আপত্তির জবাব

প্যালেষ্টাইনি মুসলমানদের ট্রাজেডি এবং আহমদীয়া জামা’তের অনন্য খেদমত

সূরা আলে-ইমরানের ১১১ এবং ১১৪-১১৬ নম্বর আয়াতে আহলে কিতাবদিগকে তবলীগ করার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করাহইয়াছে। অতঃপর অত্যন্ত প্রীতিপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভ ভাষায় ইহাও বলাহইয়াছে যে, যদি আহলে কিতাবরা ইসলাম গ্রহণ না করে, উহাদের নিজেদের অপরাধ হইবে। এই ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের গোলামদের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে না। কেননা তাহারা নিজেদের দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার ত্রুটি করে না এবং তাহারা এইভাবে তবলীগ করে যাহাতে “হুজ্জত” (দলিল প্রমাণের সাহায্যে সত্য উপস্থাপন) পূর্ণ হইয়া যায়।

কিন্তু আহলে কিতাবদিগকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করিয়া দেওয়া এবং ‘মরদুদ’ আখ্যায়িত করা যে, তাহাদের মধ্যে উত্তম কিছুই আর অবশিষ্ট নাই, ইহাও কুরআন করীম সাধারণভাবে নিষেধ করিয়াছে। কোন সম্প্রদায়কে জাতি হিসাবে এইভাবে গল্পপ্রাপ্ত ও অভিশপ্ত আখ্যায়িত করা যেত, তাহাদের মধ্যে কোন ব্যতিক্রমই নাই এবং তাহাদের মধ্যে কোন উত্তম মানুষী নাই, ইহাও আল্লাহতা’লার ইচ্ছার বিরোধী। বস্তুতঃ এই কারনে কুরআন করীম এইরূপ লোকদের সম্বন্ধেও আশা পোষণ করে, যাহাদিগকে উম্মতে মুহাম্মদীয়া (সাঃ) বাহ্যতঃ মৃত মনে করিয়া বসিয়াছিল বামৃত মনে করিয়া বসিয়াছে। কুরআন করীম বলে যে, খোদাতা’লা মৃতদেরকেও জীবন দান করিতে পারেন। অতএব এই সকল জাতি সম্বন্ধেও হতাশ হওয়া উচিত নহে এবং নিজেদের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে কখনো উদাসীন হওয়া উচিত নহে।
১। উত্তম উম্মতের গুণাবলী

বস্তুতঃ খোদাতা’লা বলেন, “কুন্তুম খাইরা উম্মাতেন উখরেজাত লিন্নাসে” তোমরা উত্তম উম্মত। মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদিগকে পৃথিবীতে সৃষ্টিকরা হইয়াছে। তোমাদের মধ্যে এই উত্তম বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে যে, তোমরা ভালকাজের আদেশ দাও এবং দিতে থাক, মন্দকাজে বাধা দাও এবং বাধা দিতে থাক এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখো এবং তাহারই উপর তোমরা ভরসা করো। তোমরা নিজেদের হাতে দারোগার দায়িত্ব গ্রহণ করিও না। তোমরাই হইলে ঐ সকল লোক, যাহারা তবলীগের দায়িত্ব পুরাপুরিভাবে পালন করিয়া থাকে এবং তৎপর নিজেদের রব্ব ও তাঁহার কুদরতের উপর ঈমান রাখে। অতঃপর আল্লাহতা’লা বলেন, “অলাও আ’মানা আহালুল কেতাবে লাকানা খাইরাল্লাহুম” যদি আহলে কেতাবীরা ঈমান আনিত, তাহা হইলে ইহা তাহাদের জন্য উত্তম হইত। ঈমান না আনা তাহাদের অপরাধ। কেননা উম্মতে মুহম্মদীয়া তো নিজেদের দায়িত্ব শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছে। এখন তাহাদের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠিবে না। এখন ঐ সকল আহলে কেতাবদের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠিবে, যাহারা মুসলমানদের এই সকল গুণ থাকা সত্ত্বেও ঈমান আনার সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে। অতঃপর বলা হইয়াছে যে, সব আহলে কেতাব এক পর্যায়ের নহে। তাহাদের মধ্যে এইরূপ ব্যক্তিও রহিয়াছে, যাহারা ‘উম্মতে কায়েম্মা’ অর্থাৎ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘আনায়াল্লাইলে’ তাহারা রাত্রিতে উঠিয়া আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করে। ‘ওয়াহুমইয়াসজুদুন’ তাহারা খোদার দরবারে সেজদারত হয়। তাহারা আল্লাহর উপর ঈমান রাখে, পরকালের উপর ঈমান রাখে, ভালকাজের আদেশ দান করে, মন্দকাজে বাধা দেয় এবং উত্তম কাজে একে অপরের উপর প্রাধান্য লাভ করে। ‘ওয়ুলাইকা মিনাস সালেহীন’ এবং নিশ্চয় এই সকল লোক সালেহগণের (পুণ্য ব্যাক্তিগণের) অন্তর্ভুক্ত। ‘অমাইয়াফয়ালু মিন খাইরেন ফালানইউকফারুহ’ এবং তাহারা যেসব উত্তম কথা বলে, উহার নাশক না করা হইবে। তাহাদিগকে ইহার পুরস্কার হইতে বঞ্চিত করাহইবে না। ‘আল্লাহু আলীমুন বিলমুত্তাকীন’ এবং আল্লাহতা’লা মুত্তাকীগণ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞাত আছেন।

এই ধরনের কোন আয়াত আপনারা কখনো পৃথিবীর কোন ধর্ম পুস্তকে দেখিবেন না। ইহাতে বিরুদ্ধবাদী, বরং কঠোরতম বিরুদ্ধবাদীদেরকেও এইরূপ সম্মানে ভূষিত করাহইয়াছে এবং তাহাদের গুণাবলী এইরূপ প্রীতিভরে স্বীকার করাহইয়াছে যে, হতবাক হইয়া যাইতে হয় এবং মানুষের বুদ্ধি-মত্তাস্বীকার করিতে বাধ্য হইয়া পড়ে যে, এইরূপ কথা খোদাতা’লা ব্যতীত অন্য কাহারো হতে পারে না। অনেক আয়াতের প্রয়োজন নাই, একটি মাত্র আয়াতেই আপনারা পৃথিবীর সকল ধর্মাবলম্বীর নিকট চ্যালেঞ্জ রূপে পেশ করিতে পারেন যে, তোমরা নিজেদের ধর্মপুস্তক হইতে এই ধরনের কোন আয়াত বাহির করিয়া দেখাও, যাহার মধ্যে এতখানি নির্ভিকতা ও এতখানি মহানুভবতা রহিয়াছে। খোদাতা’লার কালাম তো পূর্বেও অবতীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু কোন কামেল বান্দার উপর এইভাবে অবতীর্ণ হয় নাই, যেইভাবে মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের উপর অবর্তীর্ণ হইয়াছে। এইজন্য এই কালাম একদিকে যেমন খোদাতা’লার তরফ হইতে অবতীর্ণ হওয়ার দলিল, তেমনি অন্যদিকে ইহা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের খোদাতা’লার তরফ হইতে প্রেরিত হওয়ারও দলিল। তিনি যদ্রূপ চাহিতেন, যন্ত্রপ তাঁহার হৃদয় ছিল এবং অন্যদের প্রতি যদ্রূপ তাঁর মনোযোগ ছিল, তদ্রূপ কালামই তাঁর উপর অবতীর্ণ করাহইয়াছে। কিন্তু আজ যাহারা নিজদিগকে আঁহযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওসাল্লামের প্রতি আরোপ করে তাহারা আমাদিগকে এই খোঁটা দেয় যে, আমরা কেন ইহুদীদিগকে তবলীগ করি। আমরা ইসরাঈলে গিয়াও তবলীগ করিতে বিরত হইনি। অতএব তাহাদের মতে আমরা অনিবার্যভাবে ইসরাঈলের এজেন্ট। ইহা কিরূপ অজ্ঞতিপূর্ণ কথা! তাহাদের নাহি আসে কুরআনের জ্ঞান, নাহি আসে মুহাম্মদ মুস্তফা সাঃ-এর সুন্নতের জ্ঞান, নতুবা তাহারা এইরূপ ভ্রান্ত এবং অজ্ঞতাপূর্ণ অপবাদ আরোপ করিতে না। কুরআন করীম তো ‘উত্তম উম্মত’ হওয়ার এইদলিল দিতেছে যে, তোমরা নিজেদের তবলীগের আশিস হইতে কোন জাতিকে বঞ্চিত রাখিবে না এবং এই আশিস এইরূপ সার্বজনীন যে, শত্রুদিগকেও তোমরা এই আশিস দিয়ে থাক। অতএব এতদসত্ত্বেও যদিতাহারা হেদায়াত লাভ না করে, তবুও ওহা তাহাদের নিজেদের অপরাধ। উহাতে তোমাদের কোন অপরাধ নাই।
২। আঁ হযরত (সাঃ) এর মহান চারিত্রিক গুণ

