আপত্তির জবাব

লেখনীতে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ব্যাবহার করেছেন

বাংলায় বলে ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।’ হযরত মির্যা সাহেবের ক্ষেত্রে এক শ্রেণির আলেম-উলামাদের আচরণ ঠিক তেমনই। তিনি যে শব্দ যে অর্থে ব্যবহার করেছেন সে দিকে না গিয়ে জোরপূর্বক আক্ষরিক অর্থ বা পূর্বাপর বাদ দিয়ে নেতিবাচক অর্থ করে বলা হচ্ছে তিনি নাকি গালাগালি করেছেন। অথচ সামান্য ধৈর্য ও নিরপেক্ষতাসহ বিষয়টিকে দেখলেই কিন্তু এর সমাধান হয়ে যায়।
আপত্তি: এই অধ্যায়ে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ প্রায় চার পৃষ্ঠাব্যাপী হযরত মির্যা সাহেবের লেখার বিভিন্ন অংশের খণ্ডিত বাক্যের বিকৃত অর্থ করে আপত্তি হিসাবে তুলে ধরেছেন। (আহমদী বন্ধু - পৃষ্ঠা ২৭-৩০)

উত্তর: ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব তার ভদ্রতার আড়ালে যে কত মিথ্যাচার করেছেন তার কিছু নমুনা ইতিপূর্বেও আমরা তুলে ধরেছি আর এখন পাঠকদের সামনে আরও কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।

শেষ পর্যন্ত মানুষের ভন্ডামী ও মিথ্যাচার ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয় না। ‘আহমদী বন্ধু’ বইয়ের ২৭ ও ২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, তিনি নাকি হিন্দুদের উপাস্যকে জঘন্য অশ্লিল ভাষায় উল্লেখপূর্বক হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলেন যার কারণে তারা রসূল (সা.) অবমাননায় উঠেপড়ে লেগেছিল। এরই ফলে নাকি হিন্দুরা ‘রঙ্গিলা রসূল’ নামে বই রচনা করেছে! সুধী পাঠক, নকল করতেও বুদ্ধি লাগে। একইভাবে মিথ্যা কথা বলতেও মৌলিক সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। যেভাবে ‘আল্লামা’ বলেছেন, ঘটনা আদৌ সেভাবে ঘটে নি। যার ইতিহাস সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানও আছে সে জানে, ‘রঙ্গিলা রসূলের’ লেখক ১৯২৪ সালে এই জঘন্য পুস্তিকা রচনা করে এবং এর ফলে মুসলমানদের আবেগ অনুভূতিতে চরম আঘাত লাগে এবং একজন বিভ্রান্ত মুসলমান সেই আবেগ সহ্য করতে না পেরে তাকে হত্যাও করে ফেলে। পাঠক, মির্যা সাহেব ১৯০৮ সালে ইন্তেকাল করেন আর ‘রঙ্গিলা রসূল’ লেখা হয় ১৯২৪ সালে। অতএব ইতিহাস প্রমাণ করে মির্যা সাহেবের লেখার প্রতিক্রিয়ায় আদৌ ‘রঙ্গিলা রসূল’-এর রচনা হয় নি। এটি ইসলাম বিদ্বেষীদের পরবর্তী সময়ের অপকর্ম। অতএব ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের ইতিহাস বিষয়ে পাণ্ডিত্য এখন সর্বজন বিদিত!

আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, যে বিষয়টি অপরাধ হিসেবে হযরত মির্যা সাহেবের প্রতি আরোপ করা হয়েছে সেটি আদৌ মির্যা সাহেবের কথাই নয়। বরং এই কুরুচীপূর্ণ বিশ্বাস আর্য-সমাজীরাই লালন করত। একথাই মির্যা সাহেব লিখেছেন। মির্যা সাহেব একাধারে আর্যদের অযৌক্তিক বক্তব্য খণ্ডন করে শেষে এসে বলেছেন, ‘অত্যন্ত নোংরা ও লজ্জাকর একটি শিক্ষা তারা লালন করে আর তাদের সেই শিক্ষা হল, পরমেশ্বর নাকি নাভির দশ আঙ্গুল নীচে অবস্থিত’ (রূহানী খাযায়েন, চশমায়ে মারেফাত পৃষ্ঠা-১১৪)। যেস্থলে মির্যা সাহেব নিজে বলছেন এটি লজ্জাকর ও নোংরা একটি বিশ্বাস সেক্ষেত্রে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব কীভাবে এটিকে তাঁর বক্তব্য হিসাবে উপস্থাপন করতে পারেন? এটি প্রকাশ্য খেয়ানত বই কিছুই নয়। ‘আল্লামা’ বিষয়টির সত্যাসত্য জানেন না এটা সঠিক নয়। তিনি বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলেম, উর্দু আরবীর জ্ঞান রাখেন। তিনি নিশ্চয় পড়েই আপত্তি করেছেন। তাই এই চাতুরী থেকে বোঝা যায় তিনি তার পূর্বসূরিদের মতই জনগণকে উস্কে দেয়ার জন্য এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এমন আপত্তি উত্থাপন করেছেন।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)
আপত্তি : ‘আহমদী বন্ধু’ পুস্তিকার ২৯ পৃষ্ঠায় ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ মির্যা সাহেবের গালি গালাজ শিরোনামে বিশদ তালিকা তুলে ধরে আপত্তি করেছেন।

উত্তর: হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই শত্রুদের পক্ষ থেকে অপবাদ আরোপ করা হয় তিনি নাকি তার বিরুদ্ধবাদিদেরকে জঘন্য গালাগালি করেছেন। এরপর তারা একটি লম্বা তালিকা তুলে ধরে এর মাধ্যমে জনগণকে উসকানি দিয়ে থাকে। আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের পক্ষ থেকে যতবার এসব জঘন্য মিথ্যা অপবাদের যৌক্তিক উত্তর প্রদান করা হয় ততবারই তারা সেই সমস্ত যুক্তি এড়িয়ে গিয়ে আক্ষরিক ও শাব্দিক অর্থে সেই শব্দগুলোকে নিজেদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে থাকে। এ বিষয়ে আলোচ্য বইতেও আলোচনা রয়েছে। কিন্তু এ স্থলে আমরা সচেতন পাঠকের কাছে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে এর উত্তর তুলে ধরছি যাতে সমাজে গোলযোগ ও ফিতনা সৃষ্টিকারীদের মুলোৎপাটিত হয়।

কঠোর-বাক্য ব্যবহার সম্পর্কে মির্যা সাহেব স্পষ্ট ভাষায় বলেন,

‘গালিগালাজ এক জিনিষ আর প্রকৃত ঘটনার বিবরণ - তা যতই অপ্রিয় ও তিক্তই হোক না কেন, আরেক জিনিষ। প্রত্যেক সত্যবাদী ও সত্য বর্ণনাকারীর আবশ্যক দায়িত্ব হল, সত্য বক্তব্যকে প্রত্যেক উদাসীন বিরুদ্ধবাদীর কর্ণগোচর করানো। সেই বিরুদ্ধবাদী সত্য কথা শুনে অসন্তুষ্ট হলে হোক’ (রূহানী খাযায়েন খণ্ড-৩, ইযালায়ে আওহাম: পৃষ্ঠা ২০)। এ ধরনের উদাহরণ তথা সত্যের বর্ণনা পবিত্র কুরআনেও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কুরুচীপূর্ণ মানুষ সেগুলোকে বক্র দৃষ্টিতে দেখে আর খোদাভীরুরা এসব বক্তব্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যের প্রকাশ দেখে ঈমানে আরও বলিয়ান হয়ে নিজেদের দোষত্রুটি দূর করতে এবং প্রকৃত মুসলমান হতে চেষ্টা করে।

