আপত্তির জবাব

কাশ্মীর ও প্যালেষ্টাইনের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহমদীয়া জামা’তের মহান ভূমিকা

১। অভিন্ন আদর্শের ভিত্তিতে একত্রিত হওয়ার জন্য কুরআনী আহ্বান

সূরা আলে-ইমরানের ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহতা’লা মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করিয়া বলেন, হে রসূল! তুমি কিতাবীদিগকে বল, তোমরা ঐ কলেমার দিকেই আসিয়া যাও যাহা আমাদের উভয়ের মধ্যে অভিন্ন। অর্থাৎ আমরা এই কথার ভিত্তিতে একত্রিত হইয়া যাইব যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাহারো ‘ইবাদত’ করিব না এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও অংশীদার করিব না। আমাদের মধ্য হইতে কেহ খোদা ব্যতীত অন্য কাহাকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করিব না। অতএব ইহা শুনার পরও যদি তাহারা মুখ ফিরাইয়া নেয় এবং মনোযোগ না দেয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে বলিয়া দাও যে, এখন তোমরা সাক্ষী থাক যে আমরা আল্লাহর আজ্ঞানুবর্তী। অর্থাৎ এই অভিন্ন আদর্শের প্রতি আহ্বান শুনার পরও যাহারা মুখ ফিরাইয়া নেয়, তাহাদের সহিত ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকে না। কেননা আল্লাহতা’লার এই ঘোষণা অনুযায়ী আমরা তোমাদিগকে আল্লাহতা’লার একত্বের অভিন্ন আদর্শের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।

কুরআন করীম একটি বিস্ময়কর প্রজ্ঞাপূর্ণ কালাম। ইহা অন্যান্য মত বিরোধকে উপেক্ষা করিয়া এইরূপ একটি ঐক্যের প্রতি আহবান জানাইতেছে যাহা কিতাবীগণ ও কুরআন করীমের মধ্যে একটি ল্যান্ডমার্কের (বিশেষ চিহ্নের) মর্যাদা রাখে। কুরআন করীম এই কথা উপেক্ষা করে যে, কিতাবীগণ আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে, নাউযুবিল্লাহ, মিথ্যাবাদী ও আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপকারী মনে করে। কুরআন করীম এই কথাকেও উপেক্ষা করে যে, কিতাবীগণ তাঁহার (সাঃ) প্রাণের শত্রু, তাঁহার ধর্মের শত্রু, তাহারা তাঁহার পবিত্র জামা’তকে ধ্বংস ও বরবাদ করার জন্য সদা-প্রস্তুত এবং ইসলাম ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা-তার (সাঃ) ক্ষতি সাধন করার জন্য কোন ত্রুটি তাহারা করে না এবং কোন সুযোগ হাত ছাড়া করে না। এত কঠোর শত্রুতা সত্ত্বেও কুরআন করীম তাহাদিগকে অভিন্ন আদর্শের দিকে আহ্বান জানাইতেছে এবং মতবিরোধ হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাইতেছে। এই দিক হইতেও কুরআন করীম কত আশ্চর্যজনক কিতাব এবং কত মহান কালাম। ইহা সত্যের আত্মা হইতে প্রস্ফুটিত হইয়াছে। যতক্ষণ পর্যন্ত একদিকে মানবজাতির সহিত এবং অন্যদিকে আল্লাহতা’লার সহিত গভীর সম্পর্ক স্থাপিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরণের কথা কাহারো মুখ হইতে নিঃসৃত হওয়া অসম্ভব। আল্লাহতা’লা স্বীয় বান্দাগণের সহিত জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে এইরূপ গভীর সম্পর্ক রাখেন যাহা ধর্মেরও ঊর্ধ্বে। ইহা হইল স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত এই মহান সত্ত্বার তরফ হইতে উপরোক্ত আওয়াজ বাহিৰ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত জগদ্বাসীর ধারণায় এইরূপ কথা আসিতেই পারে না। ইহা হইল ঐ কালাম, যাহা অনুসরণ করিলে পৃথিবীর যাবতীয় মতবিরোধ দূর হইতে পারে। অভিন্ন আদর্শের দিকে আহ্বান জানানোর অর্থ প্রকৃতপক্ষে মানবজাতিকে কল্যাণ ও পূণ্যের দিকে আহ্বান জানানো।

ইহা এইরূপ একটি মহান শিক্ষা, যাহা কেবলমাত্র ধর্মজগতেই নয়, বরং রাজনীতির জগতেও এবং সামাজিক ও সংস্কৃতির জগতেও সর্ব প্রকারের মতবিরোধ সমাধানের জন্য এইরূপ Master key (প্রধান চাবি), যদ্বারা সকল প্রকারের তালা খোলা যাইতে পারে, কিন্তু ইহা মানবজাতি তথা জাতিবর্গের দুর্ভাগ্য যে, কুরআন করীমের এই মহান শিক্ষা বিস্মৃত হইয়া মানুষ দুঃখ-কষ্টের জীবনে নিপতিত হইয়াছে এবং নিজেদের জন্য, অন্যদের জন্য, নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের জন্য এবং নিজেদের দুশমনদের জন্যও একটি জাহান্নাম তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছে। প্রকৃত সত্য এই যে, আজ পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান অভিন্ন আদর্শের ভিত্তিতে একত্রিত হওয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অন্য জাতির কথা ছাড়িয়া দিন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশ পাকিস্তান, সেখানকার সরকার ইসলামের প্রতি ভালবাসা পোষণের দাবী রাখে, তাহারাও এই মৌলিক ও নীতাগত শিক্ষাটি বুঝিতেছে না।
২। পাকিস্তানে কুরআনী আহ্বানের পরিপন্থী আন্দোলন

বস্তুতঃ আহ্‌মদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে আজকাল যে আন্দোলন বড় জোরে শোরে চালানো হইতেছে এই আন্দোলনের সারকথা হইল প্রত্যেকটি অভিন্ন আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দাও। কুরআন করীমের বাণীর সারকথা তো এই যে, প্রত্যেকটি বিরোধপূর্ণ আদর্শকে উপেক্ষা করিয়া প্রত্যেকটি অভিন্ন মতাদর্শের প্রতি আহ্বান জানাও। কিন্তু পাকিস্তানে আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা ঐ সকল কথা বলিতেছে, যাহা ফিরিশতাগণ বলিতেছে না। তাহারা খোদা-বিরোধী কথা বলিতেছে এবং খোদার তকদীর বিরোধী কথা বলিতেছে। বস্তুতঃ আহমদীয়াতের দুশমনেরা এই দৃঢ় সংকল্প লইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, তাহারা প্রত্যেকটি অভিন্ন আদর্শকে নির্মূল করিতে থাকিবে এবং প্রত্যেকটি বিরোধপূর্ণ আদর্শকে উস্কানী দিতে থাকিবে। আহমদীয়াতের শত্রুতায় তাহারা যেন অন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপবাদ আরোপ করিতেছে, যাহার সহিত সত্যের দূরতম সম্পর্কও নাই।

বিগত খোৎবায় আমি কয়েকটি উদাহরণ দিয়া এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করিয়া দিয়াছিলাম। কেবলমাত্র নিজের ভাষাতেই নয়, বরং অন্যদের ভাষায়ও এবং আজ যাহারা আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করিতেছে তাহাদের ভাষাতেও ইহা প্রমাণ করিয়াছিলাম যে, আহমদীয়া জামা’ত সদা সর্বদা ইসলামের প্রতিও বিশ্বস্ত রহিয়াছে এবং মুসলমানদের স্বার্থও সংরক্ষণ করিয়া আসিতেছে। পক্ষান্তরে আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপকারীরা কেবলমাত্র মিথ্যা কথাই বলে না, বরং তাহারা নিজেরাই হইল অভিযুক্ত এবং তাহারা নিজেরাই অপরাধী। তাহারা যেমন তেমন অপরাধী নয়, সাব্যস্তকৃত অপরাধী। বস্তুতঃ আমি অ- আহ্‌মদী পত্রিকা ও পুস্তকাদির রেফারেন্স এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বের ইতিহাস হইতে কিছু রেফারেন্স দিয়াছিলাম। এই প্রসঙ্গে এখন আমি আলোচনা করিব যে, যখনই ইসলাম অথবা ইসলাম জাহানের জন্য কোন বিপদ নামিয়া আসিয়াছে তখন আহমদীয়া জামা’ত খোদাতা’লার ফযলে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিরক্ষায় সর্বদা প্রথম সারিতে দাঁড়াইয়াছে এবং পূর্ণ শক্তি ও সাহসের সহিত কোমর বাঁধিয়া সকল দুশমনের মোকাবেলা করিয়াছে। ইহার বিপরীত মজলিসে আহ্‌রার এবং জামা’তে ইসলামীর ভূমিকা যে ইসলামী স্বার্থের পরিপন্থি ছিল ইহাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। ইহাতে অভিযোগ খুঁজিয়া বেড়ানোর কোন ফাঁক নাই। ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া দিতেছে যে, ইসলাম ও ইসলামী বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাহাদের ভূমিকা মুসলমানদের সমষ্টিগত স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

সরকারী শ্বেতপত্রে বহু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কিন্তু ঐ বিষয়গুলির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয় নাই। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ‘আহমদীয়া জামা’ত ইসলামী বিশ্ব ও ইসলামের বিরোধী’ উক্তিটির মধ্যে ঐ সকল অপবাদ অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায় যাহা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকারে আহরার ও জামা’তে ইসলামীর তরফ হইতে বিশেষভাবে আহমদীয়া জামা’তের উপর আরোপ করা হইয়াছে। সাম্প্রতিক কালে আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে যে সকল পত্র পত্রিকা, পোষ্টার, বিজ্ঞাপন এবং বই পুস্তকাদি ছাপানো হইয়াছে, এইগুলি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হইতে পরিপূর্ণ ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করিয়াছে। এইগুলিকে যাকাত ফাণ্ড ও অন্যান্য খাতের অর্থ হইতে ভরপুর সাহায্য দেওয়া হইয়াছে এবং এই ব্যাপারে গর্ব করা হইয়াছে যে, তাহারা এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছে। তদুপরি যে সকল অপবাদ আরোপ করা হইয়াছে, ঐগুলিও বড়ই অদ্ভুত। বস্তুতঃ একটি অপবাদ ইহাও লাগানো হইয়াছে যে, আহমদীয়া জামা’ত ভারতীয় এজেন্ট এবং এই অপবাদও লাগানো হইয়াছে যে, তাহারা হিন্দু মতবাদেরও এজেন্ট। এই অপবাদও লাগানো হইয়াছে যে, আহমদীর ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি এবং সকল ধনতান্ত্রিক দেশের এজেন্ট। এই অপবাদও লাগানো হইয়াছে যে, তাহারা সমাজতন্ত্রেরও প্রতিনিধি। বাদীদের কাণ্ড জ্ঞান যেন লোপ পাইয়াছে। তাহারা বলে যে, আহমদীরা একই সময়ে রাশিয়ারও এজেন্ট এবং ইস্রাইলেরও এজেন্ট এবং পৃথিবীর সকল শক্তির এজেন্ট, এই শক্তিগুলি একে অন্যের যতই বিরুদ্ধবাদী হউক না কেন। কিন্তু যখন আমরা ঘটনাবলীর উপর দৃষ্টিপাত করি, তখন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী দৃষ্টিগোচর হয় এবং সেই কাহিনী তখন কাহিনী থাকে না, বরং তাহা একটি ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়।
৩। আহ্‌মদীয়া জামা’তের সুস্পষ্ট অবস্থান