উপরোক্ত বিষয়ে আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চারিত্রিক গুণ আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে। পৃথিবীর যেই ইহুদী সর্বপ্রথম মুসলমান হইয়াছিলেন, তাঁহার নাম ছিল হোসাইন বিন সালাম। আঁ-হযরত (সঃ) পরেতাঁহার নাম রাখিয়াছিলেন আবদুল্লাহ বিন সালাম। তিনি (সাঃ) এই আবদুল্লাহ বিন সালামের মাধ্যমে পয়গাম প্রেরণ করিয়া অন্যান্য ইহুদীকেও একত্রিত করিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে তবলীগ করিয়াছিলেন। মোটকথা আঁ হযরত (সাঃ) এর সারা জীবনে এইরূপ একটি ঘটনাও দেখিতে পাওয়া যায় না যে, তিনি (সাঃ) ইহুদীদিগের নিকট তবলীগ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, বা স্বয়ং বাধা প্রদান করিয়াছিলেন, বা তাহাদের সহিত সদাচরণ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, বা স্বয়ং সদাচরণ করা হইতে বিরত ছিলেন।

বস্তুতঃ একদা এক ইহুদি মা তাহার ছেলের মৃত্যুর সময় আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের খেদমতে ছেলের এই পয়গাম পাঠায় যে, “আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়া যাইতেছে, আমি আপনাকে দেখিতে চাই।” তিনি (সাঃ) তৎক্ষণাৎ উঠিয়া পড়িলেন ও তাহাকে দেখার জন্য হাজির হইলেন এবং মৃত্যুর সময় তাহাকে তবলীগ করিলেন এবং বলিলেন, “মুসলমান হইয়া জীবন দেওয়া কি তোমার জন্য উত্তম নহে?” সে বেতনেদেন করিল, “ও আল্লাহর রসূল! হাঁ, ইহাই আমার জন্য উত্তম।” এইরূপে সে মুসলমান হইয়া প্রাণ ত্যাগ করিল। ইহাই হইল মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মহান চারিত্রিক গুণ এবং আমরা ইহারই অনুসরণ করিতেছি। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা আমাদিগকে ইহাতে বাধা প্রদানে প্রচেষ্টারত রহিয়াছে।

অনুরূপ আরও একটি ঘটনা রহিয়াছে। একদিন এক মৃত ব্যক্তির লাশ অতিক্রম করিতেছিল। হযরত আকদাস মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তখন আকস্মাৎ চতুর্দিক হইতে আওয়াজ উঠিল, “ও আল্লাহর রসূল! ইহা ইহুদীর লাশ।” একটি রেওয়ায়েত অনুযায়ী তিনি (সাঃ) বলিলেন, “মৃত্যুর পূর্বে কি তাহার মধ্যে প্রাণ ছিল না?” এতদ্ব্যতীত তিনি এই ধরনের কথা বলিলেন, যদ্বারা মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বলিলেন, “সকলের দুঃখই সমান।” আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামতো (যাঁহার জন্য নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি হইয়াছে) কোন এক ইহুদীর লাশ অতিক্রম করিতে দেখিয়াও উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু আজ এই ঘৃণার শিক্ষা-দানকারীরা এবং ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র চারিত্রিক গুণাবলীর উপর মর্মবিদারী অপবাদ আরোপকারীরা আমাদিগকে এই কথা বলিতেছে যে, তোমরা মুহাম্মদ মুস্তফা সাঃ-এর চারিত্রিক গুণ কেন অনুসরণ করিতেছ? তোমরা কেন আমাদের চারিত্রিক গুণের অনুসরণ করিতেছ না? আমি তাহাদিকে বলিয়া দিতে চাই, আমরা তো কখনো কোন মূল্যে তোমাদের চারিত্রিক গুণ গ্রহণ করিব না। আমাদের সম্মুখে সদাসর্বদা এবং চিরকালের জন্য একটিই চারিত্রিক গুণ রহিয়াছে এবং তাহা হইল আমাদের আকা ও মওলা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মহান চারিত্রিক গুণ। ঐ মহান চারিত্রিক গুণের উপর এখন পর্যন্ত আমরা বাঁচিয়া রহিয়াছি এবং উহারই আমরা অনুসরণ করিব এবং উহারই উপর আমরা জীবন দিব, ইনশাআল্লাহ্।
৩। একটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অপবাদ খণ্ডন

আহমদীরা ইহুদীদের এজেন্ট এবং তাহারা ইহুদীদের স্বার্থে কাজ করিয়াছে (নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক)। এই সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয়, ইহা একটি মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অপবাদ যে, যখন আপনারা সত্য সম্বন্ধে চিন্তাকরিবেন তখন প্রকৃত অবস্থা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিতে পাইবেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্যালেষ্টাইন বিভক্তির যালেমানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে উহা কাহার আওয়াজ ছিল, যিনি সমগ্র ইসলাম জাহানকে সাবধান ও সতর্ক করিয়াছিলেন এবং যিনি আরব জাহানে এবং আরবের বাহিরেও একটি আলোড়ন সৃষ্টি কারিয়াছিলেন। এই সহানুভূতিপূর্ণ সতর্কবাণী হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ) এর আওয়াজ ছিল। তিনি হৃদয়-নাড়ানো একটি প্যাম্ফলেট লিখিয়া বিপুলভাবে তাহা প্রচার করেন। উহাতে তিনি মুসলমানদের সতর্ক করেন এবং বলেন, তোমরা এই ধারণার বশবর্তী হইও না যে, আজ পাশ্চাত্য জগৎ তোমাদের দুশমন, কাজেই প্রাচ্য জগৎ তোমাদের বন্ধু, বা প্রাচ্য জগৎ তোমাদের দুশমন, কাজেই পাশ্চাত্য জগৎ তোমাদের বন্ধু। তিনি বলেন, আমি তোমাদিগকে বলিয়া দিতেছি যে, আজ আমেরিকাও তোমাদের বন্ধু নহে এবং রাশিয়াও তোমাদের বন্ধু নহে। তাহাদের দ্বারা ইসলামের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত ষড়যন্ত্র প্রণীত হইয়াছে। ইসলামের বিরুদ্ধে দুশমনীর দরুন তাহারা নিজেদের মধ্যকার দুশমনী ভুলিয়া বসিয়াছে এবং একহইয়া গিয়াছে। তোমাদের কি আত্ম-মর্যাদা নাই, তোমাদের মধ্যে কি ইসলামের জন্য এইরূপ ভালবাসা নাই, যদ্দরুন তোমরা নিজেদের মধ্যকার দুশমনী ভুলিয়া গিয়া একহইয়া যাও?

