তিনি খোদা হবার দাবী করেছেন (নাউযুবিল্লাহ্)
অপবাদ আরোপকারীগণ বিভিন্ন লিফলেট ও পুস্তক-পুস্তিকায় হযরত মির্যা সাহেবের উপর এই অপবাদ দিয়েছেন যে, (নাউযুবিল্লাহ্) তিনি খোদা হবার দাবীদার। যে উদ্ধৃতিটি নকল করে প্রায় সবক’টি পুস্তক-পুস্তিকায় এই অপবাদটি দেয়া হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো: ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি আল্লাহ্ হয়ে গেছি। আমি বিশ্বাস করলাম যে, প্রকৃতই আমি আল্লাহ্, তারপর আমি আসমান যমীন সৃষ্টি করলাম। (আয়নায়ে কামালতে ইসলাম, ৫৬৪ পৃঃ)
উত্তরঃ এই অপবাদের উত্তরে হযরত মির্যা সাহেবের লেখা মূল অংশটি তুলে ধরছি।
ورايتنى فى المنام عين الله وتيقنت انني هولم يبق لي ارادة ولا خطرة ولا عمل من جهة نفسى وصرت كاناء منثلم بل كشیی تابطه شيئ اخر واخفاه نفسي حتى ما بقى منه اثرولا رائحة وصارك المفقودين واعنى بعين الله رجوع الظل الى اصله وغيبوبة فيه كما يجرى مثل هذه الحالات في بعض الاوقات على المحبين
অর্থাৎ: আমি স্বপ্নে নিজেকে আল্লাহ্ রূপে দেখছি এবং বিশ্বাস করছি যে, আমি তিনি এবং আমার নিজস্ব কোন ইচ্ছা কামনা ও চিন্তা-ভাবনাও নেই এবং স্বকীয় কর্মশক্তিও নেই। আমি একটি ভরপুর পাত্রের ন্যায় হয়ে গেছি বরং এমন একটি বস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছি যাকে অন্য কোন বস্তু বগলদাবা করে নেয় এবং নিজ সত্তার মধ্যে এমনভাবে গোপন করে ফেলে যে, উহার কোন কিছু প্রভাব, চিহ্ন বা নাম-গন্ধও অবশিষ্ট থাকে না এবং উহা বিলুপ্ত বস্তুর ন্যায় হয়ে যায়। স্বয়ং আল্লাহ্ বলতে আমি বুঝি যে, আসল বস্তুর দিকে উহার ছায়ার প্রত্যাগমন এবং উহার মধ্যে আত্মবিলীন হয়ে যাওয়া, যেমনভাবে আল্লাহ্ প্রেমিকদের অনেক সময় এ সকল অবস্থা ঘটে এসেছে, (রূহানী খাযায়েন ৫ম খন্ড, আয়নায়ে কামালতে ইসলাম, ৫৬৪-৫৬৫পৃঃ)।
(খ) হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছেঃ
اذا قال يوسف لابيه يابت اني رايت احد عشر كوكبا والشمس والقمر رايتهم لي سـجـديـن
অর্থাৎ যখন ইউসুফ (আঃ) তার পিতাকে বলেছিলো, হে আমার পিতা, নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রকে, আমি এদেরকে দেখেছি আমাকে সেজদা করছে।
সুধীবৃন্দ! দেখুন এ স্বপ্নটির তা’বীর কুরআন নিজেই বর্ণনা করেছে। কিন্তু তা’বীর না করে যদি বাহ্যিক অর্থ নেয়া হয় তাহলে স্বপ্নটির অর্থ কী হবে?
(গ) ইহাও একটি স্বপ্ন মাত্র। স্বপ্নকে তা’বীর না করে হুবহু বাস্তবে নেওয়া যুলুম ছাড়া অন্য আর কিন্তু নয়। স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা করা দরকার, যদি হুবহু অর্থ করা হয় তাহলে বুখারী শরীফের এই হাদীসটির অর্থ কী হবে?
