আপত্তির জবাব

জিহাদ রহিত ঘোষণা করেছেন

জিহাদ রহিত করা হয়েছে শুনে উলামায়ে উম্মত আমাদের সম্মানিত আলেম সম্প্রদায়ের মাঝে ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অথচ বিষয়টি একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি হারাম হালাল ঘোষণা দেয়ার নয়। প্রত্যেক ইবাদতের জন্য শর্ত নির্ধারিত আছে। শর্ত পূর্ণ হলে সেই ইবাদতটি পালনীয় হয়, তা নাহলে নয়। যদি প্রশ্ন করা হয়, হজ্জ ফরজ এ বিষয়ে কি কারও কোন সন্দেহ আছে। এবার বলুন, হজ্জ কি আমরা রমযান মাসে পালন করতে পারি? হজ্জ ফরয বলে কি তা ঋণগ্রস্থদের ও অসুস্থদের জন্যও ফরয? ঠিক একইভাবে যাকাত দেয়াও ফরয। কিন্তু একজন ভিক্ষারী কি যাকাত দিতে বাধ্য? মোটেও না। কেননা তার যাকাত প্রদানের নিসাব পূর্ণ হয় নি। ঠিক একইভাবে ‘সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ’ বা ‘জিহাদ বিস্‌সাইফ’ - এর জন্য খুব কড়া শর্ত রয়েছে। আর শর্তগুলোর মাঝে প্রধানতম শর্ত হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য আক্রান্ত হতে হবে এবং দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত হতে হবে। রসূল বা যুগ-ইমাম মুসলমানদের মাঝে বিদ্যমান থাকতে হবে। আর আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমতি পেয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের নির্দেশ যুগ-ইমাম দিবেন - যে কেউ এ যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে মুসলমানরা পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছে। ধর্মের কারণে মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার করা তো দূরের কথা বরং তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দান করেছে। যেসব মসজিদে শিখরা আস্তাবল গড়েছিল সেসব মসজিদ মুসলমানরা ফিরে পেয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনামলে। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানকারী এমন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করা কুরআন ও রসূলের সুন্নত অনুযায়ী বৈধ নয়। হযরত মির্যা সাহেব কেবল একথার পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র। তিনি নিজের পক্ষ থেকে নতুন কোন বিধান দেন নি।

পবিত্র কুরআনে লেখা আছে ‘হাল জাযাউল এহসানি ইল্লাল ইহসান’ অর্থাৎ কেউ অনুগ্রহ করলে তার অনুগ্রহের বিনিময়ে অনুগ্রহ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়। আল্লাহ তা’লা নিজের একটি গুণ বর্ণনা করেছেন ‘শাকেরুন আলীম’ অর্থাৎ তিনি গুণগ্রাহী। কারও মাঝে তিনি সামান্য গুণ দেখলে তিনি তার মূল্যায়ন করেন। আল্লাহ্ আমাদেরকেও তাঁর গুণে গুণান্বিত হবার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। অতএব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিনস্থ মুসলমানদের আবশ্যক দায়িত্ব ছিল ও আছে তারা যেন নিজেদের হারানো ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ায় এই সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এ কারণে তিনি বারবার জিহাদের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আর তিনি বলেছেন অনুগ্রহশীল সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু নয়।

মে ১৯০০ সনে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) লিখেছেন:

“আমি আপনাদের কাছে একটি বিশেষ শিক্ষা নিয়ে এসেছি আর তা হল, এখন অস্ত্রযুদ্ধ রহিত কিন্তু আত্মশুদ্ধির জিহাদ বলবৎ আছে।” (গভর্ণনমেন্ট আংগ্রেজী আওর জিহাদ, পৃষ্ঠা-১৫, রূহানী খাযাইন, ১৭শ খণ্ড)