হিন্দু মতবাদের বা ভারতীয় এজেন্ট হওয়ার ব্যাপারে ইহাই বলিতে হয় যে, ইহা একটি নেহায়েত বাজে অপবাদ। ইহা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মনগড়া কথা ও কাহিনীর উপর ভিত্তি করিয়া বানানো হইয়াছে। এই সকল অপবাদের মধ্যে ইহার চাইতে অধিক কোন সারবস্তু নাই। প্রকৃত সত্য এই যে, কুরআন করীম ও সুন্নতে নববী (সাঃ) মোতাবেক আহমদীয়া জামা’তের একটি সুস্পষ্ট অবস্থান রহিয়াছে। তাহা হইলে এই যে, আহমদীর যে দেশে বসবাস করে, যে দেশের অন্ন তাহারা ভক্ষণ করে এবং যে দেশের মাটিতে তাহাদের প্রকৃতি গঠিত হইয়াছে, তাহারা সেই দেশের প্রতি বিশ্বস্ত এবং বিশ্বস্ত থাকিবে। এই দিক হইতে ভারতের আহ্‌মদীরা অনিবার্যভাবে ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত এবং সর্বদাই বিশ্বস্ত থাকিবে। ইংল্যান্ডের আহমদীরা অনিবার্যভাবে ইংল্যান্ডের প্রতি বিশ্বস্ত এবং সর্বদাই বিশ্বস্ত থাকিবে। অনুরূপভাবে পাকিস্তানে বসবাসকারী আহ্‌মদীরা অনিবার্যভাবে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত এবং সর্বদাই বিশ্বস্ত থাকিবে। ইহাই সত্য এবং বাকী সব মিথ্যা। যদি এই সকল লোক ইহাই চাহে যে, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আহমদীরা নিজ নিজ দেশের স্বার্থ বিক্রয় করিয়া দিবে, তাহা হইলে ইহা হইবে ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী এবং ইহা হইবে পাকিস্তান ব্যতীত সমগ্র বিশ্বে আহমদীদিগকে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করার নামান্তর। অধিকন্তু অপবাদ আরোপকারীরা নিজেরাও এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলমান, আরবে বসবাসকারী মুসলমান, আফ্রিকায় বসবাসকারী মুসলমান এবং অন্যান্য মহাদেশে বসবাসকারী মুসলমান—ইহারা সকলেই কি নিজ নিজ দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক? এইরূপ প্রশ্নই উঠে না। এই জন্য ইহা একটি নিছক কল্পিত কাহিনী। ইহাকে একটি আবেগপূর্ণ রোয়েদাদে পরিণত করিয়া উপস্থাপন করা হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের অপবাদ আরোপকারীরা নিজেরাই বিশ্বাসঘাতক। জগদ্বাসী জানে যে, বর্তমানে পাকিস্তান সরকারের ঘাড়ের উপর দুইটি ভূত সওয়ার রহিয়াছে। একটি হইল জামা’তে ইসলামীর ভূত এবং অন্যটি হইল মজলিসে আহরারের ভূত। বহির্বিশ্ব হইতে যখন প্রশ্ন উঠে এবং মানুষ যখন বলে — তোমাদের (অর্থাৎ পাকিস্তান সরকারের) কি হইয়াছে, তোমরা পাগল হইয়া গিয়াছ, এইরূপ অজ্ঞতাপূর্ণ কার্যকলাপ কেন করিতেছ? তখন তাহারা বলে—এই যে দুইটি মুসিবত রহিয়াছে (অর্থাৎ জামা’তে ইসলামী ও মজলিসে আহরার — অনুবাদক), ইহারা আমাদের পিছন ছাড়ে না এবং আমাদের কথা শুনেনা। ইহারা জনসাধারণকে বিগড়াইয়া দিয়াছে। অতএব জনগণের চাপে পড়িয়া আমরা আহমদীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়া পড়িয়াছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, এই দুইটি ভূতের ঘাড়ের উপর বর্তমান সরকার স্বয়ং সওয়ার হইয়াছে এবং নিজেদের স্বার্থে ইহাদিগকে ব্যবহার করিতেছে এবং যতদিন পর্যন্ত ইহাদের দ্বারা সরকারের স্বার্থ উদ্ধার হইবে ততদিন পর্যন্ত সরকার ইহাদিগকে ব্যবহার করিবে। অতঃপর সরকার ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিবে। অপরদিকে জামা’তে ইসলামী এবং আহরারী মোল্লারাও এই একই মতলব লইয়া বসিয়া রহিয়াছে। উভয়ের ঈমানের কাহিনী একই প্রকার।

বস্তুতঃ ইহাদের স্বার্থের সহিত যখনই সরকারের স্বার্থের সংঘাত দেখা দিবে, তখনই ইহারা এই সরকারকে পরিত্যাগ করিবে এবং নিজেদের স্বার্থের কথা বলিতে আরম্ভ করিবে। যাহা হউক, ইহা একটি দায়ে-পড়া বন্ধুত্ব ও দায়ে-পড়া সম্পর্ক। যে কোন সময়েই ভাঙিয়া যাইতে পারে। এইরূপ সম্পর্ক পূর্বেও ভাঙিয়া গিয়াছে এবং এখনও ইনশাআল্লাহ, ভাঙিয়া যাইবে।

এখন আমি বলিতে চাই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে জামা’তে ইসলামী ও আহরারী মোল্লাদের কি অবস্থা ছিল? তাহাদের দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিল? তাহারা হিন্দু এবং হিন্দু মতবাদকে কি মনে করিত? মুসলিম দেশসমূহের প্রতি তাহাদের আচরণ কিরূপ ছিল? এই সম্বন্ধে আমি দুই একটি উদাহরণ উপস্থাপন করিতেছি। সর্বপ্রথম আমি মজলিসে আহরারের সম্বন্ধে বলিতেছি। মজলিসে আহরার কিভাবে স্থাপিত হইল, তাহা “Freedom movement in Kashmir” (কাশ্মীর স্বাধীনতা আন্দোলন) নামক একটি বিখ্যাত পুস্তক হইতে জানিতে পারা যায়। এই পুস্তক প্রণেতার নাম গোলাম হোসেন খান। ভারতের নূতন দিল্লীর ‘লাইট এণ্ড লাইফ পাবলিশার্স’ ১৯৮০ সালে পুস্তকটি প্রকাশ করে। ইহাতে ১৯৩১ সাল হইতে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কাশ্মীর আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। গ্রন্থকার মজলিসে আহরারের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে লেখেন:-

“মজলিসে আহরার কংগ্রেসের স্টেজে কংগ্রেসের বাৎসরিক সম্মেলনে স্থাপিত হইল। মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ্ বোখারী সাহেব ইহার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইলেন এবং ইহার নাম “মজলিসে আহরারে ইসলাম, হিন্দ” রাখা হইল।” তিনি আরও লেখেন:-

“হিন্দু পণ্ডিতেরা মুসলমানদের সম্মিলিত আন্দোলনের ক্ষতি সাধন করার জন্য মুসলমানদের ফিরকাবাজীকে অবৈধভাবে কাজ লাগাইল।”

হিন্দুরা মজলিসে আত্মারকে কিভাবে কাজে লাগাইয়াছে। ইহার বর্ণনা দিতে গিয়া উল্লেখিত গ্রন্থকার অবশেষে লিখেন:-

“হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায় কোন কোন প্রভাবশালী মুসলমান নেতা এবং মীর ওয়ায়েজের সঙ্গী-সাথী ও মির্যা গোলাম মোস্তফা আসাদউল্লাহ উকিল প্রভৃতির সহিত গোপন চুক্তি করেন এবং গোপন সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন এবং উস্কানী প্রদান করেন যে, শেখ আবদুল্লাহ আহমদীয়া জামা’তের সহিত মিলিত হইয়া তাহার ধর্মীয় নেতৃত্ব (অর্থাৎ মীর ওয়ায়েজের ধর্মীয় নেতৃত্ব) শেষ করিয়া দিতে চাহিতেছে। এইভাবে মুসলমানদের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করা হইল।”

সুতরাং ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, হিন্দুরা ও হিন্দু কংগ্রেস মজলিসে আহরারকে জন্ম দিয়াছে এবং নিজেদের স্বার্থে তাহাদিকে ব্যবহার করিয়াছে। ইহা একটি প্রকাশ্য ঘটনা। ইহার আরও প্রমাণ রহিয়াছে। এই গুলির কয়েকটির বিবরণ আমি পূর্বেই দিয়াছি। আরও অনেক প্রমাণ রহিয়াছে, যেগুলি স্বল্প সময়ের মধ্যে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।

লাহোরের ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্পাদক মৌলভী জাফর আলী খান সাহেব আহরারদের প্রথম সারির মুজাহীদ ছিলেন। যদিও তিনি তওবাও করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহা অনেক পরে। এক সুদীর্ঘ সময় তিনি আহরারদের ওকালিতর কর্তব্য পালন করেন এবং নিজ পত্রিকায় আহরারদিগকে অনেক উস্কানী দেন। মৌলভী জাফর আলী খান সাহেব হিন্দুদের সহিত মুসলমানদের সম্পর্ক সম্বন্ধে এবং গান্ধীজী সম্বন্ধে নিজের ধারণা একটি কবিতার মধ্যে ব্যক্ত করিয়াছেন। ইহা ছিল খিলাফত আন্দোলনের যুগ অর্থাৎ যেই দিনগুলিতে এই আন্দোলন চলিতেছিল যে ইংরেজরা খিলাফতের উপর হামলা করিয়াছে। অতএব মুসলমানেরা অসহযোগ আন্দোলন করিবে এবং ইংরেজদের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া আফগানিস্তানে চলিয়া যাইবে। বস্তুতঃ মুসলমানদের খিলাফত রক্ষার ব্যাপারে এই যে ঘোষণা দেওয়া হইয়াছিল, ইহা সম্বন্ধে আহরাররা বলে, এই ঘোষণা গান্ধীজী করিয়াছিলেন। উপরোক্ত কবিতাটির বঙ্গানুবাদ নিচে দেওয়া হইল:-

“গান্ধী আজ যুদ্ধের ঘোষণা করিয়াছেন।
সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হইয়াছে।
ভারতবর্ষে একটি নুতন আত্মা ফুঁকিয়া দিয়া
তিনি স্বাধীন জীবনের উপকরণ সৃষ্টি করিয়াছেন।
তিনি খিলাফতের নামে দেহ ও প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছেন।
সব কিছু খোদার রাস্তায় কুরবান করিয়া দিয়াছেন।”