ইহা একটি যুক্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসু প্রবন্ধ ছিল, যে, ইহা মুসলমানদিগকে এইভাবে ঝাঁকুনি দিয়া জাগ্রত করিয়াছিল, যাহার ফলে দীর্ঘকাল যাবৎ ইহার প্রতিধ্বনি আরব জাহানে শুনা যাইতেছিল। অতঃপর যখন এই যালেমামা সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়া গেল, তখন তিনি (রাঃ) আরও একটি প্রবন্ধ রচনা করলেন এবং তাহাও বিপুলভাবে প্রচার করলেন। উক্ত প্রবন্ধে এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হইয়াছিল যে, উল্লেখিত সিদ্ধান্তের পর (অর্থাৎ প্যালেষ্টাইনের বিভক্তির পর - অনুবাদক) মুসলমানদের কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যাহা এই হারানো বাজি পুনরায় জিতায় সাহায্য করিতে পারে। ঐ সময় আরব জাহানের যে অবস্থা ছিল এবং যেভাবে তাহারা আহমদীয়াতের এহসানের জন্য কৃতজ্ঞ ছিল তা তো একটি দীর্ঘ বিষয়। কিন্তু আমি আপনাদিগকে কেবলমাত্র একটি উদ্ধৃতি শুনাইতেছি। তদ্বারা আপনারা কেবলমাত্র আরব জাহানের ধারণার কথাই অবগত হইবেন না, বরং ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলো ইহাতে কি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করিয়াছিল এবং তাহারা হযরত মুসলেহ্ মাওউদ (রাঃ) এর আওয়াজকে কতখানি গুরুত্ব দিয়াছিল তাহাও জানিতে পারিবেন।
৪। ইরাকের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকের সত্য উদঘাটন

ইরাকের আল উস্তাজ আলীউল খেয়য়াত আফুন্দী একজন খ্যাতনামা ও চিন্তাশীল সাংবাদিক। “আল-আন বাউ” নামে তাঁহার একটি বিখ্যাত ও বহুল প্রচারিত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি স্বীয় পত্রিকায় একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। উহা হইতে একটি উদ্ধৃতি আমি আপনাদিগকে শুনাইতেছি। তিনি লিখেন:-

“বিদেশের সরকারগুলি সর্বদা এই চেষ্টা করে, যাহাতে বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করা যায় এবং যাহাতে কোন কোন ফেরকা আহমদীদিগকে কাফের আখ্যায়িত করার জন্য ও তাহাদের সমালোচনার আমি ইহা সম্বন্ধে উদ্দেশ্যে দাঁড়াইয়া যাই। ... ... ... আমি ইহা সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত আছি যে, প্রকৃতপক্ষে এই সকল তৎপরতার পশ্চাতে রহিয়াছে ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি। কেননা প্যালেষ্টাইনের বিগত যুদ্ধের সময় ১৯৪৮ সালে ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি স্বয়ং আমাকে এই ব্যাপারে এজেন্ট বানানোর চেষ্টা করিয়াছিল।

এই দিনগুলিতে আমি একটি ব্যাঙ্গাত্মক পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম এবং এই পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করা হইত। বস্তুতঃ এই দিনগুলিতেই বাগদাদে অবস্থিত একটি বিদেশী সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি আমাকে সাক্ষাতের জন্য ডাকেন এবং কিছুটা চাটুকারীতার সূরে আমার রচিত সমালোচনার ধরণের প্রশংসা করার পর বলেন, আপনি নিজ পত্রিকায় কাদিয়ানী জামা’য়াতের বিরুদ্ধে অধিক হইতে অধিকতর পীড়াদায়ক সমালোচনা করিতে আরম্ভ করুন। কেননা ইহারা একটি ধর্মচ্যুত জামায়াত।”

অর্থাৎ একটি ধনতান্ত্রিক শক্তির ইসলামের জন্য এইরূপ দুশ্চিন্তা দেখাদিল যে, তাহারা একজন পত্রিকা সম্পাদককে ডাকিয়া বলেন, কাদিয়ানী জামাতের বিরুদ্ধে পীড়াদায়ক সমালোচনা করিতে আরম্ভ করুন। কেননা ইহারা একটি ধর্মচ্যুত জামায়াত।

তিনি আরও লিখেন:-

“ইহা ঐ দিনগুলির কথা যখন ১৯৪৮ সালে পবিত্র ভূমির একটি অংশ কাটিয়া ইহুদী সরকারের কাছে ন্যস্ত করা হইয়াছিল এবং ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। আমার ধারণা উল্লিখিত দূতাবাসের এই পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে ঐ দুটি প্রবন্ধের কার্যকর জবাব ছিল, যাহা প্যালেষ্টাইন বিভক্তির সময় ঐ সালেই আহমদীয়া জামা’ত প্রকাশ করিয়াছিল। একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “হায়াতুল উমামেল মোত্তাহেদাতে ওকারে তকসিম ফিলিস্তিন।” ইহাতে পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি এবং ইহুদীদের ঐ ষড়যন্ত্র উদঘাটন করাহইয়াছিল, যাহাতে প্যালেষ্টাইনী বন্দরগুলিকে ইহুদীদের নিকট ন্যস্ত করিয়া দেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হইয়াছিল। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি "আল কুফরো মিল্লাতে ওয়াহেদ” শিরোনামে প্রকাশ করা হইয়াছিল। ইহাতে মুসলমানদিগকে পূর্ণ একতা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হইয়াছিল। ... ... এই ঘটনা সম্বন্ধে ঐ সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে অবগত ছিলাম এবং আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, যতদিন পর্যন্ত আহমদীরা মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করার জন্য চেষ্টা করিতে থাকিবে, যাহা ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলির সৃষ্ট ইসরাঈল রাষ্ট্রকে খতম করিতে সাহায্য করিবে ততদিন পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি কোন কোন ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে আহমদীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের ঘৃণা বিস্তার ও সমালোচনা করার জন্য উস্কানি দিতে চেষ্টার ত্রুটি করিবে না, যাহাতে মুসলমানদের মধ্যে একতা স্থাপিত হইতে না পারে।” (পত্রিকা “আল্ আনবাউ” (বাগদাদ), তারিখ ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ ইং)

মোটকথা, হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) এর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইল এবং ইহার এতই আশ্চর্যজনক প্রভাব সৃষ্টি হইল যে, বড় বড় ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি কাঁপিয়া উঠিল এবং দূতাবাসগুলি তাঁদের কেন্দ্র হইতে নির্দেশ পাইতে লাগিল যে, পত্রিকাগুলিকে টাকা পয়সা দাও, তাঁদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন কর এবং যেভাবেই হউক আহমদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি কর।
৫। চৌধুরী জাফর উল্লাহ খান সাহেবের অনন্য খেদমত