কুরআন শরীফ পবিত্র গ্রন্থ এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। এই পবিত্র কুরআনের সূরা বাইয়্যেনার ৭ নম্বর আয়াতে কাফেরদের বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লা বলেন, أُولَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ অর্থাৎ ‘এরাই নিকৃষ্টতম জীব’। পাঠকবৃন্দ, ভাল করে চিন্তা করে দেখুন ‘শারুল বারিয়‍্যা’ অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে, সব সৃষ্ট জীবের মাঝে নিকৃষ্টতম। ‘নিকৃষ্টতম জীব’ বলে যত নিকৃষ্ট ও নোংরা জীব-জন্ত ও নোংরা মানুষ রয়েছে তাদেরকে এর অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তাহলে কাফেরদেরকে কোন ভাষায় মূল্যায়ণ করা হয়েছে, একবার ভেবে দেখুন? মহানবী (সা.) মিশকাত শরীফের একটি বিখ্যাত হাদীসে শেষ যুগের লক্ষাণাবলী উল্লেখ করার পর সে যুগের আলেম-উলামাদের সম্পর্কে বলেছেন,

علماؤهم شر من تحت أديم السماء من عندهم تخرج الفتنة وفيهم تعود

তাদের আলেমগণ আকাশের নিম্নস্থ সকল সৃষ্টজীবের মধ্যে নিকৃষ্টতম জীব হযে। তাদের মধ্য থেকে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে এবং তাদের মাঝেই তা ফিরে যাবে।” (মিশকাত, কিতাবুল ইলম)

এই হাদীসে ‘শার্‌রুম মান তাহ্‌তা আদীমিস সামা’ বলার পর পৃথিবীর বুকের কোন নোংরা জীব বা নিকৃষ্ট মানুষ এর আওতা বহির্ভূত থাকে কি? এই পরিচ্ছদে মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেবের প্রধান আপত্তি হল, মির্যা সাহেব শেষযুগের আলেম-উলামাদের গালি দিয়েছেন। পাঠকবৃন্দ, মির্যা সাহেব নিজের থেকে কোন গালি দেন নি বরং আমাদের প্রিয় রসূল (সা.) শেষযুগের আলেম-উলামাদের সম্পর্কে যা বলে গেছেন তারই ভাবানুবাদ করেছেন মাত্র। একইভাবে মহানবী (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস কন্যুল উম্মালে বর্ণিত আছে,

تكون في أمتي قزعة فيصير الناس إلى علمائهم فإذا هم قردة وخنازير

অর্থাৎ 'আমার উম্মতে হঠাৎ বিরাট অস্থিরতা দেখা দিবে। মানুষ তখন তাদের আলেমদের শরণাপন্ন হবে কিন্তু তারা গিয়ে হঠাৎ দেখতে পাবে তারা শুকর ও বানরে পরিণত হয়েছে’। (কনযুল উম্মাল: ১৪শ খণ্ড, হাদীস নম্বর-৩৮৭২৭)

‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ সাহেব আপনি অসন্তুষ্ট হবেন না। এটি মহানবী (সা.)-এর বাণী। এ হাদীসের যত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই করা হোক, শব্দগুলো কিন্তু স্পষ্ট। অতএব যে অর্থে যে কথা কুরআনে বলা আছে আর যে কথা রসূলে আকরাম (সা.) বলে গেছেন সে কথাই হযরত মির্যা সাহেব যথাস্থানে সেগুলোর অনুবাদ করে দিয়েছেন মাত্র।

প্রত্যেক খোদাভীরু আলেমের দায়িত্ব সে যেন নিজের দিকে তাকিয়ে ইস্তেগফার করে যাতে সে রসুল (সা.)-এর এই সাবধান বাণীর আওতাভুক্ত না হয়।

গালিগালাজ সংক্রান্ত আপত্তি শেষে লানত প্রসঙ্গটি আবার টেনে এনেছেন ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ। এখন শুধু পাঠককে একটি বিষয় বলছি, লানত করা যে আল্লাহর সমীপে একান্ত মিনতি বা একটি দোয়া তা ‘আল্লামা’ বেমালুম ভুলে গেছেন। ‘আল্লামা’র মত হল, লানত করলে নাকি নবী হতে পারে না। তিনি ভুলে গেছেন,