ইনিই হইলেন তাহাদের পীর ও মোরশেদ! ইনিই তাহাদের খিলাফত রক্ষাকারী! ইনিই হইলেন তাহাদের পরমাত্মীয়! কিন্তু তাহারা আজ লম্ফ ঝম্প দিয়া আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে কথা বলিতেছে যে, জনাব গান্ধী সাহেব খিলাফতের জন্য স্বীয় দেহ ও প্রাণ উৎসর্গ করিয়া দিয়াছেন। আরও শুনুন বলা হইতেছে:-

“পরোয়ার দিগার খোদা হইলেন গুণগ্রাহী,
তিনি জানিয়া বুঝিয়াই গান্ধীকেও এই মর্যাদা দান করিয়াছেন।”

অর্থাৎ ইহা কোন মানুষের ব্যাপার নয় যে, ভুল হইয়া গেল। বলা হইতেছে, হযরত গান্ধীজীকে খোদাতা’লা চিনিয়াই এই মর্যাদা দান করিয়াছেন। ঐ সময়ে যেন ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে এবং মুসলমান মায়েদের গর্ভ হইতে জন্ম গ্রহণকারী একজনও ছিল না, যে খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য দাঁড়াইতে পারিত। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের উপর দৃষ্টিপাত করিয়া খোদা কেবলমাত্র গান্ধীজীকে দেখিতে পাইলেন, যিনি ইসলামী খিলাফতকে রক্ষা করার শক্তি ও সাহস রাখিতেন। বলা হইতেছে, খোদাতা’লা দৃশ্য ও অদৃশ্য সম্বন্ধে জ্ঞাত। তিনি চিনিয়াই গান্ধীজীকে এই মর্যাদা দান করিয়াছেন।

এই মৌলভী জাফর আলী খান সাহেবই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্বন্ধে বলেন:-

“পাঁচ বৎসর পূর্বে এই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারণাও কাহারো ছিল না। গান্ধীজী, লালা লাজপত রায়, মালভীজী এবং মতি লাল নেহেরু সম্বন্ধে মনে হয় যে ইহা তাঁহাদের প্রচেষ্টার ফল। কিন্তু পূর্বে কি তাঁহাদের মধ্যে এই শক্তি ছিল না? আমি (অর্থাৎ জাফর আলী খান) বলিতেছি যে, ইহা হইল স্বর্গীয় শক্তি। এখন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হইবে না। হিন্দুগণ এবং মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের উপর যে অনুগ্রহ করিয়াছেন, ইহার প্রতিদান দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

অর্থাৎ মৌলভী জাফর আলী খান সাহেব বলিতেছেন যে, মুসলমানদের উপর হিন্দুগণ এবং মহাত্মা গান্ধী যে অনুগ্রহ করিয়াছেন, আমরা ইহার প্রতিদান দিতে অসমর্থ। আমাদের সেই অর্থ সম্পদ নাই। কিন্তু প্রাণতো আছে। তাহা দিতে আমরা সদা প্রস্তুত। ইহারা হইল ঐ সকল লোক, যাহারা পাকিস্তানের আহ্‌মদীদের উপর হিন্দুদের এজেন্ট হওয়ার অপবাদ লাগাইতেছে। অবশ্য আমি পূর্বেও বলিয়াছি, প্রত্যেক দেশের আহ্‌মদী ঐ দেশের প্রতি বিশ্বস্ত এবং নির্বিধায় আমরা এই ঘোষণা করিতেছি যে, ভারতে বসবাসকারী আহ্‌মদীদের ইহা অবশ্য কর্তব্য যে নিজেদের মাতৃভূমির প্রতি তাহারা বিশ্বস্ত থাকিবে এবং যে দেশের মাটিতে তাহারা প্রতিপালিত হইতেছে সেই দেশের সহিত তাহারা বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না। আমি অবশ্য তাহাদের কথা বলিতেছি না। প্রকৃতপক্ষে ইহাদের অভিযোগ হইল এই যে, পাকিস্তানে বসবাসকারী আহমদীরা ভারতের হিন্দুদের এজেন্ট এবং ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত এবং পাকিস্তানের সহিত তাদের কোন সম্পর্ক নাই। ইহা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। যাহারা হিন্দুদের প্রতি বিশ্বস্ত এবং ভারতের এজেন্ট, তাহারা নিজেদের লেখা দ্বারাই ইহা সাব্যস্ত করিতেছে।
৪। জামা’তে ইসলামীর ভূমিকা

এবার আসুন আমরা দেখি, জামা’তে ইসলামীর ইসলামপ্রীতি এবং ইসলামী দেশসমূহের প্রতি তাহাদের ভালবাসা ও সম্পর্ক কিরূপ ছিল। আমি যেমন পূর্বে বলিয়াছি, যতদিন পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রসমূহে তেল বাহির হয় নাই ততদিন পর্যন্ত তাহারা জানিতই না যে, ইসলাম কোথায় আছে। আরব রাষ্ট্রসমূহের সহিত ইসলামের কি সম্পর্ক রহিয়াছে, এই তাহারা বেখবর ছিল। কিন্তু যখন তেলের সম্পদ আরবে প্লাবিত হইতে আরম্ভ হইল, তখন তাহাদের চোখ পড়িল এবং তাহারা জানিতে পারিল যে, এখানে তো খোদা আছেন এবং এখানে খোদা ওয়ালা মানুষ আছেন। ইহার পূর্বে আরবে কি ছিল, তাহা মৌলভী মওদুদীর ভাষাতেই শুনুন; তিনি বর্তমান পাকিস্তান সরকারের বুযুর্গগণের পিতা ছিলেন। তাহার সম্বন্ধে জগদ্বাসী প্রশংসা করিতেছে যে, তিনি বড় নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি আরববাসীদের অনেক সেবা করিয়াছেন এবং মুসলিম জাহানের জন্যও তিনি বড় কুরবাণী করিয়াছেন। কিন্তু তিনি আরবদিগকে কি দৃষ্টিতে দেখিতেন তাহা একবার শুনুন। তিনি বলেন:-

“হেজায সরকারের (অর্থাৎ শাহ্ আবদুল আযীয এবং তাঁহার পরে তাঁহার সন্তানেরা) বদৌলতে আরব ভূমিতে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং পবিত্র কা’বার ব্যবস্থাপকরা বেনারস ও হরিদ্বারের পাণ্ডা হইয়া গিয়াছে।”

“খোৎবাতে সৈয়্যদ আবুল আলা মওদুদী’ এর ৭ম সংস্করণের ১৯৫ পৃষ্ঠা হইতে ১৯৭ পৃষ্ঠায় এই দীর্ঘ লেখা রহিয়াছে। ইহা পাঠ করিয়া মানুষ হতবাক হইয়া যায়। ইহা একটি অত্যন্ত গভীর শত্রুতার অভিব্যক্তি। এইরূপ মনে হয়, এক ব্যক্তি দীর্ঘকাল যাবৎ বিষ প্রস্তুত করিতেছিল এবং এখন তাহার বিষোদগার করার সময় ও সুযোগ হইয়াছে।

কোন ব্যক্তি এইরূপ মনে করিতে পারেন যে, অবশিষ্ট মুসলমানদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কেননা তিনি একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি এবং তিনি ঐ সকল কথাই বলিয়া দিয়াছেন, যাহা তাঁহার নজরে পড়িয়াছে। কিন্তু আমি আপনাদিগকে বলিতেছি, অবশিষ্ট ইসলামী বিশ্ব সম্বন্ধে তাহার কি ধারণা ছিল। সম্ভবতঃ তাহার ধারণা তিনি পরিবর্তন করেন নাই। তিনি বলেন:-

“একজন প্রকৃত মুসলমান হিসাবে যখন আমি পৃথিবীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তখন ইহাতে আমি সন্তুষ্টি প্রকাশের কোন কারণ খুঁজিয়া পাইনা যে, তুরস্কের উপর তুর্কী, ইরানের উপর ইরানী, আফগানিস্তানের উপর আফগান শাসক শাসন করিতেছে।”

মৌলভী সাহেবের নিকট আনন্দের অভিব্যক্তি তখনই হইত, যদি এই সকল দেশে হিন্দু শাসক থাকিত, রুশ শাসক থাকিত অথবা ইংরেজ আসিয়া লোকদের উপর শাসন করিত। যদি এইরূপ হইত তাহা হইলে মৌলানা আনন্দের কারণ খুঁজিয়া পাইতেন। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি কিরূপে খুশীর অভিব্যক্তি করিব? আমি তো তুরস্কের উপর তুর্কী শাসক দেখিতেছি, আফগানিস্তানের উপর আফগান শাসক দেখিতেছি এবং অনুরূপভাবে ইরানের উপর ইরানী শাসক দেখিতেছি। তাহারা আমার শাসনও গ্রহণ করেনা এবং অন্য কোন দেশেরও শাসন গ্রহণ করেনা। অতএব আমি কিরূপে খুশী হইতে পারি?” তিনি নিজেই ইহার একটি কারণ দর্শাইয়াছেন। দেখুন, ইহা কিরূপ মহান ইসলামী কারণ (?)। তিনি বলেন:-

“মুসলমান হওয়ার দরুণ আমি ‘জনগণের সরকার, জনগণ কর্তৃক সরকার, জনগণের জন্য সরকার’ — এই দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্বাসীই নই।”

মৌলানা সাহেব বলিতে চাহিতেছেন যে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা “Government of the people, by the people, for the people” ইহাতে তিনি বিশ্বাসীই নন। এই সম্বন্ধে তিনি বলেন, তিনি ইহাতে বিশ্বাসই করেন না। সুতরাং মুসলিম দেশ সমূহে যে সকল ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ইহাতে তাঁর খুব খারাপ লাগিতেছে। তিনি এই যুক্তি দাঁড় করাইয়াছেন যে, তাহাদের কি যোগ্যতা আছে যে তাহারা নিজেদের মুসলিম দেশ সমূহে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করিয়া বসিয়া গিয়াছে? কাজেই মনে হইতেছে যে, মাওলানা সাহেবের বলার উদ্দেশ্য হইল যেহেতু মুসলিম দেশ সমূহের প্রজাতান্ত্রিক সরকার অমুসলিম দেশ সমূহের প্রজাতান্ত্রিক সরকার হইতে উত্তম নয়, সেহেতু তিনি মুসলিম দেশ সমূহের প্রজাতান্ত্রিক সরকারগুলিকে পছন্দ করেন না। সম্ভবতঃ তাঁর যুক্তি এই যে, যদিও অন্যদের অর্থাৎ কাফির ও মুশরিকদের মর্যাদা মুসলমানদের মোকাবেলায় নগণ্য, তথাপি তাহাদের সরকারগুলি গণতান্ত্রিক। সুতরাং এই সকল উত্তম প্রজাতান্ত্রিক সরকারের মোকাবেলায় তাঁর নিকট মুসলমানদের নগণ্য প্রজাতান্ত্রিক সরকার পছন্দনীয় নয়। মওদুদী সাহেবের বিবরণ হইতে এই সুধারণা করা যাইতে পারে। কিন্তু এই সুধারণা তাঁর নিম্ন বর্ণিত লেখা দ্বারা তৎক্ষণাৎ নস্যাৎ হইয়া যায়, যখন তিনি অমুসলমান ও মুসলমান উভয় সরকার সম্বন্ধে এই ফতওয়া দিতেছেন:-