চৌধুরী মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ খানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনয়ন করা হয় যে, তিনি প্যালেষ্টাইনের স্বার্থের পরিপন্থি এইরূপ বক্তৃতা করিয়াছেন, যাহার দরুন প্যালেষ্টাইনের স্বার্থের সর্বনাশ হইয়াছে, ইহা একটি সীমাহীন নির্লজ্জ অভিযোগ। সমগ্র আরব জাহান এই কথা জানে না; কিন্তু পাকিস্তানের মোল্লারাই ইহা জানে। ইহা একটি অদ্ভুত অভিযোগ যে আরববাসীরা এই অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করিতেছিল এবং যাহাদের স্বার্থের জন্য চৌধুরী সাহেব দিন-রাত এক করিয়া দিয়াছিলেন এবং নিজের জীবন পাত করিতেছিলেন এবং নিজের সকল খোদা-প্রদত্ত শক্তিকে কাজে লাগাইতেছিলেন, ঐ আরববাসীরা তো এই বিষয়ে কিছুঅবগত হইল না; কিন্তু পাকিস্তানের আহরারীরা জানিতে পারিল, জামা’তে ইসলামীরা জানিতে পারিল এবং বর্তমানে পাকিস্তান সরকার জানিতে পারিল যে, প্রকৃত ব্যাপারটি কি ছিল? চৌধুরী মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ খান সাহেবের খেদমত সম্বন্ধে আরব জাহান কেবলমাত্র ঐ সময়েই জ্ঞাত ছিল না, বরং বর্তমানে আহমদীয়াতের চরম বিরোধীতার মধ্যেও তাহারা চৌধুরী সাহেবের খেদমতের কথা স্মরণ করে। আজও কোন কোন সত্যনিষ্ঠ এইরূপ ব্যক্তি রহিয়াছেন, যাঁহারা তাঁর খেদমতের কথা স্বীকার করিতে ইতস্ততঃ করেন না। বস্তুতঃ আরবদের নিজেদের ভাষাতে শুনুন। “আল-আরবী” নামক পত্রিকায় ১৯৮৩ সালের জুন সংখ্যায় আবদুল হামিদ আল্ কাতেব একটি প্রবন্ধে লিখেন :-

"মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ খানই ঐ ব্যক্তি, যিনি প্যালেষ্টাইন ইস্যুতে আরবদের স্বার্থরক্ষায় খোদার তরফ হইতে প্রেরিত হইয়াছেন। তিনি বাগ্মীতা, আইন ও রাজনীতিতে যোগ্যতার সকল কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হইয়াছেন। প্রকৃত ইসলামী রূহের সহিত তাঁর কথা স্পন্দিত হইত।”

ঐ দিনগুলিতে যখন প্যালেষ্টাইন ইস্যুটি তখনও তাজা ছিল এবং চৌধুরী জাফর উল্লাহ খান সাহেব ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ এই মহান সংগ্রামে রত ছিলেন, তখন চৌধুরী সাহেবকে ইসলাম জাহান হইতে বহিষ্কারের নিমিত্ত এবং ইসলাম জাহানকে তাঁর খেদমত হইতে বঞ্চিত করার জন্য আরবলীগে একটি বড় ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালানো হইয়াছিল। বাদশাহ ফারুক ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলির এজেন্টরূপে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া হইয়াছিল। তাঁরই ইঙ্গিতে প্যালেষ্টাইনের মুফতি চৌধুরী জাফর উল্লাহ খান সাহেব এবং আহমদীয়া জামায়াতের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের ফত্‌ওয়া দিয়াছেন। ইসলামের খেদমতকারী এই মহান বীর জেনারেলের খেদমত হইতে ইসলাম জাহানকে বঞ্চিত করাই ছিল এই ফত্‌ওয়ার লক্ষ্য। বস্তুতঃ যদিও এই ফত্‌ওয়া প্রচার করার যুগ অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল, তথাপি যেহেতু চৌধুরী সাহেবের খেদমতের স্মৃতি তখনও তাজা ছিল, সেইজন্য আরবলীগের সেক্রেটারী জেনারেল আবদুর রহমান আযম পাশা যে পত্রিকায় উল্লেখিত ফত্‌ওয়া প্রকাশ করা হইয়াছিল, উহার সম্পাদককে সম্বোধন করিয়া লিখেন:-

“আমি অবাক হইয়াছি যে, আপনি কাদিয়ানীদের সম্বন্ধে বা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ সম্বন্ধে মুফতীর রায়কে একটি চূড়ান্ত ফত্‌ওয়া হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন।”

তিনি আরও লিখেনঃ-

“যদি এই নীতি মানিয়া নেওয়া হয়, তাহা হইলে মানবজাতির ধর্মবিশ্বাস, তাহাদের মান মর্যাদা এবং তাহাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ গুটি কয়েক আলেমের ধ্যান-ধারনা, ফত্‌ওয়া এবং করুণার উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িবে।”

অতঃপর তিনি আরও লিখেন :-

“আমরা উত্তমরূপে অবগত আছি যে, জাফর উল্লাহ খান স্বীয় কথা ও কাজেই মুসলমান। পৃথিবীর সকল অংশে ইসলামের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সফলকাম হইয়াছেন। এজন্য তাহার সম্মান জনগণের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং তাহার জন্ম মুসলমানদের হৃদয় কৃতজ্ঞতার আবেগে ভরপুর হইয়া গিয়াছে।” ("বুশরা” পত্রিকার ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার ১১৫-১১৬ পৃষ্ঠা হইতে উদ্ধৃত)

পাকিস্তানের আহরারী, জামায়াতে ইসলামী এবং বর্তমান পাকিস্তান সরকারের লোকেরা কি ইসলাম জাহানে বসবাস করে না? তাহারা কি জানে না, এমন একটি সময় ছিল যখন ইসলাম জাহান এবং ইসলাম জাহানের ঐ অংশ, যেস্থান হইতে ইসলামের জ্যোতি প্রস্ফুটিত হইত, বজ্রকণ্ঠে এই ঘোষণা করিতেছিল যে, চৌধুরী জাফর উল্লাহ খান ইসলামের শিরকে সমুন্নত করার জন্য এবং মুসলিম জগতের স্বার্থরক্ষার জন্য যেসব সেবামূলক প্রচেষ্টা করিয়াছেন তদ্দরুন তাহারা কৃতজ্ঞ। এতদ্ব্যতীত “আল মিশরী” নামক আরও একটি পত্রিকা ১৯৫২ সালের ২৬শে জুন সংখ্যায় লেখে, “হে কাফের! খোদা তোমার নামের সম্মানকে সমুন্নত করুন। জাফর উল্লাহকে মুফতি কাফের ও ধর্মহীন আখ্যায়িত করিয়াছেন। আসুন আমরা সকলে মিলিয়া চৌধুরী মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ খানের প্রতি সালাম প্রেরণ করি। জাফর উল্লাহ খান কাফের সম্বন্ধে কি বলিব? তাঁহার মত আরও বড় বড় অনেক কাফেরের আমাদের প্রয়োজন রহিয়াছে।”

মিশরের “আজ্জাম” নামক আরও একটি পত্রিকার সম্পাদক ১৯৫২ সালের ২৫শে জুন সংখ্যায় লিখেন:-

“এই ফতওয়ায় আমি ভীষণ মর্মাহত হইয়াছি। কেননা চৌধুরী মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ খান সাধারণভাবে ইসলাম ও আরব জাহানের জন্য এবং বিশেষভাবে মিশরের জন্য অনেক খেদমত সম্পাদন করিয়াছেন। তাঁহার অন্যান্য খেদমতের জন্য আরব জাহান তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

আল-ইয়াত্তম পত্রিকা ১৯৫২ সালের ২৬শে জুলাই সংখ্যায় লিখেঃ

“যে ব্যক্তি বাগ্মীতা ও সত্য ভাষণের সহিত অত্যন্ত জোরালোভাবে ধনতান্ত্রিক শক্তির মোকাবেলা করেন এবং খোদাতা’লাও যাহার কণ্ঠ ও হৃদয়ে সত্য জরী করেন, তাহাকেও যদি কাফের আখ্যায়িত করা হয়, তাহা হইলে অধিকাংশ নেক ব্যক্তিই এইরূপ কাফের হওয়ার জন্য আকাঙ্খা করিবে।”