তিনি আরো বলেন, “আর যদিও সিমান্ত প্রদেশে এবং আফগানের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন শিক্ষা প্রচারকারী মৌলভী অগণীত রয়েছে কিন্তু আমার মনে হয়, পাঞ্জাব এবং হিন্দুস্তানও এসব মৌলভীমুক্ত নয়। যদি মাননীয় সরকার এদশের সকল মৌলভীকে এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে পবিত্র ও মুক্ত বলে বিশ্বাস করে থাকে তাহলে তাদের এই বিশ্বাস বা ধারণা পুঃনবিবেচনার যোগ্য। আমার মতে মসজিদে গা ঢাকা দেয়া নির্বোধ অগ্নীশর্মা মোল্লা এসব নোংরা চিন্তা চেতনা থেকে পবিত্র বা মুক্ত নয়। আমি সত্য সত্য বলছি, তারা যেমন সরকারের বিভিন্ন অনুগ্রহের অবজ্ঞা করে একদিকে রাষ্ট্রের সুপ্ত শত্রু তেমনিভাবে তারা খোদা তালার দৃষ্টিতেও অপরাধী এবং অবাধ্যতাকারী। কেননা আমি স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি, খোদা তালার কালাম এভাবে নিরপরাধদের হত্যা করার শিক্ষা ঘুনাক্ষরেও দেয় নি। আর যে এমন ধারণা রাখে সে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত।” (গভর্ণনমেন্ট আংগ্রেজী আওর জিহাদ, পৃষ্ঠা-২০ , রূহানী খাযাইন, ১৭শ খণ্ড)

পাঠকদের কাছে একথা অতি স্পষ্ট, শর্ত পূর্ণ হয় নি বিধায় হযরত মির্যা সাহেব জিহাদকে রহিত ঘোষণা করেছেন। হারাম তথা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন নি বরং যুগের চাহিদা অনুযায়ী যেহেতু ধর্ম পালনে কেউ বাধা দিচ্ছে না তাই মির্যা সাহেব এখনকার মত সশস্ত্র যুদ্ধ রহিত করেছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
এ প্রসঙ্গে হযরত মির্যা সাহেবের সমসাময়িক কিছু প্রখ্যাত আলেমদের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি-

স্যার আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল যাকে বর্তমান যুগের আলেম-উলামা অনেক বড় বড় উপাধিতে ভূষিত করে থাকেন, তিনি কী ভাষায় ব্রিটিশদের গুণ গেয়েছেন তা-ও পাঠকদের জানা প্রয়োজন। রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে তিনি যে শোকগাথা লিখেছিলেন তার একটিঅংশ হল,

‘রানির জানাযা কাঁধে উঠেছে, হে ইকবাল তুমি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সেই পথে নিজেকে বিছিয়ে দাও। পরিস্থিতি অবিকল সেরকমই যদিও এ মাসের নাম ভিন্ন। আমরা এ মাসের নাম মুহাররম প্রস্তাব করছি’ (‘বাকিয়াতে ইকবাল’, সংকলক সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ মুঈনী এম.এ. অক্সন)

রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর সময় মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করছিল। এ উপলক্ষে ইকবাল বলছেন, লোকেরা বলে আজ নাকি ঈদের দিন। হলে হতেও পারে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে আজ যদি ঈদের দিন না হয়ে আমাদের মৃত্যুর দিন হত বিষয়টি অধিক সহনীয় ছিল।’ পাঠকবৃন্দ! যে ব্যক্তি রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে এমন সব কথা লিখতে পারে, এমন আবেগের অতিরঞ্জন লিখতে পারে এবং আবেগের আতিশহ্যে ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর দিনকে মুহাররম এবং ঈদের দিনকে শোকের দিন হিসেবে তুলনা করতে দ্বিধান্বিত নয় - তাকে ইসলামের পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ বলতে বর্তমান যুগের আলেমদের বাঁধে না। কিন্তু যিনি রসূল (সা.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী অনুগ্রহশীল রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে শেখান তাঁর বিরুদ্ধে যত অবান্তর আপত্তি! এটা কেমন বিচার!

আবর দেখুন, মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইন বাটালভী ব্রিটিশ সরকারের বিষয়ে তার ধারণা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘রোমান সম্রাট একজন ইসলামী বাদশাহ কিন্তু সাধারণ শান্তি এবং সুব্যবস্থাপনার দিক থেকে ব্রিটিশ সরকার আমাদের মুসলমানদের জন্য কম গর্বের বিষয় নয়। আর বিশেষ করে ‘আহলে হাদীসের’ জন্য এই সরকার শান্তি এবং স্বাধীনতার দিক থেকে বর্তমান সময়ের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো (আরব, রোম তথা কুসতুনতুনিয়া, ইরান, খুরাসান) থেকেও বেশি গর্বের অধিকারী। (ইশাআতুস সুন্নাহ, খণ্ড-৬, নম্বর-১০ , পৃষ্ঠা ২৯২-২৯৩)