“অমুসলমানরা যদি যাল্লিনদের’ (পথভ্রষ্টদের) অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহা হইলে ইহারা (অর্থাৎ মুসলমানরা - অনুবাদক) মাগযুবে আলাইহিম’ (তাহাদের উপর গযব) এর সংজ্ঞায় পড়িয়া যায়।”

মিশর সম্বন্ধে মাওলানা বলেন:-

“আজ মিশরের বর্তমান সামরিক একনায়ক যুলুমের যে পাহাড় আখোয়ানদের উপর চাপাইয়া দিতেছে, ইহা প্রাচীন কালের ফির‘আউনের স্মৃতিকে তাজা করিয়া দিয়াছে।

মুদ্দাকথা, মুসলমান সরকারগুলির বিরুদ্ধে মওদুদী সাহেব ভয়ানক ক্রোধাগ্নি পোষণ করিতেন। ইহাই হইল মওদুদী সাহেবের ধ্যান- ধারণা এবং জামা’তে ইসলামী ইহারই অনুসরণ করিতেছে। কিন্তু আজ তাহারা লম্ফ ঝম্ফ দিয়া কথা বলিতেছে ও আহ্‌মদীয়া জামা’তের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করিয়া চলিয়াছে এবং আহ্‌মদীয়া জামা’তকে মুসলমান দেশসমূহের প্রতি অবিশ্বস্ত হওয়ার অপবাদ আরোপ করিয়া চলিয়াছে। কিন্তু ইতিহাস বলিয়া দিবে যে, মুসলমান দেশসমূহের স্বপক্ষে আহমদীয়া জামা’তের ভূমিকা কি ছিল এবং সকল সময়ের ন্যায় আজও কি ভূমিকা রহিয়াছে এবং ভবিষ্যতে কি ভূমিকা থাকিবে।
৫। কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহ্‌মদীয়া জামাতের সেবা ও খেদমত

আহ্‌মদীয়া জামাতের প্রতি বিশেষভাবে এই অপবাদ আরোপ করা হইয়াছে যে আহ্‌মদীয়া জামা’ত সর্বদা বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা হইয়া থাকে - চৌধুরী মুহাম্মাদ জাফরউল্লাহ্ খান কাশ্মীরের স্বার্থের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন এবং আহমদীয়া জামা’ত কাশ্মীরের স্বার্থের বিরুদ্ধে চেষ্টা-তদবীর করিয়াছে। ইহা সম্পূর্ণরূপে উল্টা কাহিনী এবং খুব বড় ধরণের একটি মিথ্যা ও অপবাদ। ইহাতে তাহাদের সামন্যতম খোদার ভয়ও হয় নাই। বস্তুতঃ জাস্টিস মুনীর তাঁহার তদন্ত রিপোর্টে এই বিষয়টি বিশেষভাবে নোট করিয়াছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের এই দুঃসাহস ও অপবাদ আরোপ সম্বন্ধে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি করিয়াছেন যে, যাহারা প্রথম সারির মুজাহিদ তাহাদিগকে পাকিস্তানের দুশমন ও বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করা হইতেছে। বস্তুতঃ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের ঘটনাবলী সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয় ইহা সম্পূর্ণরূপে সত্য এবং ঐতিহাসিক সত্য যে, কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আহ্‌মদীয়া জামা’তের চাইতে অধিক অন্য কোন ইসলামী জামা’ত বা কোন ধর্মীয় জামা’ত মহান সেবা ও খিদমত সম্পাদন করে নাই। বস্তুতঃ “তুলুয়ে ইসলাম” পত্রিকা ১৯৪৮ সালের মার্চ সংখ্যায় চৌধুরী মুহাম্মাদ জাফর উল্লাহ্ খান সাহেব কাশ্মীর সমস্যার ব্যাপারে যে জিহাদ করেন তাহার বিবরণ দেয়। পত্রিকাটি সংক্ষেপে লেখে:-

“সৌভাগ্যক্রমে পাকিস্তান এইরূপ একজন যোগ্য উকিল লাভ করিয়াছে, যিনি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহার দাবী-দাওয়াগুলি এইভাবে উপস্থাপন করিয়াছেন যে, তাঁহার দলিল ও যুক্তি-প্রমাণ মুসার লাঠি হইয়া রশির সকল সাপকে গিলিয়া ফেলিল এবং জগদ্বাসী দেখিল যে, “ইন্নাল্ বাতেলা কানা যাহুকা” - মিথ্যার এই জন্যই জন্ম হইয়াছে যে উহা সত্যের মোকাবেলায় ময়দান ছাড়িয়া পলায়ন করিবে।”

গতকাল পর্যন্ত তোমরা এই কথা বলিতেছিলে, কিন্তু আজ তোমরা আহ্‌মদীদিগকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করিতেছ?

জাষ্টিস মুনীর “বাউণ্ডারী কমিশনে” অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ ১৯৫৩ সনে তদন্তকারী আদালতে আহ্‌মদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধবাদীদের তরফ হইতে যখন এই প্রশ্ন উঠানো হইল যে, গুরুদাসপুর সম্বন্ধে চৌধুরী সাহেব অমুক কথা বলেন, কাশ্মীরের ব্যাপারে অমুক কথা বলেন প্যালেষ্টাইনের ব্যাপারে অমুক কথা বলেন, তখন জাষ্টিস মুনীর পূর্ণ অনুসন্ধানের পর লেখেন:-

“চৌধুরী জাফরউল্লাহ খান সাহেব মুসলমানদের নেহায়েত নিস্বার্থ সেবা করিয়াছেন। এতদ্‌সত্বেও কোন কোন জামা’ত তদন্তকারী আদালতে তাহার সম্বন্ধে যেভাবে বর্ণনা দিয়াছে, তাহা লজ্জাস্কর এবং অকৃতজ্ঞতার প্রমাণ।”
৬। কাশ্মীরের জিহাদে “ফুরক্বান বাহিনীর” উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব প্রদর্শন

যখন কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চলিতেছিল, তখন সর্বপ্রথম কাশ্মীরের প্রতি আহ্‌মদীয়া জামা’তের ইমাম মনোযোগ প্রদান করিলেন। তিনিই কাশ্মীরে জিহাদের সূচনা করিলেন। তাঁর আহ্বানে আহ্‌মদীয়া জামা’তের যুবক, বৃদ্ধ, অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ সকলেই এই জিহাদে অংশগ্রহণ করিলেন। তাহাদিগকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হইয়াছিল, অর্থ দ্বারা সাহায্য করা হইয়াছিল এবং অর্গানাইজেশন অর্থাৎ সংগঠন কায়েম করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। ইহা এখন একটি ঐতিহাসিক সত্য। শত চেষ্টা করিয়াও আহ্‌মদীয়াতের বিরুদ্ধবাদীরা ইহাকে এখন উপেক্ষা করিতে ও মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না। যে সময় পাকিস্তানের পক্ষ হইতে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য রীতিমত চেষ্টা করা হইতেছিল, অথবা নিজেদের পক্ষ হইতে আজাদ ফোর্স যে প্রচেষ্টা চালাইতেছিল, তখন ইহার বিরুদ্ধে জামা’তে ইসলামীর পক্ষ হইতে ভয়ঙ্কর ফত্‌ওয়া লাগাইতেছিল। জামা’তে ইসলামী ঘোষণা করিতেছিল যে, ইহা জিহাদ নহে এবং এই ধারণার বশবর্তী হইয়া ইহাতে অংশগ্রহণ করা উচিত নয় যে, ইহা জিহাদ। তাহারা আরও বলিল যে, তোমরা ইহার নাম যাহা খুশী তাহাই রাখিতে পার; কিন্তু ইহাকে জিহাদ বলিতে পার না। অর্থাৎ একটি মযলুম দেশ যেখানে মুসলমানদের জীবন-মরণের প্রশ্ন ছিল এবং যাহাদের হিফাযতের জন্য চারিপার্শ্বের মুসলমান দেশগুলিও সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল এবং সাধ্যানুসারে তাহাদের হিফাযতের জন্য চেষ্টারত ছিল, সেখানে তাহাদের সম্বন্ধে জামা’তে ইসলামীর এই ফতওয়া প্রকাশিত হইতেছিল যে, এই সংগ্রামের নিকটেও যাইও না, ইহা জিহাদ নহে।

তখন আহমদীয়া জামা’তে “ফুরকান বাহিনী” গঠন করিল। নিজেদের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আহ্‌মদীয়া জামা’তই এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য বাহিনী দিয়াছিল। পরবর্তীতে এই ব্যাটালিয়ানকে সরকার যথারীতি স্বীকৃতি দান করিয়া নিজেদের সেনা বাহিনীতে গ্রহণ করিল। অতঃপর যখন রীতিমত যুদ্ধ আরম্ভ হইল, এই ব্যাটালিয়ান খুবই উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করিল। এই ব্যাটালিয়ানে তখন এইরূপ যুবকেরাও অংশগ্রহণ করিয়াছিল, যাহার নিজেদের মায়ের একমাত্র পুত্র ছিল। ঐতিহ্যসিকভাবে এইরূপ ঘটনা সংরক্ষিত রহিয়াছে যে, যখন আহ্‌মদীয়া জামা’তের ইমাম হযরত মুসলেহ্ মাওউদ (রাঃ) কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র জিহাদের ঘোষণা করিলেন, তখন কোন কোন গ্রামে এই ব্যাপারে মনোযোগ সৃষ্টি হয় নাই। তাহারা মনে করিতেছিল যে, ইহা একটি সাধারণ ঘোষণা। ইহাতে অংশগ্রহণ না করিলে তেমন কি যায় আসে। তাহাদের ধারণা ছিল, যদি কোন ধর্ম সম্বন্ধীয় ঘোষণা হয় বা জামা’তের খেদমত সংক্রান্ত কোন বিষয় হয় তাহা হইলে তাহারা প্রস্তুত আছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতার ব্যাপারে অন্যান্য সকল মুসলমানইতো রহিয়াছে। তাহারাই সংগ্রাম করিতে থাকিবে। কিন্তু হযরত মুসলেহ, মাওউদ নাওয়া রাল্লাহু মারকাদাহু (আল্লাহতা’লা তাঁহার কবরকে উজ্জ্বল করুন) ইহার প্রতি খুবই মনযোগী ছিলেন। যখন গ্রামের লোকেরা কেহ নাম পেশ করিল না, তখন যে ব্যক্তি পয়গাম লইয়া গিয়াছিলেন তিনি বলিলেন, “তুমি ধারণা করতে পারিবে না যে হযরত মুসলেহ্‌ মাওউদ (রাঃ) এই ব্যাপারে কতখানি চিন্তিত। তোমরা উঠ, ইসলামী বিশ্বের জন্য কুরবানী পেশ কর।”