ان رسول الله صلعم بينا نائم رأيت في يدي سوارين من ذهب
(بخارى كتاب الرؤيا باب النفخ في المنام جلد ٤ ص ١٣٤)
অর্থাৎ: হযরত রসূল করীম (সাঃ) বলেন, “আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি দুই হাতে সোনার দু’টি বালা পরে আছি” বাস্তবে মুসলমান পুরুষের জন্য তো কোন সোনার জিনিস পরা হারাম। বুঝা গেল স্বপ্নের তা’বীর অবশ্যই করতে হবে।
(ঘ) হযরত মির্যা সাহেব উপরোক্ত স্বপ্নটি বর্ণনা করার পর নিজেই স্বপ্নের তা’বীর বর্ণনা করেছেন। বিরোধীদের পুস্তক-পুস্তিকায় শুধু আপত্তি করার জন্যে এবং জনসাধারণের মাঝে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে স্বপ্নের একটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে, বাকি অংশটুকু দেয়া হয় নি। এমন কি ইহাকে স্বপ্ন বলে উল্লেখও করা হয় নি। যাহোক হযরত মির্যা সাহেব এ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় আরও লিখেন:
وما نعنى بهذه الواقعة كما يعنى فى كتب اصحاب وحدة الوجود وما نحنى بذالك ماهو مذهب الحلوليين بل هذا الواقعة توافق حديث النبي صلعم اعنى بذالك الحديث البخاري في بيان مرتبة قرب النوافل العباد الله
অর্থাৎ: “আমি এই স্বপ্ন দ্বারা “ওয়াহাদাতুল ওয়াজুদ ফিরকার ন্যায় এই অর্থ করি না যে, আমিই খোদা। আমি হুলুলীদের ন্যায় (মুসলমানদের এক ফিরকা যারা বলে মানবদেহে কোন আত্মা অবতরণপূর্বক অন্তর্নিহিত হয়ে যায়) ইহাও বলি না যে, খোদাতাআলা আমার মধ্যে অবতরণপূর্বক অন্তর্নিহিত হয়ে গিয়েছেন। বস্তুতঃ আমার উপরোক্ত স্বপ্নের অর্থ বুখারী শরীফে বর্ণিত নফল নামাযের বরকত সম্বন্ধে বর্ণিত হাদীসটির ন্যায়।” এই হাদীসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বেশী বেশী নফল নামায পড়বে আল্লাহ্ তার জন্য বলেন যে, আমি তার হাত হয়ে যাই, তার পা হয়ে যাই, তার চোখ হয়ে যাই, তার কান হয়ে যাই-যদ্বারা সে ধরে, যদ্বারা সে চলে, যদ্বারা সে দেখে, এবং যদ্বারা সে শুনে (বুখারী কিতাবুর রিকাক, বাবুত্ তাওয়াযো, ৪র্থ খন্ড, ৮০ পৃঃ)। হযরত মির্যা সাহেব নিজের স্বপ্নের তা’বীর নিজেই বলে দিয়েছেন। তা’বীরটি স্পষ্ট তাতে আপত্তির কিছুই নেই।
(ঙ) সৈয়দ আব্দুল গনী নাবলুসি (রহঃ) প্রণীত “তা’তীরূল আনাম ফি তা’বীরিল মানাম” যা মুসলমানদের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে স্বপ্নের তা’বীরের একটি অমূল্য পুস্তক। ইহাতে লিখা আছেঃ
من رأى فى المنام كانه صار الحق سبحانه تعالى اهتدى الى الصراط المتقيم
অর্থাৎ: যে ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে সে খোদা হয়ে গিয়েছে, তার তা’বীর হলো যে, খোদাতাআলা তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন (তা’তীরুল আনাম পৃঃ ৯)। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বপ্নে খোদা হয়ে যাওয়া কোন দোষের বিষয় নয়।
(চ) হযরত মির্যা সাহেবই যে শুধু এইরূপ স্বপ্ন দেখেছেন ও বর্ণনা করেছেন তা নয়। উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বহু বুযর্গ, পীর, মাশায়েখ এইরূপ হবার বরং এর চাইতেও অধিকতর কিছু হবার দাবী করেছেন। যেমন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সূফী, দরবেশ ও পীর হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তার (রহঃ) লিখেছেনঃ