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ

বনী ইসরাঈলের মধ্য থেকে যারা অস্বীকার করেছিল তাদেরকে দাউদ ও ঈসা ইবনে মরিয়মের মুখে অভিশাপ দেয়া হয়েছে। আর এমনটি করার কারণ হল, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং ক্রমাগতভাবে তারা সীমালঙ্ঘন করছিল (সূরা মায়েদা: ৭৯)। তাহলে, বনী ইসরাইলের এই দুই নবী লানত করার কারণে কি ‘আল্লামা’ মজিদের দৃষ্টিতে আর নবী নন? লা’নত তথা আল্লাহ্ তা’লার কাছে মিনতি করা আল্লাহ্‌র শিক্ষা পরিপন্থী নয় বরং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার একটি মাধ্যম। শুধু ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ কেন, সাধারণ আলেম মাত্রই এ বিষয়টি জানেন। আর হাজার লানতে ‘আল্লামা’র আপত্তির উত্তর এই পুস্তকে পৃথক একটি অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে, দয়া করে পড়ে নিন।

‘আল্লামা’ সাহেব তার রচিত আহমদী বিরোধী পুস্তিকায় প্রধানতম আপত্তি হিসাবে মির্যা সাহেব সম্পর্কে লিখেছেন তিনি নাকি অসংখ্য মুসলমানকে অকথ্য ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। বিশেষ করে তিনি নাকি ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ তথা বেশ্যার সন্তান অর্থে মুসলমানদেরকে গালি দিয়েছেন। (আহমদী বন্ধু: পৃষ্ঠা- ৮ ও ২৯)

প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) যদি সত্যিই আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম গ্রন্থে মুসলমানদেরকে এই অর্থেই এমন গালি দিয়ে থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি জঘন্য কাজ করেছেন এবং মুসলমানদের এতে ক্ষিপ্ত হবারই কথা।

কিন্তু যদি বিষয়টি এর উল্টো দাঁড়ায় তাহলে বুঝতে হবে বিরুদ্ধবাদীরা মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। প্রত্যেক শব্দের অনুবাদ তার পূর্বাপর ও বিষয়বস্তুর আলোকে করতে হয়। যেখানে শাব্দিক অর্থে বিষয়টি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে তার গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ গ্রহণ করতে হয়। যেমন, ‘ওয়া’তাসিমূ বিহাবলিল্লাহে জামীআ’। তোমরা সবাই সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর। এখানে আল্লাহর রশি হিসাবে বাহ্যিক অর্থ করা সম্ভবই নয়। আল্লাহর রশি হিসেবে যদি আকাশ থেকে বাহ্যিক কোন দড়ি ঝুলানোও হয় আর একসাথে সব মুসলমান সেটিকে আঁকড়ে ধরতে চায় তাহলেও দশ বিশ জনের বেশি কেউ তা ধরতে পারবে না। অতএব এর তাৎপর্যপূর্ণ গভীর অর্থ অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। আর তা হল, আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে প্রেরিত আল-কুরআনকে বা মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (সা.)-কে অথবা যুগ-ইমামকে সবাই আঁকড়ে ধর। এছাড়া এর বাহ্যিক কোন অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়। তেমনিভাবে সূরা বাকারার একেবারে প্রারম্ভেই সত্য অস্বীকারকারীদের ‘সুম্মন বুকমুন উময়ুন’ বলা হয়েছে- এতে বাহ্যিকভাবে তাদেরকে বোবা, বধির বা অন্ধ বুঝানো হয় নি বরং আত্মিকভাবে বোবা, বোধির বা অন্ধ বলা হয়েছে। আমরা কেন এটিকে আত্মিকভাবে নিয়েছি? কেননা পূর্বাপর আমাদেরকে এর বাইরে যাবার অনুমতি দেয় না।