ঐ সময় যিনি পয়গাম লইয়া গিয়াছিলেন তিনি বলেন, “একজন মহিলা দাঁড়াইয়া বলিলেন, আমিতো অবাক হইয়া গিয়াছি এবং শরমে মরিয়া যাইতেছি যে, যুগ খলীফার পয়গাম আসিল, কিন্তু তোমরা চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছ। আমার একটি মাত্র পুত্র আছে। আমি তাহাকে পেশ করিতেছি এবং এই দো’আর সঙ্গে পেশ করিতেছি যে, খোদা তাহাকে শহীদ করিয়া দাও এবং তাহার মুখ দেখার নসীব যেন আমার না হয়।” আহমদী মায়েরা এই আত্ম-মর্যাদাবোধ দেখাইয়াছিল। বস্তুতঃ হযরত মোসলেহ্ মাওউদ নাওয়ারাল্লাহ্ মরকাদাহু তাঁর বক্তৃতায় এই বিষয়ের উল্লেখ করিয়া বলেন, “দেখ, যখন এই কথা আমার কানে আসিল তখন, খোদার কসম, আমার হৃদয় হইতে এই আওয়াজ বাহির হইল, হে খোদা! যদি তুমি এই মহিলার পুত্রের শাহাদাত অবধারিত করিয়া থাক, তাহা হইলে আমি নিবেদন জানাইতেছি যে, আমার পুত্রকে নিয়া নাও এবং এই মায়ের পুত্রকে তাহার নিকট ফিরাইয়া দাও।”

ইহাই হইল আহ্‌মদীয়া জামা’তের সদস্যগণের আবেগ, যাহারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য জিহাদ করিয়াছিলেন। তোমরা এখন আসিয়া হাজির হইয়াছ এবং বড় বড় কথা বলিতেছ। তোমাদের পুত্ররা ঐ সময় কোথায় ছিল? কোথায় ছিল আতাউল্লাহ শাহ বোখারীর পুত্ররা? কোথায় ছিল মৌলভী মওদুদীর পুত্ররা ও তাহার অনুচরবৃন্দ? ইহারা তো জেহাদের ময়দান হইতে বহু ক্রোশ দূরে বসিয়া রহিয়াছিল। ইহাদিগকে কেহ কখনও জেহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হইতে দেখে নাই। হযরত মোসলেহ্‌ মাওউদ নাওয়ারাল্লাহ্‌ মরকাদাহু কেবলমাত্র জেহাদের ঘোষণা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, বরং কার্যতঃ তিনি নিজ পুত্রকে কাশ্মীর ফ্রন্টে প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহারা রণক্ষেত্রে যারপরনাই কষ্ট স্বীকার করিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমাশায়ে আক্রান্ত হইয়াছিল। কেহ কেহ অনাহারে দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু হযরত মোসলেহ মাওউদ (রাঃ) কঠিন ব্যাধির দরুনও তাহাদিগকে ফিরিয়া আসিতে দেন নাই। আমার স্মরণ আছে, কোন কোন ছেলে তাহাদের অশেষ কষ্টের কথা ব্যক্ত করিয়াছিল। তাহাদের অবস্থা খুবই খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল। পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল। তাহাদের কেহ কেহ রক্তামাশয়েও আক্রান্ত হইয়াছিল। তাহারা লিখিল যে আমাদিগকে ফিরিয়া আসার অনুমতি দিন। হযরত মোসলেহ্‌ মাওউদ (রাঃ) বলিলেন, না, তোমাদের যে অবস্থাই হউক না কেন, তোমাদিগকে সেখানেই থাকিতে হইবে এবং দেশ ও ধর্মের সেবা করিতে হইবে। বস্তুতঃ এইরূপ অবস্থায় আহ্‌মদীয়া জামা’তের এই নিঃস্বার্থ খেদমত দেখিয়া কোন কোন খোদা-ভীরু অ-আহমদীও এই বিষয়টি অনুভব করিয়াছিলেন এবং তাহারা এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়াছেন। এই সাক্ষ্য আমাদের নিকট মওজুদ আছে। শিয়ালকোটের ‘জমায়াতুল মাশায়েখ’ এর প্রেসিডেন্ট হাকিম আহমদ দীন সাহেব তাঁর পত্রিকা “কায়েদে আজম”-এ ১৯৪৯ সালের জানুয়ারীতে লিখেন:-

“বর্তমানে সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আহ্‌মদীদের (কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের) ভূমিকা শীর্ষস্থানীয়। তাহারা পূর্ব হইতেই সুসংগঠিত। নামায, রোযা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাহারা নিয়মানুবর্তী। এই দেশ ছাড়াও বহির্দেশেও তাহাদের প্রচারকরা আহ্‌মদীয়াত প্রচারে সফল হইয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলীম লীগকে কৃতকার্য করার জন্য আহ্‌মদীয়া জামা’তের অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কাশ্মীরের জেহাদে যে নিষ্ঠা ও একগ্রতার সহিত আহমদীয়া জামা’ত আজাদ কাশ্মীরের মোজাহিদদের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া অংশগ্রহণ করিয়াছে ও কোরবানী করিয়াছে, আমাদের মতে মুসলমানদের অন্য কোন সম্প্রদায় এই যাবৎ এইরূপ নির্ভীকতা ও দৃঢ়তার সহিত তাহা করে নাই। এই সকল কাজের জন্য আমরা আহ্‌মদী বুযুর্গগণের প্রশংসা করি ও তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা দো’আ করিতেছি, আল্লাহতা’লা তাঁহাদিগকে দেশ ও ধর্মের আরও অধিক খেদমত করার তওফিক দান করুন।”

ঐ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার-ইন-চীফ ফোরকান বাহিনীকে খুবই চমৎকার ভাষায় প্রশংসাপত্র প্রদান করেন এবং ফোরকান ব্যাটালিয়ানের নওজোয়ানদিগকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন। উক্ত সার্টিফিকেটে অতি চমৎকার ভাষায় তাহাদের খেদমতের কথা উল্লেখ করা হয়। ইহা একটি দীর্ঘ সার্টিফিকেট। ইহা হইতে দুইটি উদ্ধৃতি আমি আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করিতেছি। সার্টিফিকেটে তিনি লিখেন:-

“আপনাদের ব্যাটালিয়ান সমাজের সর্বস্তরের লোকের সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী (প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবী নিজ ব্যয়ে সৈনিকের দায়িত্ব পালন করিতেছিল। তাহারা কেহ বেতনভোগী ছিল না - খোৎবা প্রদানকারী)। ইহাতে নওজোয়ান কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী সকলেই পাকিস্তানের খেদমতের আবেগে বিভোর ছিল। আপনারা স্বেচ্ছাসেবকরূপে নিস্বার্থ ভাবে প্রাণের কোরবানী পেশ করিয়াছেন। আপনারা কোন পারিশ্রমিক দাবী করেন নাই এবং কোন প্রকার খ্যাতি লাভের বাসনাও আপনাদের মধ্যে ছিল না। আপনার দায়িত্বে কাশ্মীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট ন্যস্ত করা হইয়াছিল। আপনাদের উপর আমাদের যে আস্থা ছিল, তাহা আপনারা খুব শীঘ্রই পূর্ণ করিয়া দেখাইলেন। যুদ্ধে দুশমনদের খুব বিশাল স্থল ও বিমান বাহিনীর মোকাবেলায় আপনারা নিজেদের ভূমির এক ইঞ্চিও হাতছাড়া না করিয়া নিজেদের দায়িত্ব অতি সূচারুরূপে সম্পাদন করিয়াছেন।”

বর্তমান পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিতে আজ যাহারা পাকিস্তান, ইসলাম ও ইসলামী দেশসমূহের প্রতি বিশ্বাসঘাতক, ইহাই হউক তাহাদের কাহিনী। তাহা হইলে তোমরাও এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া দেখাও।
৭। আত্মোৎসর্গকারী আহ্‌মদী মিলিটারী অফিসারদের মর্মান্তিক চরিত্রহনন

অন্ততপক্ষে সামরিক সরকারের নিজেদের সৈন্যদের সম্মান করাতো উচিত ছিল, বিশেষ করিয়া ঐ সকল সৈন্যদের যাহাদিগকে ‘সেতারায়ে কায়দে আজম’ এবং ‘হেলালে জুরাত’ এর ন্যায় খেতাবে ভূষিত করা হইয়াছে এবং যাহাদের বীরত্বের কাহিনী পাকিস্তানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু আফসোস্‌, আহ্‌মদীয়াতের দুশমনীতে অন্ধ হইয়া দেশ ও ধর্মের জন্য দৃষ্টান্ত বিহীন আত্মোৎসর্গকারীদের নামেও আজ কলঙ্ক আরোপ করা হইতেছে এবং চার পয়সা মূল্যের সংবাদপত্রে দুই পয়সা মূল্যের লোকদের দ্বারা প্রবন্ধ লেখানো হইতেছে যে, সকল আহমদী মিলিটারী অফিসার বিশ্বাসঘাতক ছিল। কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধে সেদিন পর্যন্ত যে কথা বলা হইতেছিল, তাহা ঐতিহাসিক সত্য। তোমরা তাহাও একটু শুনিয়া রাখো।

জেনারেল আখতার হোসেন মালেক, জেনারেল আবদুল আলী মালেক এবং আমাদের অন্যান্য জেনারেল ও সেনাবাহিনীর সদস্য সম্বন্ধে পত্র-পত্রিকায় এইরূপ আজে-বাজে প্রবন্ধ লেখানো হইতেছে যে, মানুষ অবাক হয় যে, বিরুদ্ধাচরণে ইহারা কিরূপ পাগল হইয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সরফরাজ খান, হেলালে জুরাত, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। বহুকাল পূর্বেই তিনি অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি নিজ অতীত স্মৃতির ভিত্তিতে পাক-ভারত যুদ্ধ সমূহের পর্যালোচনা করিতে গিয়া লাহোরস্থ “জং” পত্রিকার ১৯৮৪ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় লিখেন:-

“আখতার মালেক যে সুকৌশলে ‘ছম্ব’ আক্রমণ করিলেন, উহাকে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় ছাড়া অন্য কোন নাম দেওয়া যাইতে পারে না। তাঁর অবস্থান এইরূপ ছিল যে, তিনি সম্মুখে অগ্রসর হইয়া ‘জড়িয়া’ দখল করিতে পারিতেন। ছম্বের পর শত্রুরা পর্যুদস্ত হইয়া গিয়াছিল এবং জড়িয়া খালি করার জন্য তিনি কেবলমাত্র পাক বাহিনীর সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু এইরূপ হইতে দেওয়া হইল না। কেননা ইয়াহিয়া খানকে পাকাপোক্তভাবে বসানোর এবং বিজয়ীর মুকুট তাঁর শীরে স্থাপন করার পরিকল্পনা প্রস্তুত হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু ক্ষতি কাহাদের হইল? ভারতকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করিয়া দেওয়ার সুযোগ হাত ছাড়া হইয়া গেল।”