বৈরুতে “আল্‌-মাছায়া” নামক পত্রিকা লেখে:-

“সেখানে মখলূক ও জাফর উল্লাহ খানের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রহিয়াছে। প্রথমোক্ত ব্যক্তি আমল-ছাড়া মুসলমান। যদি উল্লেখিত শেক আমল করেনও, তবে তিনি তাহা করেন সম্প্রদায়িকতার লক্ষ্যে। ইহার বিপরীত জাফর উল্লাহ খান ‘উত্তম আমলবিশিষ্ট মুসলমান’। আল্লাহতা’লা কুরআন করীমে সর্বদা ঈমান ও উত্তম আমলের কথা একত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। আহা! ঈমান ও উত্তম আমল থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদেরকে কাফের আখ্যায়িত করা কতইনা বিবেক বিবর্জিত কাজ।”
৬। আহমদীয়া জামা’তের একটি বিশেষ ও স্থায়ী বৈশিষ্ট্য

যাহা হউক, ঐ একটি সময় ছিল যখন ইসলাম জাহান বিপদের সম্মুখীন হইয়াছিল এবং আহমদীয়া জামাতের এই ঐতিহ্যই রহিয়াছে যে, ইসলাম বা মুসলিম জাহানের এইরূপ বিপদের সময় আল্লাহতায়ালার ফজলে এই জামা’ত এবং ইহার খলিফাগণ এই বিশেষ সুযোগ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হইয়াছে যে, তাঁহারাই সকলের পূর্বে এবং সকলের চাইতে অধিক পরিমাণে এই সকল বিপদের প্রতি মনোযোগী হইয়াছেন এবং খলিফাগণের অনুবর্তীতায় আহমদীয়া জামা’ত সকল খেদমতের জন্য নিজদিগকে পেশ করিয়াছে। কিন্তু ইহার জন্য আহমদীয়া জামা’তকে সবদিক হইতে শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে। ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি বা ইসলাম-দুশমন শক্তিগুলি আহমদীয়া জামা’তকে তাহাদের বিবেকের স্বাধীনতার জন্য কেবল শাস্তি দেওয়ার জন্যই বদ্ধপরিকর হয় নাই, বরং ইহার জন্য সদাসর্বদা খোদ মুসলমানদিগকে ব্যবহার করিয়াছে। ইসলাম জাহানের উপর এই সকল বিপদ বাহির হইতেও আসিয়াছে এবং ভিতর হইতে আসিয়াছে। বাহির হইতে ইসলাম-দুশমন শক্তিগুলি ইসলামের জন্য এই সকল বিপদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং ভিতর হইতে তাহারা ঐ সকল এজেন্টকে ব্যবহার করিয়াছে, যাহারা সর্বদা ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলির এজেন্টরূপে কাজ করিয়া থাকে।
৭। ইসলাম জাহান একটি ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন

সুতরাং আজিও ইসলাম জাহান এইরূপ একটি ঘটনার মাধ্যমে অতিক্রম করিতেছে। আজিও ইসলাম জাহান একটি বিপদের সম্মুখীন। কিন্তু ইহা এইরূপ একটি ভয়াবহ ও যালেমানা বিপদ যে, ইসলামের ইতিহাসে এইরূপ বিপদ কখনো আসে নাই। প্রকৃতপক্ষে এই বিপদ আজ রাশিয়ার তরফ হইতেও নহে, আমেরিকার তরফ হইতেও নহে, বৌদ্ধদের তরফ হইতেও নহে, ইহুদিদের তরফ হইতেও নহে। এই বিপদ প্রাচ্যের তরফ হইতেও নহে এবং পাশ্চাত্যের তরফ হইতেও নহে। আজ ইসলামের উপর এই বিপদ এইরূপ একটি সরকারের তরফ হইতে আসিয়াছে, যাহারা মুসলমান হওয়ার দাবীদার, যাহারা ইসলামের মান মর্যাদার নামে দণ্ডায়মান হইয়াছে এবং ইসলামের মান মর্যাদার দোহাই দিয়া পাকিস্তানের মুসলমানদের উপর অধিষ্ঠিত হইয়াছে। ইতিপূর্বে ইহার চাইতে অধিক কোন বিপদ ইসলাম জাহানের উপর আপতিত হয় নাই।

কলেমা তওহিদকে নিশ্চিহ্ন করার নামে বিভিন্ন যুগে অমুসলিম চেষ্টা-তৎপরতা আমরা ইতিহাসে দেখিতে পাই। ইহা হইতে জানা যায় যে, সবচাইতে অধিক বিপজ্জনক ও ভয়ানক প্রচেষ্টা স্বয়ং আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের যুগে করা হইয়াছিল। কিন্তু মুসলমানদের তরফ হইতে এই প্রচেষ্টার ধারণাও বিদ্যমান ছিল না যে, ইসলামের প্রতি আরোপিত হইয়া এতখানি হতভাগ্যে পরিণত হইবে এবং কলেমা নিশ্চিহ্ন করার জন্য নিজেদের হাত ব্যবহার করিবে। কোন মুসলমান এই কথা কল্পনাও করিতে পারেন না। পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের শিরে আজ এই মুকুট পরানো হইয়াছে। আজ পাকিস্তানে এক নতুন ইতিহাস এবং ভয়ানক বিপজ্জনক ও রক্তাক্ত ইতিহাস লেখা হইতেছে এবং ইসলামের হেফাজত ও খেদমতের এই ধারণা দেওয়া হইতেছে যে, ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাত হানো, কলেমা তওহিদের উপর আঘাত হানো এবং রসূলের কলেমার উপর আঘাত হানো। যদি আহমদীরা কলেমা তওহিদ এবং রসূলের কলেমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হইতে বিরত না হয় এবং কলেমাকে প্রত্যাখ্যান না করে এবং কলেমার স্বীকৃতি হইতে তওবা না করে, তবে তাহাদিগকে কঠিন হইতে কঠিনতর শাস্তি প্রদান কর। আজ ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া কথিত দেশেই ইসলামের বিরুদ্ধে এই কঠোরতম আক্রমণ করা হইয়াছে। ইহা সমস্ত পরিমণ্ডলকে বিষাক্ত ও পঙ্কিল করিয়া দিয়াছে।
৮। কলেমা পড়ার অপরাধে লজ্জাস্কর শাস্তি প্রদানের দৃষ্টান্ত

এই তৎপরতা কি পদ্ধতিতে চালানো হইতেছে তাহার একটি মাত্র নমুনা আমি আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করিতেছি। এক আহমদী যুবককে কলেমা লেখার অপরাধে পাকড়াও করা হইল। তাহার কি অবস্থা হইয়াছিল এবং কিভাবে পাকিস্তানের একনায়ক সরকারের কর্মচারীরা ইসলামের সেবাকার্য সম্পাদন করিয়াছে, এই বিষয়ে উক্ত যুবক নিজ কলমে স্বীয় কাহিনী বর্ণনা করিতেছে যেঃ-