من خدايم من خدايم من خدا فارغ از کینه وازكبر وهوا (فوائد فریديه مترجم باراول ص ٨٥)
অর্থাৎঃ বিদ্বেষ অহংকার ও লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আমি খোদা হয়ে গিয়েছি, আমি খোদা হয়ে গিয়েছি, আমি খোদা হয়ে গিয়েছি (ফোওয়ায়েদে ফরীদীয়া প্রথম বারের অনুবাদ, ৮৫ পৃঃ)।
হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশৃতি (রহঃ) বলেন:
نه عصیاں ماند نے طاعت شدم محوان ساعت چنان گشتم در آن حالت که وی من گشت و منم وی
(ديوان معين الدين)
অর্থাৎ: যখন আমি তাঁর (আল্লাহ্) মধ্যে বিলীন হয়ে গেলাম তখন না আনুগত্য বাকী থাকল, না অবাধ্যতা। সেই মুহূর্তে আমি তাঁর মধ্যে এইরূপে বিলীন হয়ে গেলাম যে, আমি তিনি (আল্লাহ্) হয়ে গেলাম, এবং তিনি (আল্লাহ্) আমি হয়ে গেলেন। (দেওয়ানে মঈনউদ্দিন)।
আমাদের নিবেদন, বুযর্গানে দীনের উপরোক্ত উদ্ধৃতি যে অর্থে নেয়া হয় হযরত মির্যা সাহেবের বেলাতেও কি সেই অর্থ নেয়া বাঞ্ছনীয় নয়? এছাড়াও তিনি স্বয়ং তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং, সুধীজনের নিকট আবেদন- আপত্তির যথার্থতা উপলব্ধি করতঃ খোদায়ী দাবী সম্বন্ধে অন্যান্য উদ্ধৃতিগুলিও যাচাই করে নিন।
(ছ) হযরত মির্যা সাহেবের খোদায়ী দাবী সম্বন্ধে যে উদ্ধৃতি অত্যন্ত জোরালোভাবে বিরোধীদের প্রায় পুস্তিকাগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা কাটছাট করে বিকৃতাবস্থায় পেশ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন, ইনসাফের দৃষ্টিতে একাজটি কতটুকু শোভনীয় হয়েছে, বিশেষ করে আলেম শ্রেণীর পক্ষে, যারা মানব জাতিকে সত্য ন্যায়-নীতি অবলম্বন করার আদেশ দিয়ে থাকেন? তারাই যদি নিজেরা এমন জাজ্বল্যমান মিথ্যাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অবলম্বন করেন, তাহলে মানুষ সত্য ও সৎপথ খুঁজে পাবে কোথায়? মিথ্যার সাথে সত্যের মিশ্রণ ঘটলেও, তা মিথ্যাই হয়। ‘আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলাম’ বাক্যটা একটা দীর্ঘ স্বপ্নের একটি অংশ। এই অংশের ব্যাখ্যাও হযরত মির্যা সাহেব স্বয়ং উপরোক্ত পুস্তকের ৫৬৬ পৃষ্ঠায় এভাবে দিয়েছেন:
ان هذا الخلق الذي رايته اشارة الى تايئدات سماوية ارضية
অর্থাৎঃ আমি স্বপ্নে যে আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করতে দেখেছি, তাতে এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, ঐশী ও জাগতিক সাহায্য আমার সাথে থাকবে। সুতরাং মূল উদ্ধৃতি উহার প্রসঙ্গ এবং প্রেক্ষাপট হতে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, আলোচ্য বিষয়-বস্তু আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের সাথে সম্পর্কিত। এখানে খোদা হওয়ার দাবী নেই। বস্তুতঃ আপত্তিকারীদের উদ্ধৃতিগুলি যেমন ত্রুটিপূর্ণ তেমনি নিরর্থক এবং উদ্দেশ্যমূলক। মহান আল্লাহতাআলা সম্বন্ধে হযরত মির্যা সাহেব তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে যে বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, তার একটি নমুনা সূধীগণের সামনে তুলে ধরলামঃ