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার জন্য অন্ধভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন। আর এতে তিনি এত বেশী আত্মনিয়োগ করেছেন যে, লেখার সময় তার দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। তাই তিনি ইতিহাসের মারাত্মক বিকৃতি ঘটিয়েছেন। তার মতে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ ছিল আর এই জিহাদী চেতনা রোধকল্পেই নাকি ব্রিটিশরা তাদের হাতের পুতুল হিসাবে মির্যা সাহেবকে দাঁড় করিয়েছে। নাউযুবিল্লাহ৷ হযরত মিযা সাহেব ব্রিটিশদের স্বরোপিত বৃক্ষ ছিলেন নাকি আল্লাহ্‌র প্রত্যাদিষ্ট ছিলেন তা পরে আলোচনা করব। তার আগে চলুন, যে বিষয়টিকে সূত্র ধরে তিনি এত বড় একটি গবেষণা কাজ চালিয়েছেন সেই সূত্রটি আদৌ ধোপে টেকে কিনা সেটি যাচাই করে দেখি।

যে সব আলেম উলামার বরাতে আজ ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ ও তার সমমনারা আহমদীয়া বিরোধী কার্যকলাপ বা আন্দোলন পরিচালনা করছেন তাদের দৃষ্টিতে ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিদ্রোহের মূল্যায়ন শুনুন।

আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত আলেম ও নেতা আহমদীয়া জামা’তের প্রধান বিরোধী মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইন বাটালভী তাঁর পত্রিকায় বলেছেন, ‘১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে যে সব মুসলমান অংশগ্রহণ করেছিল তারা ভয়ানক পাপিষ্ঠ এবং কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ছিল নৈরাজ্যবাদী, বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারী’ (ইশাআতুস সুন্নাহ, ৯ম খণ্ড , নম্বর-১০ , পৃষ্ঠা ৪৯)

তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকারের সাথে যুদ্ধ করা বা তাদের সাথে যারা যুদ্ধ করে তাদেরকে কোন প্রকার সাহায্য করা (তারা মুসলমান ভাই-ই হোক না কেন) স্পষ্ট বিদ্রোহ এবং হারাম কাজ।’ (ইশাআতুস সুন্নাহ, ৯ম খণ্ড, নম্বর-১০ , পৃষ্ঠা ৩০৯)

তিনি কেবল তার নিজ পত্রিকাতেই তার এই সিদ্ধান্ত ছাপান নি বরং তার রচিত বই আল ইকতেসাদ ফি মাসাইলিল জিহাদ-এর ২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

‘... এই সকল বক্তব্য ও দলিল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ভারতবর্ষ খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের অধীন হওয়া সত্ত্বেও এটি ‘দারুল ইসলাম’ (যেখানে সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)। কোন মুসলমান রাজা - তিনি আরবেরই হোন, আরবের বাইরেরই হোন, সুদানী মাহদী হোন বা ইরানের সুলতান শাহই হোন কিংবা খুরাসানের আমীরই হোন এই রাজত্বের বিরুদ্ধে কোন বাদশাহর পক্ষ থেকে ধর্মযুদ্ধ করা বা আক্রমণ করা কোনমতেই বৈধ নয়।

‘ইশাআতুস সুন্নাহ পত্রিকার ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১০ম সংখ্যায় একই বিষয়ে তিনি আবার লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মুসলমানদের জন্য হারাম।’

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব এই ‘হারাম' কাজকে ‘হালাল’ ঘোষণা করে নিজের গোড়া নিজেই কেটে দিয়েছেন। ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব যদি আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের ফতোয়ায় সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তাহলে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সাহেব যিনি অখণ্ড ভারতের মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার পথিকৃত এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার বক্তব্য শুনুন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে যেসব মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল তাদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘দুষ্ট প্রকৃতির কিছু মানুষ জাগতিক লোভ লালসায় নিজ স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে নিজেদের মনগড়া চিন্তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক অজ্ঞদের উস্কানী দেয়া এবং নিজেদের সাথে কিছু লোক ভেড়ানোর নাম জিহাদ রেখেছে। আর এ ঘটনাটি ছিল নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হারামযাদাদের কার্যকলাপের মাঝে একটি। এটি জিহাদ অবশ্যই ছিল না। (স্যার সৈয়দ আহমদ রচিত ‘বাগাওয়াতে হিন্দ’ পুস্তক, পৃষ্ঠা ১০৪)