“আমাকে পাকড়াও করিয়া পুলিশটি ঘুষি মারিতে আরম্ভ করিয়া দিল। অতঃপর পুলিশের আরো একজন সিপাহী আসিয়া উপস্থিত হইল। উভয়ে মিলিয়া প্রথমে আমাকে থাপ্পড় ও ঘুষি দ্বারা খেদমত পালন করিল। অতঃপর আমাকে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে লইয়া গিয়া একটি কাঠের বাক্সের উপর শোয়াইয়া মারা হইল। এই সময় আমি কলেমা পড়িতে থাকি। অতঃপর ফাঁড়ি হইতে আমাকে টাঙ্গায় বসাইয়া বাগবানপুরা থানায় লইয়া যাওয়া হইল। রাস্তায়ও আমাকে থাপ্পড় ও ঘুষি মারা হইল এবং আমি “রাব্বানা আফরেগ আলাইনা সাবরাও ওয়াসাব্বাত আকদামানা ওয়ান সুরনা আলাল কাওমাল কাফেরীন” (অর্থাৎ হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদিগকে ধৈর্য্য দানকর এবং কাফের জাতির বিরুদ্ধে আমাদের পাগুলিকে সুদৃঢ় কর - অনুবাদক) পড়িতে থাকি। বাগবানপুরায় (জিলা গুজরানওয়ালা) পৌঁছিয়া একজন পুলিশের লোক বলিতে লাগিল, ইহাকে শোয়াইয়া দুই চার ঘা লাগাও। বস্তুতঃ আমাকে শুইয়া পড়িতে বলা হইল। আমি শুইতেছিলাম না। তখন দুই তিন ব্যক্তি সম্মুখে আসিল। একজন আমার মাথার চুল ধরিল। দ্বিতীয় ব্যক্তি আমার হাত মোচড়াই ধরিল। তৃতীয় ব্যক্তি আমার পা ধরিয়া টান মারিল। এইভাবে তাহারা আমাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল। একজন সিপাহীর হাতে হান্টার ছিল। সেই হান্টার দ্বারা আমাকে সাত আট ঘা মারিল। প্রতিটি আঘাতের সময় আমি উচ্চকণ্ঠে কলমা তৈয়্যবা পড়িতেছিলাম। তখন সেবলিত হয়েছিল, “তুমিতো কাফের।” আমাকে আঘাত হানিতে হানিতে সে বলিতে লাগিল, তোমার কলমা পড়া দেখাইয়া দিব এবং ব্যঙ্গ করিয়া আমাকে বলিল, বড় কলমা পাঠকারী! এতদসত্ত্বেও তাহাদের ইসলামের খেদমত করার আকাঙ্খা ও আকুলতা উত্তমরূপে পূর্ণ হইল না। তখন একজন পুলিশের লোকের মনে হৈল যে, ইসলামের খেদমততো আরো ভালভাবে হওয়া উচিত। বস্তুতঃ সেই হুকুম দিল, ইহার সেলোয়ার খোল। অতঃপর আমার সেলোয়ার খোলার জন্য জেহাদ শুরু হইয়া গেল। পাঁচ ছয় জন পুলিশের সমবেত প্রচেষ্টায় আমার সেলোয়ার খোলা হইল। অতঃপর আমাকে উপুড় করিয়া শোয়াইয়া পিঠের উপর আঘাত হানা হইল। কিন্তু খোদাতায়ালা আমাকে কলেমা তৈয়্যবা পড়ার তওফিক দান করেন। ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন সিপাহী দল বাঁধিয়া আসিল এবং আমাকে বলিতে লাগিল, তোমাদের মির্য্যার কথা শুনাও, তিনি কোথায় জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন এবং কোথায় মারা গিয়াছেন। তাহারা আমার মা-বাবা ও বংশের নাম ধরিয়া জঘন্য গালমন্দ করিল। তাহারা হযরত মসীহ মওউদ (আঃ) কেও অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করিল। তাহারা আধঘণ্টা ধরিয়া গালমন্দ করিতে থাকে এবং আমি ইস্তেগফার পড়িতে থাকি। দৈহিক আঘাতের ব্যাপারে আরো বলিতে হয় যে, তাহারা এই হান্টার দ্বারা আমার পা ছাড়াও মাথায় ও কাঁধে জানি না কত আঘাত করিয়াছে।”

ইহাই হইল পাকিস্তানে কলেমা তৈয়্যবার খেদমত এবং ইসলামের খেদমতের ধ্যান-ধারনা। আরবের তপ্ত মরুভূমির কথা কি আপনাদের স্মরণ হইয়া যায় না, যেখানে সৈয়্যদনা হযরত বেলাল হাবসী (রাঃ) কে একই অপরাধে তপ্ত বালুকারাশির উপর হেচড়ানো হইয়াছিল, যেখানে কয়লার চুলা হইতে জ্বলন্ত অঙ্গার বাহির করিয়া কলেমা পাঠকারীদের বুকের উপর রাখা হইত! তাহাদের পৃষ্ঠের নীচে মাটির উপরও ঐ অঙ্গার বিছাইয়া রাখা হইত এবং এই অঙ্গারের দরুন সৃষ্ট ফোসকার পানি দ্বারা অঙ্গার নিভিয়া যাইত! সুতরাং আরবভূমিতে কলেমা নিশ্চিহ্ন করার যে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটিয়াছিল, তদ্রূপ বেদনাদায়ক ঘটনাই আজ পাকিস্তানে সংঘটিত হইতেছে। কিন্তু এই ভীতিপ্রদ জুলুমটি এখন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারীদের দ্বারা সংঘটিত হইতেছে। ইহাতে আজ পৃথিবীতে শয়তানের চাইতে অধিক খুশী আর কেহ হইবেনা। কেননা আজ সে মুহাম্মদ মুস্তফা সাঃ-এর প্রতি অরোপকারী লোকদের দ্বারা ঐ দুষ্কর্ম করাইতেছে, যাহা কোন এক যুগে তাঁর (সাঃ) প্রথম সারির দুশমনেরা করিত।
৯। মুর্খতার দর্পণে তথাকথিত যুক্তিপ্রমাণ

যখন তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করাহয়, তোমরা কি করিতেছ? তোমাদের মধ্যে কি আর কোন আক্কেলজ্ঞান অবশিষ্ট নাই? তখন তাহারা বড় বড় যুক্তিপ্রমাণ দিয়া থাকে। ঐ যুক্তিপ্রমাণগুলির মধ্যে একটি হইল এই যে, তোমরা তো অপবিত্র মানুষ। কাজেই তোমরা যদি কলেমা পড় বা কলেমা বক্ষে ধারণ কর, তাহা হইলে ইহাতে কলেমার অবমাননা হইবে এবং আমরা এই অবমাননা সহ্য করিতে পারিনা। কতইনা অদ্ভুত এই যুক্তি! এই কলেমাতো অপবিত্রদিগকে পবিত্র করিতে আসিয়াছে। পাপীতাপীদিগকে পবিত্র করার জন্যইতো ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল। যদি আহমদীরা নাপাক হইয়া থাকে তবে তোমাদের খুশী হওয়া উচিত ছিল যে, এই অপবিত্রদিগকে কলেমা পবিত্র করিয়া দিয়াছে। ইহাতো মোহাম্মদ মোস্তফা সাঃ-এর কলেমা। ইহাতো এক ও অদ্বিতীয় খোদার কলেমা। ইহাতো ঐ পবিত্র ব্যক্তির কলেমা যাঁহার চাইতে অধিক কোন পবিত্র ব্যক্তি কখনো সৃষ্টি হয় নাই। এই কলেমাতো বহু শতাব্দীর অপবিত্র ও নাপাক ব্যক্তিদিগকে পবিত্র করিয়া দিয়াছিল। ইহাতো কোন মোল্লাদের কলেমা নহে, যাহা পবিত্রদিগকেও অপবিত্র করিয়া দেয়। অতএব তোমাদের কথা অনুযায়ী যদি আহমদীয়া জামা’ত অপবিত্রই হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই অপবিত্র জামা’তের জন্য একমাত্র এই কলেমারই প্রয়োজন রহিয়াছে, অর্থাৎ মোহাম্মদ মোস্তফা সাঃ এবং এক ও অদ্বিতীয় খোদার কলেমা। অন্য কাহারো বানানো কলেমার আমরা কোন পরোয়া করি না।