“হে শ্রোতাগণ! শ্রবণ কর, খোদা তোমাদের নিকট হতে কি চান? শুধু ইহাই যে, তোমরা তাঁর হয়ে যাও। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক কোর না, আকাশেও না, ভূ-পৃষ্ঠেও না, তোমাদের খোদা সেই খোদা যিনি এখনও জীবিত যেমন তিনি পূর্বে জীবিত ছিলেন। তিনি এখনও তেমনি কথা বলেন, যেমন তিনি পূর্বেও কথা বলতেন। তিনি এখনও তেমনি শুনেন, যেমন তিনি পূর্বে শুনতেন।
তিনি সেই এক-অদ্বিতীয় এবং শরীক বিহীন খোদা যার দ্বিতীয় আর কেউ নেই। কেউ তাঁহার ন্যায় কোন বিশেষ গুণে গুণান্বিত নয়। তাঁর তুল্য কেউ নেই। তাঁর সমগুণশালী কেহ নেই। তাঁর কোন শক্তি নূন্যতমও ক্ষুণ্ণ হয় না৷
তিনি আরশে আছেন। কিন্তু ইহা বলা যায় না যে, তিনি পৃথিবীতে নেই। তিনি পূর্ণ গুণধর। তিনি সত্যিকার সকল প্রশংসার অধিকারী। তিনি সকল সৌন্দর্যের উৎস। তিনি সর্বশক্তিমান। সকল কল্যাণ তাঁর নিকট হতে উৎসারিত এবং সকল বস্তু তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তন করে। তিনি সকল রাজ্যের মালিক, তিনি সর্ব গুণাকর এবং সর্বক্রটি ও দুর্বলতার উর্ধ্বে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীস্থ সকলেরই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য”। (রূহানী খায়ায়েন, ২০ খন্ড, আল্ ওসীয়্যত, ৩০৯-৩১০ পৃষ্ঠা)
এর পরেও কি কেউ বলতে পারেন যে, মির্যা সাহেব খোদা হওয়ার দাবী করেছেন?
(পুস্তকঃ অযথা বিভ্রান্তি)
উত্তরঃ এই অপবাদের উত্তরে হযরত মির্যা সাহেবের লেখা মূল অংশটি তুলে ধরছি।
ورايتنى فى المنام عين الله وتيقنت انني هولم يبق لي ارادة ولا خطرة ولا عمل من جهة نفسى وصرت كاناء منثلم بل كشیی تابطه شيئ اخر واخفاه نفسي حتى ما بقى منه اثرولا رائحة وصارك المفقودين واعنى بعين الله رجوع الظل الى اصله وغيبوبة فيه كما يجرى مثل هذه الحالات في بعض الاوقات على المحبين
অর্থাৎ: আমি স্বপ্নে নিজেকে আল্লাহ্ রূপে দেখছি এবং বিশ্বাস করছি যে, আমি তিনি এবং আমার নিজস্ব কোন ইচ্ছা কামনা ও চিন্তা-ভাবনাও নেই এবং স্বকীয় কর্মশক্তিও নেই। আমি একটি ভরপুর পাত্রের ন্যায় হয়ে গেছি বরং এমন একটি বস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছি যাকে অন্য কোন বস্তু বগলদাবা করে নেয় এবং নিজ সত্তার মধ্যে এমনভাবে গোপন করে ফেলে যে, উহার কোন কিছু প্রভাব, চিহ্ন বা নাম-গন্ধও অবশিষ্ট থাকে না এবং উহা বিলুপ্ত বস্তুর ন্যায় হয়ে যায়। স্বয়ং আল্লাহ্ বলতে আমি বুঝি যে, আসল বস্তুর দিকে উহার ছায়ার প্রত্যাগমন এবং উহার মধ্যে আত্মবিলীন হয়ে যাওয়া, যেমনভাবে আল্লাহ্ প্রেমিকদের অনেক সময় এ সকল অবস্থা ঘটে এসেছে, (রূহানী খাযায়েন ৫ম খন্ড, আয়নায়ে কামালতে ইসলাম, ৫৬৪-৫৬৫পৃঃ)।
(খ) হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছেঃ
اذا قال يوسف لابيه يابت اني رايت احد عشر كوكبا والشمس والقمر رايتهم لي سـجـديـن
অর্থাৎ যখন ইউসুফ (আঃ) তার পিতাকে বলেছিলো, হে আমার পিতা, নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রকে, আমি এদেরকে দেখেছি আমাকে সেজদা করছে।
সুধীবৃন্দ! দেখুন এ স্বপ্নটির তা’বীর কুরআন নিজেই বর্ণনা করেছে। কিন্তু তা’বীর না করে যদি বাহ্যিক অর্থ নেয়া হয় তাহলে স্বপ্নটির অর্থ কী হবে?