ইহারা হইল আহমদী বিশ্বাসঘাতক (?)। এই বিষয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে যাহা কিছু প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার সব কিছু উপস্থাপন করার সময় নাই। আমি সংক্ষেপে কেবলমাত্র উক্ত সংবাদপত্রগুলির নাম বলিয়া দিতেছি। “জং” পত্রিকা, লাহোর, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪ ইং; মাসিক “হেকায়েত”, এপ্রিল ১৯৭৩ ইং, সাময়িকী ‘আল-ফাত্তাহ্’, ২০শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৬ ইং ‘জং’ পত্রিকা, ১২ই এপ্রিল, ১৯৮৩ ইং—এই সকল ঘটনা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে ‘মকতুবা আলীয়া’ আইবেক রোড, লাহোর কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক “ওয়াতেন কে পাঁচবান”-এ ইসলামের এই পাকিস্তানী আহমদী বাহাদুরদের বীরত্ব ও পরাক্রমের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। ইহা একজন আহমদীর দেশপ্রেমের আবেগ ও মাতৃভূমির জন্য কুরবানীর উজ্জ্বল প্রমাণ। যাহা হউক, "জং” পত্রিকা ইহার ১৯৮৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় লিখিয়াছে যে, ভারতের জন্য জেনারেল আখতার মালিক এইরূপ মারাত্মক বিপদের কারণ ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী স্বয়ং ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধানকে এই মর্মে নির্দেশ দিলেন, মেজর জেনারেল আখতার হোসেন মালিক যেন কোন অবস্থাতেই বাঁচিতে না পারে। ইহা বহু পুরাতন পত্রিকা নহে; মাত্র দুই বৎসর পূর্বেকার পত্রিকা।

যে সুরেশ কাশ্মীরী সমগ্র জীবন আহ্‌মদীয়াতের বিরুদ্ধাচরণে বিনষ্ট করিল, তাহার হৃদয়ের অবস্থার কথা শ্রবণ করুন। যখন ইসলামের জন্য, বা মুসলমানদের জন্য, বা নিজেদের মাতৃভূমির জন্য আহমদীরা ময়দানে গিয়া যুদ্ধ করে তখন তাহা এতই সুন্দর দেখায় এবং উক্ত ময়দানে তাহারা এইরূপে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, দুশমনেরাও ‘সাবাস’ ‘সাবাস’ বলিতে বাধ্য হইয়া পড়ে। যদিও পরে তাহারা অনিবার্যভাবে গাল-মন্দ করিতে থাকে, তথাপি যাহা হৃদয়ের আওয়াজ, যাহা সত্য কথা, তাহাতো হৃদয় হইতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাহির হইয়া পড়ে। অতএব সুরেশ কাশ্মীরী ঐ সময়ে যখন জেনারেল আখতার মালিকের মহান ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করিলেন, তখন তিনিও এই কথা বলিতে বাধ্য হইয়া পড়িলেন যে:-

“দেহেলী সর জমীন নে পুকারা হ্যায় সাথিও
আখতার মালিক কা হাত বাটাতে হুয়ে চলো।
গঙ্গা কি ওয়াদীয়ো কো বাতা দো কে হাম হ্যায় কোন্
যমুনা পে জুলফিকার চালাতে হুয়ে চলো।”

(উপরোক্ত উদ্ধৃত কবিতাটির অর্থ:- হে সাথীরা! দিল্লীর মাটি আমাদিগকে ডাক দিতেছে। আখতার মালিকের হাত মজবুত করিতে করিতে চলো। গঙ্গার সমতল ভূমির অধিবাসীদিগকে বলিয়া দাও যে, আমরা কে। যমুনায় আলীর তলোয়ার চালাইতে চালাইতে অগ্রসর হও। - অনুবাদ)

যখন রণক্ষেত্র সরগরম ছিল তখন সুরেশ কাশ্মীরী অন্য কোন জেনারেলকে দেখিতে পান নাই, যাহার হাতকে মজবুত করিতে যখন রণক্ষেত্র সরগরম ছিল জেনারেলকে দেখিতে পান নাই, যাহার হাতকে মজবুত করিতে করিতে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার কথা তিনি বলিতে পারিতেন। দিল্লীর মাটি যাহাকে ডাক দিয়াছিল, সে ছিল আহ্‌মদী মায়ের পুত্র। এই আহ্‌মদী বিদ্বেষী ব্যক্তি রণক্ষেত্রে আহ্‌মদী বাহাদুরকেই দেখিতে পাইতেছিল। আখতার মালিক বেচারাতো পৃথিবী হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের এতটুকু বিবেকও নাই। তাহারা তাঁহার মাজারকে লাঠি পেটা করিতেছে। তিনিতো ছিলেন পাকিস্তানের একজন মহান দেশপ্রেমিক জেনারেল। তাঁর বীরত্ব ও যোগ্যতা জগতব্যাপী স্বীকৃত। এবার আসা যাক জেনারেল আবদুল আলী মালিকের কথা। তিনিতো অবসরপ্রাপ্ত জীবন যাপন করিতেছেন। কিন্তু তিনি যখন ইসলামী দেশের ইসলামী সরকারের এই চেলা চামুণ্ডাদিগকে তাঁহাকে পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতক এবং ইসলামী দেশসমূহের দুশমন বলিতে শুনেন, তখন তাঁর মনের অবস্থা কি হইতে পারে? এই সেদিনও আবদুল আলী মালিক তোমাদের হিরো ছিল। যখন গোটা চবিন্দা বিপদগ্রস্ত ছিল, মাত্র চবিন্দাই নয়, বরং যখন গোটা সেক্টর মারাত্মকভাবে বিপদগ্রস্ত ছিল এবং তাঁর উপরস্থ জোর্নেল তাঁহাকে নির্দেশ দিতেছিলেন যে, যেহেতু তুমি কোন অবস্থাতেই প্রতিরোধ করিতে পারিবে না, কাজেই পশ্চাদপসরণ কর, তখন এই আবদুল আলী মালিকই বলিতেছিলেন, “যদি আমি পশ্চাদপসরণ করি তাহা হইলে পাক-বাহিনীর জন্য রাওয়ালপিণ্ডি পর্যন্ত কোন আশ্রয়স্থল থাকিবে না। কাজেই যদি মরিতে হয় আমি এইখানেই মরিব। আমি এক ইঞ্চিও পশ্চাতে হটিব না।” এই সময় যখন আল্লাহতা’লা বিজয় দান করিলেন তখন কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর লোকই নহে, বরং বড় বড় আলেম ও বুজুর্গগণও বলিয়া উঠিলেন যে, একেই বলে যোদ্ধা এবং ইহাই হইল জেহাদ। বস্তুতঃ পাকিস্তানের মজলিসে ওলামায়ের আহ্বায়ক আল-হাজ্ব মাওলানা ইরফান রুশদী সাহেব তাঁর পুস্তক “মারেকা হক ও বাতেল” এর ৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেন:-

"কর রাহা থা গাজীয়ু কি জব কামাল আবদুল আলী
থা ছফুমে মেছলে তুফান রাঁওয়া আবদুল আলী।”

(উপরোক্ত পঙতির অর্থঃ- আব্দুল আলী যখন গাজীদের পূর্ণ শৌর্য্য ও বীর্য্য প্রদর্শন করিতেছিলেন, তখন সারিতে ভয়াবহ তুফান সদৃশ ছিল আবদুল আলী। - অনুবাদক)

এই সেই দিনও আব্দুল আলী তুফান-সদৃশ ছিল। আজ তোমাদের ধমনীতে মিথ্যা তুফান প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে। ইহাদের কোন বিবেক নাই, কোন অনুতাপ নাই, কোন লজ্জা নাই যে, ইহারা কি বলিতেছে এবং কাহার বিরুদ্ধে কথা বানাইয়া বলিতেছে।
৮। প্যালেষ্টাইনের ক্ষেত্রে আহ্‌মদীয়া জামা’তের মহান খেদমত ও সেবা

এখন প্যালেষ্টাইন সমস্যার বিষয়টি একটু শুনুন। ইহার সম্বন্ধে এত তথ্য রহিয়াছে যে, এই খোৎবায় এইগুলি বলিয়া শেষ করা সম্ভব হইবে না। কিন্তু মৌলিকভাবে আমি এই বিষয়টির পরিচিতি দিতেছি। আহ্‌মদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে দুই ধরণের অপবাদ আরোপ করা হইয়াছে। প্রথম অপবাদ এই যে, চৌধুরী মোহাম্মদ জাফরউল্লাহ খান সাহেবের দরুন প্যালেষ্টাইন ইস্যুটির সর্বনাশ হইয়াছে। তিনিই এই ইস্যুটিকে বরবাদ করিয়া দিয়াছেন। যদি চৌধুরী সাহেবের পরিবর্তে অন্য কেহ হইতেন, তাহা হইলে প্যালেষ্টাইনের ব্যাপারে সফলতা অর্জন করা যাইত। তিনি জানিয়া বুঝিয়া ও অসাধু উদ্দেশ্যে ইসলামী স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন। দ্বিতীয় অপবাদটি এই যে, আহ্‌মদীরাতো ইস্রাইলের প্রতি বিশ্বস্ত। ছয়শত আহ্‌মদী বর্তমানে ইস্রাইলী সেনাবাহিনীতে খেদমত সম্পাদন করিতেছে। এই ছয়শত আহ্‌মদী বিগত দশ-পনের বৎসর হইতে ছয়শতই রহিয়াছে। কোন যুদ্ধে তাহারা মরেও না, পৃথিবী হইতেও তাহারা বিদায় গ্রহণ করে না এবং তাহারা বৃদ্ধিও পায় না। তাহারা সংখ্যায় ছয়শতই থাকিয়া যাইতেছে। এই প্রসঙ্গে ইহাও বলা হইয়া থাকে যে, যেহেতু প্যালেষ্টাইনে আহ্‌মদীয়া মিশন রহিয়াছে, কাজেই আহ্‌মদীরা নিশ্চিতভাবে ইস্রাইলের এজেন্ট। আহ্‌মদীদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলের এজেন্ট হওয়ার আপত্তির ইহাই হইল সার কথা। এই ব্যাপারে সর্বপ্রথমে ইহাই দেখা উচিত যে, মিশন কাহাকে বলে। আহ্‌মদীয়াতের বিরুদ্ধবাদীরা ইহাও অবগত নহে যে, মিশন কোন্ বস্তুর নাম। তাহারা ‘আহ্‌মদীয়া জামা’তের তবলীগি মিশন’ নামক পুস্তকটিতে “মিশন” শব্দটি পড়িয়াই আপত্তি করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। হয়তবা তাহারা নিজেরাই ধোকার মধ্যে রহিয়াছে, নয়ত জামা’তকে ধোকা দিতেছে যে, যেভাবে সরকার কর্তৃক স্থাপিত রাজনৈতিক মিশন থাকে আহমদীদের মিশনও ঐ ধরণেরই কিছু একটা হইয়া থাকিবে। নিরীহ জনসাধারণ বুঝিতেই পারে না যে ব্যাপারটি কি। তাহারা সরলপ্রাণ। তাহারা কথা শুনে এবং অবাক হইয়া দেখে যে সমগ্র ইসলাম জাহান ইস্রাইলের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে, কিন্তু সেখানে আহ্‌মদীদের মিশন কায়েম আছে। এইভাবে ইস্রাইলের সহিত আহ্‌মদীদের যেন রীতিমত কুটনৈতিক সম্পর্ক রহিয়াছে। আরে ভাই, যাহাদের কোন সরকারই নাই, তাহাদের সহিত অন্যের কুটনৈতিক সম্পর্ক কিরূপ থাকিতে পারে? আহ্‌মদীয়া জামা’তের এই মিশনের অর্থ হইল তবলিগী মিশন, মিশনের অর্থ হইল ইসলামের পক্ষ হইতে ইহুদী মতবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণকারী মিশন। ইহা এইরূপ একটি মিশন, যাহা বড়ই সাহস ও নির্ভিকতার সহিত মিথ্যার বিরুদ্ধে একটি জিহাদ করিতেছে এবং ইহুদিদিগকে মুসলমান বানানোর কাজ করিতেছে। তোমরা কেন খোদার নিকট এই দোয়া করিতেছ না, যাহাতে তোমরাও এইরূপ মিশন স্থাপন করার তওফিক লাভ কর।