এতেও যদি ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তাহলে ১৮৫৭ সালের তথাকথিত জিহাদের বিরুদ্ধে বেরলভী ফিরকার নেতা মৌলভী সৈয়দ আহমদ রেজা খান সাহেবের বক্তব্য শুনুন। তিনি বলেন, “ভারতবর্ষ হল ‘দারুল ইসলাম’। একে ‘দারুল হাব’ (অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধের স্থান) বলা কখনও সঠিক নয়” (‘নুসরতুল আবরার’ , পৃষ্ঠা ১২৯)।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
মুজাদ্দেদ হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভি (রহ.) সম্পর্কিত একটি মৌলিক সন্দেহের অবসান।

মুজাদ্দেদ হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভি (রহ.) উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে শিখদের বিরুদ্ধে ধর্ম যুদ্ধ করেছিলেন। ত্রয়োদশ হিজরি শতাব্দির মুজাদ্দেদ হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব পাঠানকোটে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। এর উল্লেখ করে মূল হিন্দুস্তানী ভূখন্ডে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করাটা বৈধ ছিল বলে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা এ কথা ভুলে যান, হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) কখনও ইংরেজ শাসন বা শাসকদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ করেন নি বরং অত্যাচারী অনাচারী এবং মুসলিম বিদ্বেষী শিখদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তার জীবনী রচয়িতা মোহাম্মদ থানেশ্বরী বলেন,

‘একজন প্রশ্নকারী তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি এতদূরে গিয়ে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন কেন? এদেশের বর্তমান শাসক ইংরেজরাও কি ইসলামের অস্বীকারী নয়? দেশের অভ্যন্তরে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করে ভারতবর্ষ তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ইংরেজ সরকার যদিও ইসলামের অস্বীকারকারী কিন্তু তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অন্যায় অনাচার করে না ... এবং তাদেরকে ধর্মীয় কর্তব্য পালনে ও ফরয ইবাদতে বাধা দান করে না। আমরা তাদের দেশে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করি ও ধর্ম পালন করি। তারা কখনও এটি নিষেধ করে না এবং এই ব্যাপারে বাধাও দেয় না। আমাদের আসল কাজ হল খোদার তওহীদ ও মহানবী (সা.)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা আমরা সেই কাজ নির্দ্বিধায় এ দেশে করতে পারছি। তাহলে আমরা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে কী কারণে জিহাদ করব এবং ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে কেন আমরা অযথা উভয় পক্ষের রক্তাপাত ঘটাব? এই সদুত্তর শুনে প্রশ্নকারী চুপ হয়ে গেল এবং জিহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝে গেল।” (‘সাওয়ানেহ আহমদী কালাঁ’ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৭১)

আল্লামা শিবলি নোমানী বলেছেন, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্বর্ণযুগ হতে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে এ রীতিই প্রচলিত রয়েছে, তারা যে সরকারের অধীনে থাকে সে সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত ও আজ্ঞানুবর্তি থাকে। এটি কেবল তাদের নীতিই ছিল না বরং এটা তাদের ধর্মীয় শিক্ষাও বটে, পবিত্র কুরআন হাদীস ও ফিকাহ সবগুলোতে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে। (‘শিবলী রচনাবলী’, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭১)

মুসলমানদেরকে ধর্মীয় অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদানকারী একটি সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ যে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ ও হারাম কাজ এ কথা সে যুগের আলেমরাও জানতেন আর আজকের আলেমরাও জানেন। আমাদের পক্ষ থেকে এ উত্তর ছাপার সময় বাংলাদেশের লক্ষাধিক আলেম স্বাক্ষরিত ও প্রকাশিত জঙ্গিবাদ বিরোধী ফতোয়াও এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ সাহেবকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার জন্য একটি ‘হারাম’ কাজকে ‘হালাল’ বলে বরং ইসলামী জিহাদ বলে চালিয়ে দেয়া কতটুকু ইসলামী- আমরা বিবেকবান পাঠকদের কাছে তা জানতে চাই।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে যে সকল পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, সব ক’টিতেই হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে এই অপবাদ দেয়া হয়েছে, যে, তিনি জেহাদকে রহিত করেছেন।