(গ) ইহাও একটি স্বপ্ন মাত্র। স্বপ্নকে তা’বীর না করে হুবহু বাস্তবে নেওয়া যুলুম ছাড়া অন্য আর কিন্তু নয়। স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা করা দরকার, যদি হুবহু অর্থ করা হয় তাহলে বুখারী শরীফের এই হাদীসটির অর্থ কী হবে?
ان رسول الله صلعم بينا نائم رأيت في يدي سوارين من ذهب
(بخارى كتاب الرؤيا باب النفخ في المنام جلد ٤ ص ١٣٤)
অর্থাৎ: হযরত রসূল করীম (সাঃ) বলেন, “আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি দুই হাতে সোনার দু’টি বালা পরে আছি” বাস্তবে মুসলমান পুরুষের জন্য তো কোন সোনার জিনিস পরা হারাম। বুঝা গেল স্বপ্নের তা’বীর অবশ্যই করতে হবে।
(ঘ) হযরত মির্যা সাহেব উপরোক্ত স্বপ্নটি বর্ণনা করার পর নিজেই স্বপ্নের তা’বীর বর্ণনা করেছেন। বিরোধীদের পুস্তক-পুস্তিকায় শুধু আপত্তি করার জন্যে এবং জনসাধারণের মাঝে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে স্বপ্নের একটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে, বাকি অংশটুকু দেয়া হয় নি। এমন কি ইহাকে স্বপ্ন বলে উল্লেখও করা হয় নি। যাহোক হযরত মির্যা সাহেব এ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় আরও লিখেন:
وما نعنى بهذه الواقعة كما يعنى فى كتب اصحاب وحدة الوجود وما نحنى بذالك ماهو مذهب الحلوليين بل هذا الواقعة توافق حديث النبي صلعم اعنى بذالك الحديث البخاري في بيان مرتبة قرب النوافل العباد الله
অর্থাৎ: “আমি এই স্বপ্ন দ্বারা “ওয়াহাদাতুল ওয়াজুদ ফিরকার ন্যায় এই অর্থ করি না যে, আমিই খোদা। আমি হুলুলীদের ন্যায় (মুসলমানদের এক ফিরকা যারা বলে মানবদেহে কোন আত্মা অবতরণপূর্বক অন্তর্নিহিত হয়ে যায়) ইহাও বলি না যে, খোদাতাআলা আমার মধ্যে অবতরণপূর্বক অন্তর্নিহিত হয়ে গিয়েছেন। বস্তুতঃ আমার উপরোক্ত স্বপ্নের অর্থ বুখারী শরীফে বর্ণিত নফল নামাযের বরকত সম্বন্ধে বর্ণিত হাদীসটির ন্যায়।” এই হাদীসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বেশী বেশী নফল নামায পড়বে আল্লাহ্ তার জন্য বলেন যে, আমি তার হাত হয়ে যাই, তার পা হয়ে যাই, তার চোখ হয়ে যাই, তার কান হয়ে যাই-যদ্বারা সে ধরে, যদ্বারা সে চলে, যদ্বারা সে দেখে, এবং যদ্বারা সে শুনে (বুখারী কিতাবুর রিকাক, বাবুত্ তাওয়াযো, ৪র্থ খন্ড, ৮০ পৃঃ)। হযরত মির্যা সাহেব নিজের স্বপ্নের তা’বীর নিজেই বলে দিয়েছেন। তা’বীরটি স্পষ্ট তাতে আপত্তির কিছুই নেই।
(ঙ) সৈয়দ আব্দুল গনী নাবলুসি (রহঃ) প্রণীত “তা’তীরূল আনাম ফি তা’বীরিল মানাম” যা মুসলমানদের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে স্বপ্নের তা’বীরের একটি অমূল্য পুস্তক। ইহাতে লিখা আছেঃ
