাতো নাচার, আমরা সরকারের কর্মচারী, তোমরা আমাদের খাতিরে কলেমা নিশ্চিহ্ন কর। আহ্‌মদীরা বলিল যে, আমরাতো পৃথিবীর কোন শক্তির খাতিরেও কলেমা নিশ্চিহ্ন করিতে প্রস্তুত নই। তোমরা যদি বলপূর্বক নিশ্চিহ্ন করিতে চাও, তবে নিশ্চিহ্ন কর। তখন ম্যাজিষ্ট্রেট বলিল যে, আচ্ছা সিঁড়ি আন। তখন উত্তরে বলা হইল, আমাদের হস্ত সিঁড়িও বহন করিয়া আনিবে না। অতঃপর তাহারা অন্য কাহারো দ্বারা সিঁড়ি আনাইল এবং এক ব্যক্তিকে কলেমা চিহ্ন করার জন্য উপরে চড়াইল। তখন আহ্‌মদীয়া মসজিদ হইতে এত বেদনাতুর কণ্ঠে উচ্ছ্বসিত কান্নার রোল পড়িয়া গেল যে, এইরূপ মনে হইতেছিল যেন তাহাদের সব কিছু বরবাদ হইয়া গিয়াছে এবং তাহাদের কেহ আর জীবিত নাই। অকস্মাৎ দেখা গেল, কাঁদিতে কাঁদিতে স্বয়ং ম্যাজিষ্ট্রেটেরও হেঁচকি উঠিয়া গেল এবং কলেমার উপর হাতুড়ির একটি ঘা পড়িতে না পড়িতেই ম্যাজিস্ট্রেট বলিয়া উঠিলেন, ফিরিয়া আইস; আমরা এই কলেমা নিশ্চিহ্ন করিব না। সরকার আমার সহিত যাহা মর্জি আচরণ করুক। আমি ইহার জন্য প্রস্তুত আছি।

সুতরাং ঘটনাবলী আশ্চর্যজনকভাবে সংঘটিত হইতেছে এবং যখনই এইরূপ কোন ঘটনা ঘটে তখন হযরত মসীহ মাওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের এই ইলহাম আমার স্মরণ হইয়া যায়, يوم تبدل الارض غير الارض পৃথিবীতে বসবাসকারীদের মতামত পরিবর্তিত করিয়া দেওয়া হইবে এবং তাহাদের ধ্যানধারণায় বিপ্লব ঘটানো হইবে। যদিও আল্লাহতা’লার ফযলে মুসলমানদের হৃদয়ে কলেমার জন্য মর্যাদাবোধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মওজুদ দেখিতে পাওয়া যায় এবং কলেমা নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে তাহারা সরকারের সহিত সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত নয়, তথাপি কোন কোন ক্ষেত্রে নেহায়েতই ঘৃণ্য ঘটনাবলী সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে এবং এইগুলি দেখিয়া হৃদয়ে ভীতির সৃষ্টি হইতেছে যে, আল্লাহ্‌তা’লা এই সকল যালেমের দরুন এই দেশকে (পাকিস্তান) না শাস্তি দিয়া দেয়। একদা একজন ছাত্রকে একজন পুলিশ বাস হইতে টানিয়া বাহির করিল। সে কলেমার ব্যাজ লাগাইয়াছিল - এই অপরাধে তাহাকে থানায় লইয়া গেল। কলেমার ব্যাজ লাগানোর অপরাধে সেখানে পাঁচশত টাকা জরিমানা নির্ধারিত হইল এবং তাহাকে মারপিটও করা হইল। উক্ত ছাত্র বলিল যে, আমার নিকট পাঁচশত টাকাতো নাই, মাত্র তিনশত টাকা আছে। কিন্তু কলেমা সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, আমি ইহা নামাইব না। যদি তোমাদের শক্তি থাকে, তবে নিশ্চয় ছিনাইয়া লও; কিন্তু আমার হৃদয় হইতে কিভাবে কলেমা ছিনাইয়া লইবে? উহাতো তারপরেও আমার হৃদয়েই থাকিবে। ইহাতে পুলিশের লোকেরা বললি যে, আচ্ছা, আমরা তোমাকে এখনই বুঝাইয়া দিব কিভাবে কলেমা ছিনাইয়া লইতে হয়। বস্তুতঃ তাহারা তাহাকে থানার বাহিরে লইয়া গেল এবং একটি পুলের নীচে রাখিয়া তাহাকে সাংঘাতিকভাবে মারিল। এত মারিল যে তাহার শরীরে কোন অংশ আঘাত হইতে মুক্ত ছিল না। তাহার তিনশত টাকা লইয়া গেল এবং বলিল, আচ্ছা, তিনশত টাকা জরিমানা এইভাবে আদায় হইল এবং দুইশত টাকা মারিয়া উসুল করিলাম। আমরা তো আমাদের পাঁচশত টাকা পুরা করিয়া লইলাম। অতএব এইরূপ যালেম স্বভাব-বিশিষ্ট মানুষও সেখানে মওজুদ আছে।