তাহাদের দ্বিতীয় আপত্তি এই যে, আহমদীদের হৃদয়ে এই কলেমা নাই। তাহারা মুখে মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কলেমা পড়ে এবং মনে মনে বলে ‘আহমদ রসূলুল্লাহ’, অর্থাৎ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী রসূলুল্লাহ। ইহা একটি অদ্ভুত জাহেলী কথা। ইহার চাইতেও অধিক আশ্চর্য্য জনক বিষয় এই যে, আমাদের নিকট হইতে কলেমা ছিনিয়া নেওয়ার অপবিত্র প্রচেষ্টাতো করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে তাহারা যুগপৎ খোদায়ীর দাবীকারক সাজিয়াছে এবং আঁ-হযরত (সাঃ) এর চাইতে শ্রেয়ঃ হওয়ার দাবীও করিয়াছে। আঁ-হযরত (সাঃ) এর জীবনে এইরূপ একটি ঘটনাও দেখিতে পাওয়া যায় না যে, কোন কলেমা পাঠকারী সম্বন্ধে তিনি (সাঃ) এই কথা বলিয়াছেন যে তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ মনে মনে কিছু বলিতেছ এবং মুখে অন্য কিছু বলিতেছ। বরং যাহাদের সম্বন্ধে খোদাতায়ালা সংবাদ দিয়াছিলেন, “লাম্মা ইয়াদখুলেল ঈমানু ফি কুলুবেকুম” অর্থাৎ ঈমান ইহাদের হৃদয়কে স্পর্শই করে নাই, ঈমান ইহাদের হৃদয়ে প্রবেশই করে নাই, ইহাদের একজন সম্বন্ধেও আঁ-হযরত (সাঃ) এই কথা বলেন নাই যে, তোমার মুখের কলেমা একটি এবং হৃদয়ের কলেমা অন্য কিছু। কিন্তু ইহার বিপরীত তাঁহার (সাঃ) জীবনে এইরূপ অসংখ্য ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায়, যাহা স্মরণ করিলে মানুষ অবাক হইয়া যায় যে ঐ নবী (সাঃ) কত মহান, কত শান এবং কত প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তাঁহার উপর শান্তি বর্ষিত হউক।
১০। কিয়ামতের দিন তুমি কি জবাব দিবে?

ইসলামের ইতিহাসে এইরূপ একটি ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায় যে, অসামা বিন জায়েদ (রাঃ) একটি সংঘর্ষে এইরূপ এক ব্যক্তিকে হত্যা করিল, যে মুসলমানদের উপর বারবার আক্রমণ করিত। যখন অসামা বিন জায়েদ (রাঃ) তাহাকে মারিতে আরম্ভ করিলেন তখন সে কলেমা পড়িল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি তাহাকে হত্যা করিলেন। তিনি স্বয়ং বলেন (মুসলিম কিতাবুল ঈমান-এর হাদিস), যখন আঁ-হযরত (সাঃ) এর নিকট আমি এই ঘটনা বর্ণনা করিলাম তখন তিনি (সাঃ) বললেন, সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলার পরও তুমি তাহাকে হত্যা করিয়াছ? অসামা বিন জায়েদ (রাঃ) বললেন, আমি নিবেদন করিলাম যে সে তো অস্ত্রের ভয়ে এইরূপ করিয়াছিল। তিনি (সাঃ) বললেন, তুমি কি তাহার হৃদয় চিরিয়া দেখিয়াছিলে সে কি বলিয়াছিল এবং কি বলে নাই? আঁ-হযরত (সাঃ) এই বাক্যটি বিরতিহীনভাবে বলিতে থাকেন, “তুমি কি তাহার হৃদয় চিরিয়া দেখিয়াছিলে, তুমি কি তাহার হৃদয় চিরিয়া দেখিয়াছিলে?” অন্য একটি বর্ণনায় বাক্যটি এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, “কেন তুমি কি তাহার হৃদয় চিরিয়া দেখ নাই যে, প্রকৃত পক্ষেই তাহার হৃদয়ে কলেমা ছিল কিনা?”

সূতরাং স্বয়ং মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এই দাবী করেন নাই যে, প্রকৃত পক্ষেই হৃদয়ে কলেমা আছে কিনা তাহা হৃদয় চিরিয়া জানিতে পারা যায় এবং তিনি নিজ গোলামদিগকে ইহার অনুমতি দান করেন নাই। কিন্তু ইহার বিপরীত আজিকার মোল্লারা এই দাবী করিয়া বসিয়াছে যে, তাহারা “আলেমুল গায়েব ওয়াশ শাহাদাত” (অর্থাৎ তাহারা দৃশ্য ও অদৃশ্য সম্বন্ধে জ্ঞাত - অনুবাদক) এবং তাহারা খোদাতায়ালার নবী (সাঃ) এবং তাঁহার সাহাবাগণের চাইতেও উচ্চতর মর্য্যাদা রাখে এবং মানুষের হৃদয়ের অবস্থা জ্ঞাত হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে কোন মুসলমানের আত্মমর্য্যদাবোধে আঘাত লাগিতেছে না যে ইহা কি ধরনের তৎপরতা চলিতেছে।

এই হাদিসটির আরও একটি বর্ণনা রহিয়াছে। ইহার কথাগুলি কিছুটা ভিন্নতর। ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে যে, যখন হযরত আসামা বিন জায়েদ (রাঃ) নিবেদন করিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, সে তলোয়ারের ভয়ে কলেমা পড়িয়াছিল। তখন তিনি (সাঃ) বললেন, সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়া সত্ত্বেও তুমি তাহাকে হত্যা করিলে? অতঃপর তিনি আরও বললেন, কিয়ামতের দিন যখন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” সাক্ষ্য দিতে আসিবে, তখন তুমি কি জবাব দিবে? হযরত আসামা বিন জায়েদ (রাঃ) বললেন, আমি নিবেদন করিলাম, হে আল্লাহর রসূল, আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তখনও তিনি (সাঃ) এই কথাই বলিলেন, কিয়ামতের দিন যখন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” আসিয়া সাক্ষ্য দিবে তখন তুমি কি জবাব দিবে? হযরত আসামা (রাঃ) বলেন, তিনি (সাঃ) ইহা ছাড়া আর কিছুই বলিলেন না যে, কিয়ামতের দিন যখন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” আসিয়া সাক্ষ্য দিবে তখন তুমি কি করিবে?
১১। ইসলামী জাহানের জন্য মুহূর্তের চিন্তা

অতএব, এই অবস্থাটিই বর্তমানে পাকিস্তানে দৃষ্টিগোচর হইতেছে। ইতিপূর্বেই আমি উল্লেখ করিয়াছি যে ইসলামের নামে ক্ষমাহীন একটি স্বৈরাচারী সরকার ইসলামের ভিত্তিমূলে নেহায়েত ভীতিপ্রদ আক্রমণ করিতেছে এবং ইসলামী জাহান আলস্যে শুইয়া রহিয়াছে। আমি যে দুটি পত্রিকার কথা উল্লেখ করিয়াছি, এইগুলি ঐ সময় লিখিয়াছিল যখন প্যালেষ্টাইন বিপদের সম্মুখীন ছিল এবং প্যালেষ্টাইনের দরুন মক্কা-মদীনাও বিপদের সম্মুখীন হইয়াছিল। ঐ সময় হযরত খলিফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) ইসলাম জাহানকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সজাগ করিতে গিয়া বলেন:-