من رأى فى المنام كانه صار الحق سبحانه تعالى اهتدى الى الصراط المتقيم
অর্থাৎ: যে ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে সে খোদা হয়ে গিয়েছে, তার তা’বীর হলো যে, খোদাতাআলা তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন (তা’তীরুল আনাম পৃঃ ৯)। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বপ্নে খোদা হয়ে যাওয়া কোন দোষের বিষয় নয়।
(চ) হযরত মির্যা সাহেবই যে শুধু এইরূপ স্বপ্ন দেখেছেন ও বর্ণনা করেছেন তা নয়। উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বহু বুযর্গ, পীর, মাশায়েখ এইরূপ হবার বরং এর চাইতেও অধিকতর কিছু হবার দাবী করেছেন। যেমন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সূফী, দরবেশ ও পীর হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তার (রহঃ) লিখেছেনঃ
من خدايم من خدايم من خدا فارغ از کینه وازكبر وهوا (فوائد فریديه مترجم باراول ص ٨٥)
অর্থাৎঃ বিদ্বেষ অহংকার ও লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আমি খোদা হয়ে গিয়েছি, আমি খোদা হয়ে গিয়েছি, আমি খোদা হয়ে গিয়েছি (ফোওয়ায়েদে ফরীদীয়া প্রথম বারের অনুবাদ, ৮৫ পৃঃ)।
হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশৃতি (রহঃ) বলেন:
نه عصیاں ماند نے طاعت شدم محوان ساعت چنان گشتم در آن حالت که وی من گشت و منم وی
(ديوان معين الدين)
অর্থাৎ: যখন আমি তাঁর (আল্লাহ্) মধ্যে বিলীন হয়ে গেলাম তখন না আনুগত্য বাকী থাকল, না অবাধ্যতা। সেই মুহূর্তে আমি তাঁর মধ্যে এইরূপে বিলীন হয়ে গেলাম যে, আমি তিনি (আল্লাহ্) হয়ে গেলাম, এবং তিনি (আল্লাহ্) আমি হয়ে গেলেন। (দেওয়ানে মঈনউদ্দিন)।
আমাদের নিবেদন, বুযর্গানে দীনের উপরোক্ত উদ্ধৃতি যে অর্থে নেয়া হয় হযরত মির্যা সাহেবের বেলাতেও কি সেই অর্থ নেয়া বাঞ্ছনীয় নয়? এছাড়াও তিনি স্বয়ং তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং, সুধীজনের নিকট আবেদন- আপত্তির যথার্থতা উপলব্ধি করতঃ খোদায়ী দাবী সম্বন্ধে অন্যান্য উদ্ধৃতিগুলিও যাচাই করে নিন।
(ছ) হযরত মির্যা সাহেবের খোদায়ী দাবী সম্বন্ধে যে উদ্ধৃতি অত্যন্ত জোরালোভাবে বিরোধীদের প্রায় পুস্তিকাগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা কাটছাট করে বিকৃতাবস্থায় পেশ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন, ইনসাফের দৃষ্টিতে একাজটি কতটুকু শোভনীয় হয়েছে, বিশেষ করে আলেম শ্রেণীর পক্ষে, যারা মানব জাতিকে সত্য ন্যায়-নীতি অবলম্বন করার আদেশ দিয়ে থাকেন? তারাই যদি নিজেরা এমন জাজ্বল্যমান মিথ্যাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অবলম্বন করেন, তাহলে মানুষ সত্য ও সৎপথ খুঁজে পাবে কোথায়? মিথ্যার সাথে সত্যের মিশ্রণ ঘটলেও, তা মিথ্যাই হয়। ‘আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলাম’ বাক্যটা একটা দীর্ঘ স্বপ্নের একটি অংশ। এই অংশের ব্যাখ্যাও হযরত মির্যা সাহেব স্বয়ং উপরোক্ত পুস্তকের ৫৬৬ পৃষ্ঠায় এভাবে দিয়েছেন:
ان هذا الخلق الذي رايته اشارة الى تايئدات سماوية ارضية
অর্থাৎঃ আমি স্বপ্নে যে আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করতে দেখেছি, তাতে এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, ঐশী ও জাগতিক সাহায্য আমার সাথে থাকবে। সুতরাং মূল উদ্ধৃতি উহার প্রসঙ্গ এবং প্রেক্ষাপট হতে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, আলোচ্য বিষয়-বস্তু আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের সাথে সম্পর্কিত। এখানে খোদা হওয়ার দাবী নেই। বস্তুতঃ আপত্তিকারীদের উদ্ধৃতিগুলি যেমন ত্রুটিপূর্ণ তেমনি নিরর্থক এবং উদ্দেশ্যমূলক। মহান আল্লাহতাআলা সম্বন্ধে হযরত মির্যা সাহেব তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে যে বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, তার একটি নমুনা সূধীগণের সামনে তুলে ধরলামঃ
“হে শ্রোতাগণ! শ্রবণ কর, খোদা তোমাদের নিকট হতে কি চান? শুধু ইহাই যে, তোমরা তাঁর হয়ে যাও। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক কোর না, আকাশেও না, ভূ-পৃষ্ঠেও না, তোমাদের খোদা সেই খোদা যিনি এখনও জীবিত যেমন তিনি পূর্বে জীবিত ছিলেন। তিনি এখনও তেমনি কথা বলেন, যেমন তিনি পূর্বেও কথা বলতেন। তিনি এখনও তেমনি শুনেন, যেমন তিনি পূর্বে শুনতেন।
তিনি সেই এক-অদ্বিতীয় এবং শরীক বিহীন খোদা যার দ্বিতীয় আর কেউ নেই। কেউ তাঁহার ন্যায় কোন বিশেষ গুণে গুণান্বিত নয়। তাঁর তুল্য কেউ নেই। তাঁর সমগুণশালী কেহ নেই। তাঁর কোন শক্তি নূন্যতমও ক্ষুণ্ণ হয় না৷
তিনি আরশে আছেন। কিন্তু ইহা বলা যায় না যে, তিনি পৃথিবীতে নেই। তিনি পূর্ণ গুণধর। তিনি সত্যিকার সকল প্রশংসার অধিকারী। তিনি সকল সৌন্দর্যের উৎস। তিনি সর্বশক্তিমান। সকল কল্যাণ তাঁর নিকট হতে উৎসারিত এবং সকল বস্তু তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তন করে। তিনি সকল রাজ্যের মালিক, তিনি সর্ব গুণাকর এবং সর্বক্রটি ও দুর্বলতার উর্ধ্বে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীস্থ সকলেরই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য”। (রূহানী খায়ায়েন, ২০ খন্ড, আল্ ওসীয়্যত, ৩০৯-৩১০ পৃষ্ঠা)
এর পরেও কি কেউ বলতে পারেন যে, মির্যা সাহেব খোদা হওয়ার দাবী করেছেন?
(পুস্তকঃ অযথা বিভ্রান্তি)
আপনার উত্তর যোগ করুন
আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।