সুতরাং আহ্‌মদীয়া জামা’তের তরফ হইতে কাহারো কোন বিপদ নাই। আহমদীয়া জামা’ত নিজেদের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী জামা’ত। অনুরূপভাবে প্রত্যেক দেশের আহ্‌মদীয়া জামা’ত স্ব স্ব দেশের প্রতি বিশ্বস্ত। বিপদতো ঐ সকল হতভাগ্যের তরফ হইতে রহিয়াছে, যাহারা কলেমার অবমাননাকারী এবং যাহারা কলেমা বেচিয়া খায়।
৮। আরও একটি অশেষ বেদনাদায়ক ঘটনা

আরও একটি অশেষ বেদনাদায়ক ঘটনা সম্বন্ধে আমরা জ্ঞাত হইয়াছি। ইহা উপরোক্ত ঘটনার চাইতেও অধিক নৃসংশ। একদা পুলিশও যখন কলেমা নিশ্চিহ্ন করিতে অস্বীকার করিল এবং গ্রামের সকল মুসলমানও সরাসরি অস্বীকার করিল যে, তাহারা কখনো এই কলেমা নিশ্চিহ্ন করিবে না, তখন এই পাপাত্মা ম্যাজিষ্ট্রেট চিন্তা করিল যে, কলেমা নিশ্চিহ্ন করার জন্য সে একজন খৃষ্টানকে পাকড়াও করিবে। বস্তুতঃ সে একজন খৃষ্টানকে কলেমা নিশ্চিহ্ন করিতে বলিল। সে বলিল যে, সে তাহার পাদ্রী সাহেবকে জিজ্ঞাসা না করিয়া এই কাজ করিতে পারিবে না। ম্যাজিস্ট্রেট বলিল, আচ্ছা যাও এবং পাদ্রী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিয়া আইস। পাদ্রী এই ফত্‌ওয়া দিল যে, দেখ, আল্লাহ্‌র সহিত তো আমাদের কোন দুশমনী নাই। আল্লাহ্‌র একত্বে আমরাও বিশ্বাসী এবং তাহারাও বিশ্বাসী। সুতরাং কোন খৃষ্টানের হাত “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” নিশ্চিহ্ন করিবে না। হাঁ, যাও এবং (নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক) মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর নাম নিশ্চিহ্ন কর। এই পাপিষ্ঠ এবং অভিশপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেট ইহা পছন্দ করিল যে, আমাদের আকা ও মাওলা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাঃ-এর নাম একজন খৃষ্টানের হস্ত দ্বারা নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে হইবে। কিন্তু আমি তাহাকে সতর্ক করিতেছি এবং সাবধান করিয়া দিতেছি যে, আমাদের আল্লাহ্‌র যেভাবে স্বীয় নামের জন্য মর্যাদাবোধ রহিয়াছে, সেভাবে আমাদের আকা ও মাওলা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাঃ-এর নামের জন্যও তাঁহার মর্যাদাবোধ রহিয়াছে। হযরত মুহম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নিজে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি খোদার নাম নিশ্চিহ্ন হইতে দেন নাই। আমাদের খোদাও নিশ্চিহ্ন হইতে পারেন না এবং তিনি মুহাম্মাদ সাঃ-এর পবিত্র নামকে কখনো নিশ্চিহ্ন হইতে দিবেন না। অতএব হে পাকিস্তানবাসীরা! আমি তোমাদিগকে সতর্ক ও সাবধান করিতেছি যে, যদি তোমাদের মধ্যে কোন আত্মমর্যাদাবোধ ও লজ্জা-শরম অবশিষ্ট থাকে তাহা হইলে আইস এবং এই পবিত্র আন্দোলনে আমাদের সহিত অংশ গ্রহণ কর এবং কলেমা ইহার ইজ্জ্বত এবং ইহার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং পৃথিবীর কোন একনায়ক ও কোন একনায়কের পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ভয় করিও না। নিজেদের জীবনকে আল্লাহ্‌র নিকট সোপর্দ করার ইহাই সময়। খোদার জন্য সর্বপ্রকার কুরবানী করার ইহাই সময়। আমরা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সম্মুখেও লড়িব এবং পশ্চাতেও লড়িব। ডানেও লড়িব বামেও লড়িব এবং তাঁর (সাঃ) মান-ইজ্জতের উপর কাহাকেও হামলা করিতে দিব না - ইহা প্রমাণ করার সময় ইহাই।

অতএব হে পাকিস্তানবাসীরা! যদি তোমরা নিজেদের স্থিতি চাও তাহা হইলে নিজেদের জীবন, নিজেদের আত্মা এবং নিজেদের কলেমার হিফযত কর। আমি তোমাদিগকে সাবধান করিতেছি যে, এই কলেমার মধ্যে যেভাবে গড়ার শক্তি আছে, তেমনিভাবে ইহার মধ্যে নিশ্চিহ্ন করারও শক্তি আছে। ইহা সংযোগ স্থাপনকারী কলেমাও বটে, অন্যদিকে ইহা বিনাশকারী কলেমাও বটে। কিন্তু ইহা ঐ সকল হস্তকে বিনাশ করে, যে সকল হস্ত ইহাকে বিনাশ করার জন্য উত্তোলিত হয়। আল্লাহ্ তোমাদিগকে শুভ-বুদ্ধি দান করুন এবং তোমাদিগকে হেদায়ত নসীব করুন। আমীন!

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।