সুতরাং আপত্তিকারীদের কোন জ্ঞান নাই। তাহারা উপলক্ষও কিছু বুঝে না এবং কি ধরণের কথা হইতেছে ও কি বলা হইতেছে - তাহাও তাহারা জানে না। তাহারা জনগণকে ক্ষেপাইয়া তোলার পেশা অবলম্বন করিয়াছে। তাহারা কোন কোন পরিভাষা প্রণয়ন করিয়াছে এবং তাহা জনগণের মধ্যে বিস্তার করিতেছে। তাহারা কোন কোন মিথ্যা কথা বানাইয়া লইয়াছে এবং নিরীহ মুসলিম জনসাধারণ সম্পূর্ণ সরলান্তকরনে এইগুলি বিশ্বাস করিয়া থাকে। একটি ব্যাপারে আমি আনন্দিতও বটে। কেননা ইহা দ্বারা এই কথা অনিবার্যভাৱে প্রমাণিত হইয়া যায় যে, মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামের জন্য ভালবাসা নিশ্চয় রহিয়াছে। কিন্তু এই ভালবাসাকে যাহারা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করে তাহারা যালেম। যদি জনগণের মধ্যে ইসলামের জন্য ভালবাসা না থাকিত, তাহা হইলে মৌলভীদের উস্কানির দরুন তাহারা কখনো আহ্‌মদীয়া জামাতের বিরুদ্ধাচরণ করিত না। কাজেই এখন আমাদের জন্য ইহা জরুরী যে, ইসলামের জন্য যাহাদের ভালবাসা রহিয়াছে তাহাদের সহিত আমরা যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তাহাদিগকে বলি, প্রকৃত ঘটনা কি। আপনারা স্বয়ং তাহাদের নিকট যান এবং তাহা মুসলিম জনগণের নিকট সরাসরি পৌঁছান জরুরী। কেননা যেখানে ইসলামের জন্য ভালবাসা রহিয়াছে, সেখানে খোদাতা’লা নিশ্চয় কল্যাণ নিহিত রাখিয়াছেন। ইহা হতে পারেনা যে ইসলামের জন্য যাহাদের ভালবাসা আছে, খোদাতা’লা তাহাদিগকে বিনষ্ট করিবেন। এই জন্য আমি পূর্ণ বিশ্বাসী যে পাকিস্তানের মুসলিম জনসাধারণ হউক, ইন্দোনেশিয়ার জনসাধারণ হউক, মালয়েশিয়ার জনসাধারণ হউক বা আরবে বসবাসকারী হউক, আফ্রিকান দেশ সমূহে জীবন যাপনকারী হউক বা অন্য কোথাকার অধিবাসী হউক, যদি তাহাদের নিকট আহ্‌মদীয়া জামাতের প্রকৃত সত্য তুলিয়া ধরা হয় তাহা হইলে এমনটি হইতে পারে না যে তাহারা প্রভাবান্বিত হইবে না। তাহারা নিশ্চয় ঐ দিকে থাকিবে যেদিকে ইসলাম থাকিবে। তাহারা নিশ্চয় ঐদিকে থাকিবে যেদিকে কুরআন থাকিবে। তাহারা নিশ্চয় ঐ দিকে থাকিবে, যেদিকে মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ, সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থাকিবেন। তাহারা সত্যের সমর্থন করিবে। কেননা ইসলামের জন্য ভালবাসার দরুন বর্তমানে তাহারা আপনাদের সহিত শত্রুতা করিতেছে। তাহাদের নিকট আপনাদের চেহারা এইভাবে উপস্থাপন করা হইতেছে যেন আনপারা তাহাদের দুশমন। তাহাদিগকে বলা হইতেছে যে - দেখ, আহমদীরা ইস্রাইলে মিশন স্থাপন করিয়াছে এবং এই জন্য তাহাদের ইস্রাইলের এজেন্ট হওয়া প্রমাণিত হইয়াছে।

প্রথমতঃ মিশন থাকাটাই এজেন্ট হওয়ার কোন দলিল নহে। ইহা খুবই আহম্মকীপূর্ণ কথা। রাশিয়াতে পাকিস্তানের মিশন আছে, সেইজন্য কি পাকিস্তান রাশিয়ার এজেন্ট? আমেরিকায় পাকিস্তানের মিশন রহিয়াছে, তেমনিভাবে ইংল্যান্ডে রহিয়াছে এবং আরও কত দেশে পাকিস্তানের মিশন রহিয়াছে। তাহা হইলে কি পাকিস্তান এই সব দেশের এজেন্ট?
৯। সত্যকে পর্দাচ্ছন্ন করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা

আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রথমতঃ একটি দেশ অন্য দেশে যেভাবে সরকারী পর্যায়ে মিশন স্থাপন করে, ইস্রাইলে আমাদের তদ্রূপ কোন মিশনই নাই। কিন্তু যদিও এইরূপ কোন মিশন থাকিত, তাহা হইলে ক্ষতির কি কারণ ঘটিত? কেননা কেহ এই কথা বলিয়া দিতেছে না যে, আহ্‌মদীরা ইস্রাইলে বসিয়া কি ক্ষতি সাধন করিতেছে এবং কি ধরণের এজেন্টের কাজ করিতেছে। আজ পর্যন্ত আহ্‌মদীদের বিরুদ্ধে এইরূপ কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয় নাই যে আহমদীরা বিদেশী শক্তি হইতে এক কানাকড়ি সাহায্য গ্রহণ করিয়াছে। খোদার ফজলে আহ্‌মদী জামা’ত এইরূপ কোন সাহায্যের মুখাপেক্ষীও নহে। প্রশ্ন এই যে, তোমরা একটু বলিয়া দাও, আহ্‌মদীয়া জামা’তের মন্দ কার্য্য-কলাপ ও অবিশ্বস্ততার ঘটনাগুলি কি? তোমাদের ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক লিখিত ঘটনাবলী একটু পড়িয়া শুনাও, আহ্‌মদীয়া জামা’ত কি বিশ্বস্ততার কাজ করিয়াছে। তোমরা শুদ্ধি-আন্দোলনের কথা স্মরণ কর, কাশ্মীরের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা স্মরণ কর, যেখানে পাক-ভারত যুদ্ধ গুলিতে আহ্‌মদীরা সর্বদা পাকিস্তানের জন্য সকলের চাইতে অধিক জীবন দিয়াছে। কাশ্মীর ফ্রন্টের কথা স্মরণ কর, যেখানে ছোট ছোট ছেলে, যুবক, বৃদ্ধ, চাষী, ছাত্র—সব ধরণের আহমদী মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতে নিজেদের খরচে সমবেত হইয়াছিল। মাতৃভূমি হইতে কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাহারা ইহা করে নাই। ইহাই কি বিশ্বাসঘাতকতা? তাহাদের দ্বারা ইস্রাইলের কি স্বার্থ উদ্ধার হইবে? এইরূপ লোকদের শক্তি বাড়াইয়া ইস্রাইলের কি লাভ হইবে? একটু পরেই আমি আপনাদের নিকট প্রকাশ করিব, বিশ্বাসঘাতক কে? তাহা হইলে আপনারা বুঝিতে পারিবেন, প্রকৃতপক্ষে কাহারা বিশ্বাসঘাতক এবং কাহারা অন্যদের এজেন্টরূপে কাজ করিতেছে। যাহা হউক, দুশমনেরা আমাদের বিরুদ্ধে অদ্ভুত আপত্তি উত্থাপন করিয়াছে। বলা হইতেছে যে, আহমদীরা ইস্রাইলে মিশন খুলিয়াছে। কিন্তু কেহ ইহা দেখিতেছে না যে, ইস্রাইলের তখনও জন্মই হয় নাই যখন আহমদীয়া জামা’ত খোদার ফজলে প্যালেষ্টাইনে শাখা স্থাপন করিয়াছিল এবং এখনও তাহা প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। পৃথিবীর যেখানেই আমাদের জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সেখাই আমাদের মিশন রহিয়াছে, সেখানেই আমাদের প্রচারকগণ কাজ করিতেছেন এবং এখনও তাহারা জামা’তের সদস্যদিগকে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করিতেছেন। এতদ্ব্যতীত ইহাওতো দেখুন, ইস্রাইলেঅন্য মুসলমানদেরও মসজিদ রহিয়াছে এবং ঐগুলিতে ধর্মীয় আলেম নিযুক্ত রহিয়াছে। ইহাওতো লক্ষ্য করুন, ইহুদী অধিকৃত প্যালেষ্টাইনী এলাকায় কত মুসলিম সম্প্রদায় রহিয়াছে, এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব মসজিদ রহিয়াছে, নিজস্ব ইমাম রহিয়াছে এবং ইহারই নাম হইল মিশন। সুতরাং সমগ্র ইসলাম জাহানই যদি এজেন্ট হইয়া থাকে, তাহা হইলে বেচারা আহ্‌মদীরা এজেন্ট হইলে কি আসে যায়? এতদ্‌সত্বেও বলিতে হয়, প্যালেষ্টাইনে ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পর আহ্‌মদীয়া জামা’তের কোন মিশন সেখানে কায়েম হয় নাই। ইহা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা যে, সেখানে আহমদীদের নতুন কোন মিশন কায়েম হইয়াছে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, সর্ব প্রথম ১৯২৪ সালে আহ্‌মদীয়া জামা’তের পক্ষ হইতে সেখানে প্রচারক প্রেরণ করা হইয়াছিল। অতঃপর ১৯২৮ সালে আহমদীয়া জামা’ত সেখানে নিয়মিত তবলিগী মিশন কায়েম করে। সুতরাং ২৪ বৎসর পূর্ব হইতে যে দেশে খোদার ফজলে আহ্‌মদীরা আবাদ ছিল এবং কর্মতৎপর একটি জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সেখানে প্রচারক প্রেরণ করার নাম বিরুদ্ধবাদীদের দৃষ্টিতে ইস্রাইলের এজেন্টগিরি করা।
১০। অধিকৃত প্যালেষ্টাইনের মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিবৃতি

ইব্রাহীম সাহেব নামে আমাদের একজন আহ্‌মদী বন্ধু রহিয়াছেন। তিনি কাবাবীর জামা’তের সদস্য। তিনি যখন সাম্প্রতিক ঘটনাবলী শুনিলেন যে, সমগ্র বিশ্বে হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছে যে আহ্‌মদীরা ইস্রাইলের এজেন্ট, তিনি তখন বলিলেন, প্যালেষ্টাইনের আলেমরাও এই ব্যাপারটি সম্বন্ধে অবগতই নহে। তিনি আরও বলিলেন, পাকিস্তান একটি অদ্ভুত দেশ। তাহারা সমগ্র বিশ্বে হৈ চৈ করিয়া বেড়াইতেছে। তাহারা এই কথা আরবদের কেন জানাইতেছে না? বস্তুতঃ তিনি প্যালেষ্টাইনের সকল শীর্ষ স্থানীয় মুসলমান নেতৃবৃন্দের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাহাদিগকে বলেন যে, ইহা একটি যুলুম এবং মিথ্যার বেসাতী।

আমাদের বিরুদ্ধে এই অপবাদ আরোপ করা হইতেছে যে, আমরা ইস্রাইলী সেনাবাহিনীতে চাকুরী করিতেছি এবং আমরা ইস্রাইলের এজেন্ট। বস্তুতঃ এই মুসলিম নেতৃবৃন্দ সীল মোহর লাগাইয়া লিখিত ভাবে বলিলেন, আহ্‌মদীরা ইস্রাইলী সেনাবাহিনীতে চাকুরী করে না এবং তাহারা ইস্রাইলের এজেন্ট নহে এবং যেকোন স্থানে এই কথা প্রচার করার জন্য তাহারা সম্মতিও দান করেন। তাহারা বড়ই খোদাভীরু মানুষ এবং সত্য কথা বলিতে ভয় পান নাই। তাহাদের লিখিত চিঠিতো খুবই দীর্ঘ। আমি ইহার সারাংশ পড়িয়া শুনাইতেছি। তাহারা স্বীকার করিয়াছেন, আহ্‌মদীয়া জামা’ত একটি মুসলমান জামা’ত। তাহারা এক খোদাকে মানে। তাহারা বিশেষভাবে ধর্মীয় ও ইসলামী বিষয়ের সহিত সম্পর্ক রাখে। রাজনীতির সহিত তাহাদের কোনো সম্পর্ক নাই। তাহারা খুব সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষ। সামাজিক ও নৈতিক দিক হইতে তাহারা কাহারো চাইতে কম নহে। তাহারা সকলকে প্রীতি ও ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে। তাহারা ধর্মীয় শিক্ষার হেফাযত করিয়া থাকে। আহ্‌মদীয়া জামা’তের সদস্যগণ প্রশংসনীয় স্বভাব ও চরিত্রের অধিকারী। তাহারা সমাদরযোগ্য ও স্বদেশ-প্রেমিক জামা’ত। তাহারা ইস্রাইলী সামরিক তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করে না। তাহারা আইনকে মর্যাদা দেয় এবং জাগতিক ও আমোদ-স্ফূর্তি অর্থহীন হাসি-তামাশা হইতে দূরে থাকে।

ইহাই হইল ইস্রাইল অধিকৃত প্যালেষ্টাইনে বসবাসকারী মুসলিম নেতাগণের সার্টিফিকেট এবং এই সার্টিফিকেটের উপর যাহাদের দস্তখত রহিয়াছে তাহারা হইলেন:-

আক্কা ও হাইফার শরীয়তী বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ ইব্রাহীম, সেখ মেয়র নমীর হোসেন, লোকাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আমের জামির দরবেশ, পার্লামেন্ট সদস্য মোহাম্মদ ওতদ, এডভোকেট মোহাম্মদ খালু মাছারু, মুসলিম ইনভাইটেশন কমিটির সেক্রেটারী ফাত্তা তুরানী, হাইস্কুলের হেডমাস্টার মাহমুদ মুসালেহ এবং হাইফার ছামীমরী ইউনিভার্সিটির লেকচারার।
১১। আমাদের বন্ধু ইব্রাহীম সাহেব সুকৌশলে ইসরাইলী সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের বক্তব্য একত্রিত করিয়া দিলেন

এই ব্যাপারে একদা আমিও “রাবওয়া ছে তেলআবিব তক” (রাবওয়া হইতে তেলআবিব পর্যন্ত) নামক একটি পুস্তকের উত্তর দিতে গিয়া বিরুদ্ধবাদীদিগকে বলিয়াছিলাম, তোমরা হইলে আলেম। অতএব খোদাকে ভয় কর। তোমরা বলিতেছ, ছয়শত আহ্‌মদী ইস্রাইলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছে। প্রথমে বল, ইহুদীর কোন্ এজেন্ট তোমাদিগকে এই তথ্য পরিবেশন করিয়াছে? তোমরা কোথা হইতে ইহা অবগত হইয়াছে? তাহাদের মধ্য হইতে একজনের নাম বলিয়া দাও। আমি বলিয়াছিলাম, তোমরা যদি ছয়শতের নাম না বলিতে পার, তাহা হইলে অন্ততঃ ষাট জনের নাম বলিয়া দাও, ষাট জনের নাম না বলিতে পার, তবে ছয়জনের নাম বলিয়া দাও। যদি ছয় জনের নাম না বলিতে পার, তাহা হইলে পাকিস্তানের বা পাকিস্তানের বাহিরে যে কোন দেশের একজন আহ্‌মদীর নাম বলিয়া দাও যে ইস্রাইলি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করিয়াছে। কিন্তু তাহারা আজ পর্যন্ত একটি নামও উপস্থিত করিতে পারে নাই। কেউ থাকিলেতো বলিবে! কল্পিত নামতো বলাই যায় না। কেননা এইরূপ নাম বলিলে মহল্লার নামও ঠিকানা বলিতে হইবে। স্থানের নাম বলিতে হইবে। তদনুযায়ী প্রত্যেকে দেখিতে পারিবে, এই নামের কোন মানুষ আছে কিনা। ইহাতো কোন রেফারেন্ডাম নহে যে, কল্পিত নাম বসাইয়া লইবে এবং মৃত ব্যক্তিদের ভোটও বাক্সে ফেলিয়া দিবে। যদি ইস্রাইলী সেনাবাহিনীতে আহ্‌মদী কর্মচারী থাকে, তাহা হইলে দেখাইতে হইবে কোন্ কোন্ আহমদী রহিয়াছে।
১২। ইসলাম জাহানের সহিত আহ্‌মদীয়া জামা’তের বিশ্বস্ততা

ইসলাম এবং প্যালেষ্টাইনের মুসলমানদের স্বার্থের সহিত আহ্‌মদীয়া জামা’তের বিশ্বস্ততার সম্পর্ক কোন গোপন ব্যাপার নহে। ইহা আজিকার ব্যাপারও নহে। যখন আহ্‌মদীয়া জামা’ত খোদাতায়ালার ফজলে প্যালেষ্টাইনের ইসলামী স্বার্থের সহিত এক গভীর সম্পর্ক রাখিত, তখন তো তোমাদের হুঁশই ছিল না এবং তোমরা প্যালেষ্টাইনের নাম ব্যতীত আর কিছুই জানিতে না। আহ্‌মদীয়া জামা’তের খলীফাগণ প্যালেষ্টাইনের মুসলমানদিগকে প্রত্যেকটি বিপদের সময় সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে অবগত রাখিতেছিলেন ও তাহাদের প্রত্যেকটি সম্ভবপর খিদমতের জন্য আহ্‌মদীয়া জামা’তকে পেশ করিতেছিলেন। এই ব্যাপারটি দেশ-বিভাগের পূর্ব হইতে চলিয়া আসিতেছে। এমনকি তোমাদের আহরারী পত্র পত্রিকাও ইহা স্বীকার করিয়াছে। তাহারা নিজেদের মুখে ইহা স্বীকার করিয়াছে এবং নিজেদের কলমের দ্বারা এই কথা লিখিয়া গিয়াছে যেঃ- “বিশ্ব মুসলিম ও ইসলাম জাহানের সহিত কাদিয়ানের মির্যা মাহমুদ আহমদ সাহেব যে ভালবাসার প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহার দৃষ্টান্ত খুব কম দেখিতে পাওয়া যায়।”

যে পত্রিকা আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধাচরণের জন্য উৎসর্গীকৃত, এত ঘৃণা সত্ত্বেও উহার কণ্ঠ হইতে যখন সত্যের আওয়ায বাহির হয়, তখন আনন্দিত হইতে হয়। ইহাকে প্রমাণ বলা হয়। বস্তুতঃ সত্যের এইরূপ একটি আওয়াজ আমি পড়িয়া শুনাইয়া দিতেছি।

মজলিসে আহরারের “জমজম” নামে একটি পত্রিকা ছিল। ইহা জামা’তের বিরুদ্ধাচরণে উৎসর্গীকৃত ছিল। এতসত্ত্বেও দেশ বিভাগের পূর্বে যখন মিশরের কোন কোন স্বার্থ বিপদের সম্মুখীন হইল, তখন হযরত মুসলেহ্‌ মাওউদ নাওয়া রাল্লাহ্‌ মারকাদাহু এই ব্যাপারে সংগ্রাম ও জিহাদ করিয়াছিলেন। ইহাতে মুগ্ধ হইয়া উল্লেখিত আহরারী পত্রিকা ইহার ১৯শে জুলাই, ১৯৪- সালের সংখ্যায় লেখেঃ-

“বর্তমান অবস্থায় খলীফা সাহেব মিশর ও পবিত্র হেযাযের জন্য ইসলামী মর্য্যাদাবোধের যে প্রমাণ দিয়াছেন, তাহা নিশ্চিতভাবে সমাদরযোগ্য এবং তিনি এই মর্য্যাদাবোধ প্রকাশ করিয়া মুসলমানদের আবেগের সঠিক অভিব্যক্তি করিয়াছেন।”

এখন দেখুন, মুসলমানদের মুখপাত্ররূপে যদি তাহারা কাহাকেও দেখিয়া থাকে, তবে আহ্‌মদীদিগকেই দেখিয়াছে। তাহারা আহ্‌মদীদের নেতাকে উত্তম মুখপাত্র মনে করিতেছিল। খোদাতা’লার ফযলে মুসলমানদের খেদমতের জন্য প্রতিটি প্রচেষ্টায় আহ্‌মদীয়া জামা’ত সর্বদা সর্বাগ্রে ছিল। কিন্তু আজ তোমাদের কি হইয়াছে? তোমাদের মধ্যে কি কোন খোদা-ভীতি অবশিষ্ট নাই? এই সেদিনও তোমরা যে কথা বলিতেছিলে, উহার সব কিছু ভুলিয়া গিয়া আজ উহার বিপরীত কথা বলিতেছ।

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।