উত্তরঃ জেহাদের ব্যাপারেও বর্তমান যুগের আলেমগণ বিভিন্ন ধরনের ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে হযরত মির্যা সাহেবের উপর অপবাদ দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে তাদের নেতারাই জেহাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়েছেন। নিম্নের উদাহরণ ক’টি দেখুন। এরপর, আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিশ্বাস তুলে ধরবঃ

(১) মাওলানা মুহাম্মদ হুসেইন বাটালবী সাহেবের অভিমত যে, “হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম। ইহা দারুল হরব (যুদ্ধের দেশ) নয়। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে বিদ্রোহ যাতে হাঙ্গামাকারীগণ ইংরেজ গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছিল, উহা দাঙ্গা ছিল, জেহাদ নয়” (ইশায়াতুস সুন্নাহ্, নবম খণ্ড, ১৬ পৃঃ)।

(২) আল্লামা শিবলী নুমানী বলেন, “হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর স্বর্ণযুগ হতে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে এই নিয়ম চলে আসছে যে, তারা যে শাসনের আশ্রয়াধীন হয়ে বাস করেছে, তার প্রতি বিশ্বস্ত ও বাধ্য রয়েছে। ইহা শুধু তাদের কর্ম-পদ্ধতি ছিল না, বরং ইহা তাদের ধর্মের শিক্ষা ছিল, যা কুরআন মাজীদ, হাদীস ও ফেকাহ্ প্রভৃতি সকল শাস্ত্রেই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত আছে (শিবলীর প্রবন্ধাবলী প্রথম খণ্ড, ১৭১ পৃঃ)।

(৩) সুরেশ কাশ্মিরী সাহেব, যিনি আহ্‌মদীদের কঠোর শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, তিনি “সৈয়্যদ আতাউল্লাহ্ শাহ্ বোখারী” নামক পুস্তকের ১৩১ পৃষ্ঠায় লিখেন, “মক্কা মোয়ায্‌যামার হানাফী মুফতী জামনদীন ইবনে আবদুল্লাহ্ শেখ উমর, শাফী মুফতী আহমদ বিন জেহেনী এবং মালেকী মুফতী হোসেন বিন ইব্রাহীমের নিকট হতেও ফত্‌ওয়া আনা হয়েছিল। এই সকল ফত্‌ওয়াতে ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

(৪) মৌলভী মওদূদী সাহেব লিখেন, “ভারতবর্ষ ঐ সময় নিঃসন্দেহে ‘দারুল হরব’ (যুদ্ধের দেশ) ছিল, যখন ইংরেজ সরকার এখানে ইসলামী সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন তারা পরাজিত হলো, ইংরেজী শাসন কায়েম হয়ে গেল এবং মুসলমান ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সাথে এদেশে বাস করা কবুল করে নিল, তখন আর এদেশ ‘দারুল হরব’ রইল না” (সুদ প্রথম খণ্ড, ৭৭-৭৮ পৃঃ)।

(৫) মুহাম্মদ আব্দুর রহীম রচিত “ইসলামে জিহাদ” নামক পুস্তকে “আমাদের কথা” অধ্যায়ে লেখা আছে- “জেহাদ মানেই যুদ্ধ নয়।”

(৬) শাহ ফয়সল ২৪শে এপ্রিল, ১৯৬৫ইং হজ্জ উপলক্ষ্যে মক্কা মুকার্‌রমায় রাবেতা আলমে ইসলামীর ইজতেমাতে বলেনঃ “হে. সম্মানিত ভাইগণ! তোমাদের সকলকে জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্ পতাকাকে সমুন্নত করার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। জেহাদ কেবল মাত্র বন্দুক উঁচানো, বা তলোয়ার চালানোর নাম নয়। বরং আল্লাহ্ কেতাব এবং রসূল মকবুল (সঃ)-এর সুন্নতের প্রতি আহ্বান করা। এইগুলোর উপর আমল করা এবং সকল প্রকার মুস্কিল ও অসুবিধা এবং কষ্ট সত্ত্বেও সুদৃঢ়রূপে ইহার উপর কায়েম থাকার নাম জেহাদ। কুরআনের দৃষ্টিতে বড় জেহাদঃ

وجاهدهم به جهادا كبيرا ـ (فرقان ٥ ع )

অর্থাৎ (হে নবী) কুরআন মাজীদ দ্বারা তাদের (কাফেরদের সাথে জেহাদ কর) (ফুরকান, ৫ম রুকু)।