“ইহা প্যালেষ্টাইনের প্রশ্ন নহে। মদীনার প্রশ্ন নহে। জেরুজালেমের প্রশ্ন নহে। প্রশ্ন এখন খোদ মক্কা মুকার্‌রমার। জায়েদ ও বকরের প্রশ্ন নহে। প্রশ্ন মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইজ্জতের। নিজেদের মধ্যে বিরুদ্ধাচারণ থাকা সত্ত্বেও শত্রুরা ইসলামের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। মুসলমানদের মধ্যে হাজার হাজার ঐক্য থাকাসত্ত্বেও তাহারা কি এই উপলক্ষে একত্রিত হইবে না?” (আল-কুফ্‌রো মিল্লাতুন ওয়াহেদাতুন – আলফজল, ২১শে মে ১৯৪৮)

কিন্তু আজ যখন কলেমার উপর এই নাপাক হামলা করা হইয়াছে তখন আমি ইসলামী জাহানকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছি, আজ প্যালেষ্টাইনের প্রশ্ন নহে, জেরুজালেমের প্রশ্ন নহে, মক্কা মুকাররমার প্রশ্ন নহে। আজ ঐ এক ও অদ্বিতীয় খোদার ইজ্জত ও প্রতাপের প্রশ্ন, যাঁহার নামের দরুন এই মাটির শহরগুলি মর্যাদা লাভ করিয়াছিল, যাঁহার মহান নামের দরুন ইট-পাথর নির্মিত গৃহগুলির বাসিন্দারা পবিত্রতা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিল। আজ তাঁহার একত্বের উপর হামলা করা হইতেছে। আজ মক্কা-মদীনার প্রশ্ন নহে। আজ আমাদের প্রভু ও মওলা মক্কা-মদীনার বাদশাহর (সঃ) মান-মর্যাদার প্রশ্ন। আজ প্রশ্ন এই যে, মুসলমানদের হৃদয়ে কি কোন আত্ম-মর্য্যাদাবোধ আর অবশিষ্ট নাই? কলেমা নিশ্চিহ্ন করার জন্য মুসলমানদের হাত উঠিতেছে – ইহা দেখিয়াও কি তাহাদের হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয় না? তাহাদের হৃদয়ে কি আঘাত লাগে না?

জুলুমের উপর জুলুম হইল এই যে, এই কাজের জন্য যখন কোন মুসলমানকে পাওয়া যায় না, তখন পাকিস্তানের এই স্বৈরাচারী শাসনে ইসলামের দুশমন খৃস্টানদিগকে এই কাজের জন্য ব্যবহার করা হইয়া থাকে। যখন কোন সভ্য নাগরিক পাওয়া যায় না তখন হাজত বা জেলখানা হইতে আসামী ধরিয়া আনা হয় এবং তাহাদের মাধ্যমে পবিত্র কলেমা তৈয়্যেবা নিশ্চিহ্ন করা হয়, যে কলেমার মধ্যে এই স্বীকৃতি থাকে যে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাসক নাই এবং মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) তাঁহার দাস ও রসূল।

সুতরাং প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের গর্ভ হইতে আজ যে অপবিত্র আন্দোলনের জন্ম হইয়াছে তাহার জন্য সে এই পৃথিবীতেও দায়ী থাকিবে এবং কেয়ামতের দিনও দায়ী থাকিবে। অতঃপর পৃথিবীর কোন শক্তি তাহাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। কেননা আজ সে খোদার ইজ্জত ও প্রতাপের উপর আক্রমণ করিয়াছে। আজ সে মোহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর পবিত্র নামের উপর আক্রমণ করিয়াছে।

আহমদীরা প্রস্তুত রহিয়াছে। তাহারা কলেমার হেফাজতের জন্য নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত রহিয়াছে এবং তাহারা এক ইঞ্চিও পিছনে হটিবেনা। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, হে ইসলামী জাহান! তোমরা কেন এই সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত রহিয়াছ? তোমাদের মধ্যে কি ইসলামের জন্য কোন সহানুভূতি, কোন আত্ম-মর্য্যাদাবোধ এবং কলেমা তওহিদের প্রতি ভালবাসার লেশমাত্রও অবশিষ্ট নাই? অতএব আমি তোমাদিগকে আল্লাহতায়ালার একত্বের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি। এই একত্ব সম্বন্ধে সমগ্র ইসলামী জাহান ঐক্যমত পোষণ করে। ইসলামী জাহানের তো একই প্রাণ। ইহাতে কোন মতানৈক্য ও সংশয় নাই। শিয়ারাও কলেমা তওহিদের সহিত ঐ একইভাবে সম্পর্কযুক্ত যেভাবে সুন্নীরা সম্পর্কযুক্ত এবং আহমদীরাও ঐ একইভাবে সম্পর্কযুক্ত যেভাবে ওহাবী ও অন্যান্য ফেরকার লোকেরা সম্পর্কযুক্ত। কলেমা ইসলামের আত্মা। কিন্তু আজ ইসলামের এই আত্মার উপর আক্রমণ করা হইতেছে। অতএব আমি তোমাদিগকে হেরা গুহার নামে আহ্বান জানাইতেছি। এই গুহা হইতে একবার সত্যের আওয়াজ এইরূপ শানের সহিত উত্থিত হইয়াছিল যে, ইহা সমগ্র বিশ্বকে কাঁপাইয়া তুলিয়াছিল। আমি তোমাদিগকে সৈয়্যদনা বেলাল হাবসী (রাঃ)-এর নামে আহ্বান জানাইতেছি, আইস, তোমরাও এই গোলামের নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ কর। তিনি কলেমার হেফাজতের জন্য সকল আরাম বিসর্জন করিয়া ছিলেন এবং এইরূপ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করিয়াছিলেন যে আজ ইহা মনে করিলেও মানুষের লোম শিহরিয়া উঠে।

অতএব হে মুসলমানেরা! যদি তোমরা আস এবং এই নেক কাজে আহমদীদের সহিত শামেল হও, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে শুভ সংবাদ দিতেছি যে তোমরা চিরকাল জীবিত থাকিবে এবং পৃথিবীর কোন শক্তি তোমাদিগকে ধ্বংস করিতে পারিবেনা। তোমরা পৃথিবীতেও পুরস্কৃত হইবে এবং আকাশেও পুরস্কৃত হইবে এবং খোদাতায়ালার রহমত ও বরকত তোমাদের গৃহসমূহে সর্বদা বর্ষিত হইতে থাকিবে। কিন্তু যদি তোমরা এই আওয়াজে ‘লাব্বায়েক’ না বল তাহা হইলে এই পৃথিবীতে তোমাদের চাইতে অধিক অপরাধী আর কেহ হইবে না। কেননা মোহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর প্রতি নিজদিগকে রুজু করা সত্ত্বেও যখন তাঁহার (সাঃ) পবিত্র নামের উপর হামলা করা হইয়াছে এবং খোদাতায়ালার একত্বের স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও যখন তাঁহার একত্বের উপর হামলা করা হইয়াছে তখন তোমরা আরামের সহিত বসিয়া রহিয়াছ এবং নিজেদের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এই বিষয়ের একবিন্দু পরোয়াও কর নাই। অতঃপর এই আকাশ ও পৃথিবী তোমাদের উপর রহমত প্রেরণ করিবে না এবং তোমাদের নাম কখনো সম্মানের সহিত স্মরণ করা হইবেনা।

সমাপ্ত

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।