সুতরাং কুরআনের শিক্ষাকে প্রসারতা দেয়া অর্থাৎ কাফেরগণের মধ্যে দাওয়াত ও তবলীগকে জারী রাখার নাম হলো বড় জেহাদ। আহমদীয় মুসলিম জামাতও ইহাই বিশ্বাস করে এবং তদনুযায়ী কাজও করে।

হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর দৃষ্টিতে ইমাম মাহ্‌দী (আঃ)-এর যুগের জেহাদ

হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ)-এর যুগে তরবারীর যুদ্ধ হবে না বলে হযরত রসূলে করীম (সঃ) পূর্বে বলে গেছেন,

يضع الحرب

অর্থাৎঃ তিনি (ইমাম মাহ্‌দী) যুদ্ধকে রহিত করবেন (বুখারী)। এত্থেকেই বুঝা যায় ইমাম মাহ্‌দী জেহাদ করবেন বটে, কিন্তু সে জেহাদ অস্ত্র-শস্ত্রের প্রচলিত যুদ্ধ নহে যা অকল্যাণকে ডেকে আনে, বরং উপরোক্ত কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের যুক্তি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাহায্যে সত্যের শত্রুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ জেহাদ করবেন। এ যুগে কলম দ্বারাই এ জেহাদ সাধিত হবে। যেমন ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) বলেছেনঃ “অসির কাজ আমি সেধেছি মসীতে।” দাজ্জাল ইয়া’জুজ মা’জুজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আল্লাহ্‌র রসূল (সঃ) বলেছেনঃ

لايدان لاحد بقتالهم

অর্থাৎঃ এদের সাথে অস্ত্রের বা শক্তির যুদ্ধ করার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয় নি (মুসলিম)।

উপরে কুরআন ও হাদীসের আলোকে জেহাদের আসল রূপ তুলে ধরলাম। জেহাদ তিন প্রকারের- ১) নফসের জেহাদ ২) প্রাণের জেহাদ ৩) ধন-সম্পদের জেহাদ। হযরত রসূল করীম (সঃ) ইমাম মাহ্‌দীর যুগে তরবারীর জেহাদ রহিত হবার ঘোষণা নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু বাকি দু’প্রকারের জেহাদ তো রহিত করেন নি। হযরত মির্যা সাহেবের উপর যে অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি জেহাদ হারাম করেছেন, তা বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার আবেদন হযরত মির্যা সাহেবের এমন দাবী পেশ করুন যাতে হযরত মির্যা সাহেব সর্বপ্রকার জেহাদকে চিরতরে হারাম বলেছেন। হযরত মির্যা সাহেব বলেনঃ

“কোন কোন অজ্ঞ লোক আমার উপর অপবাদ দিয়ে থাকে যে, আমি ইংরেজদের রাজত্বে বসবাস করি বলে জেহাদ নিষেধ করি। এই অজ্ঞ ব্যক্তিগণ এ কথা বুঝে না যে, আমি যদি মিথ্যা কথা দ্বারা এই গভর্নমেন্টকে খুশী করতে চাইতাম, তবে কেন আমি পুনঃ পুনঃ একথা বলতাম যে, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) ক্রুশ হতে মুক্ত হয়ে কাশ্মীরের অন্তর্গত শ্রীনগরে স্বাভাবিকভাবে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। তিনি খোদাও ছিলেন না খোদার পুত্রও না। আমার এই উক্তিতে ধর্মপ্রাণ ইংরেজ কি সন্তুষ্ট হবেন? অতএব, শুনে রাখো! হে অজ্ঞ ব্যক্তিগণ! আমি এই গভর্নমেন্টের তোষামোদকারী নই। বরং প্রকৃত কথা এই যে, ইংরেজ গভর্নমেন্ট ইসলাম ধর্মে এবং ধর্মের রীতিনীতিতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করে না এবং স্বধর্মের উন্নতিকল্পে আমাদের প্রতি তরবারীও চালায় না। এরপর গভর্নমেন্টের সাথে ধর্মযুদ্ধ করা কুরআন শরীফের শিক্ষানুসারে নিষিদ্ধ, কারণ তারাও কোন ধর্মযুদ্ধ করে না (কিশিয়ে নূহ)।

(পুস্তকঃ অযথা বিভ্রান্তি)

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।