ঠিক একইভাবে, মির্যা সাহেব মুসলমানদের ‘বেশ্যার বংশধর’ বলে গালি দেন নি। ‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম’ পুস্তক ১৮৯৩ সালের লেখা। এই বইতে তাঁর অস্বীকারকারী মুসলমানদের বেশ্যার বংশধর বলার প্রশ্নই ওঠে না। ১৮৯৩ সালে লেখা বইয়ে ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ মুসলমানদের গালি অর্থে দেয়া তো দূরের কথা বিষয়টি তাদের উদ্দেশ্যেই বলা হয়নি।

‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম’ গ্রন্থে হযরত মির্যা সাহেব রাণী ভিক্টোরিয়াকে মুসলমান হবার আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন মুসলমানদের মনোস্তুষ্টি করতে। তাহলে, কীভাবে সেই একই গ্রন্থে মুসলমানদেরকে তিনি জঘন্য ভাষায় গালি দিতে পারেন?

জানা আবশ্যক, হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) উক্ত বইয়ের আলোচ্য অংশে নিজের ইসলাম সেবার কথা তুলে ধরে বলেছেন: “আমার বয়স যখন ২০, তখন থেকেই আর্য সমাজীদের ও খৃষ্টানদের সাথে যুক্তিতর্কের মোকাবিলা করার ইচ্ছা আমার মনে সৃষ্টি হল। তদানুযায়ী আমি ‘বারাহীনে আহমদীয়া,’ ‘সুরমা চাশমায়ে আরিয়া’, ‘ইযালায়ে আওহাম’ এবং ‘দাফেউল ওয়াসাওয়েস’ প্রভৃতি পুস্তক রচনা করি। এগুলো ইসলামের সমর্থনে লেখা। প্রত্যেক মুসলমান এই বইগুলোকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখে এবং এগুলোতে পরিবেশিত তত্ত্ব ও তথ্য দ্বারা উপকৃত হয় এবং তারা আমার ইসলামের দিকে আহবান করাকে সমর্থন দেয়। ‘ইল্লা যুররিয়াতুল বাগায়া আল্লাযীনা খাতামাল্লাহু আলা কুলুবিহিম ফাহুম লা ইয়াকবালুন’। ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ ছাড়া অর্থাৎ যাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন, তারা ঈমান গ্রহণ করবে না (রুহানী খাযায়েন, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪৮)। এখানে মির্যা সাহেব ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ অর্থ কি তা স্পষ্টভাবে বলেই দিয়েছেন। এরা হল তারা যাদের হৃদয়ে আল্লাহ্ মোহর মেরে দিয়েছেন।

হযরত মির্যা সাহেব যখন ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ (ইসলাম ধর্মের পক্ষে দলিল- প্রমাণ সংবলিত) ও ‘সুরমা চশমায়ে আরিয়া’ (আর্য সমাজীদের অসারতা প্রমাণকল্পে) বই লিখলেন তখন আর্য সমাজীদের নেতা পেশাওয়ার নিবাসী পণ্ডিত লেখরাম উক্ত পুস্তিকাদ্বয়ের বিরুদ্ধে ‘খাবতে আহমদীয়া’ এবং ‘তাকযীবে বারাহীনে আহমদীয়া’ বই রচনা করে। এর প্রত্যুত্তরে দলমত নির্বিশেষে মুসলমানরা মির্যা সাহেবের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। মৌলবী মোহাম্মদ হোসেন বাটালভী হযরত মির্যা সাহেব লিখিত ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ পুস্তকের সমর্থনে একটি রিভিউ প্রকাশ করেন। একইভাবে লাহোরের মুসলিম বুক ডিপো নিজ খরচে মির্যা সাহেবের লেখা ‘সুরমা চাশমায়ে আরিয়া’ বইটি পুনঃমুদ্রন করে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে গাল দেয়ার অভিযোগ তিনি তার একই বইতে মুসলমানদেরকে রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্য দোয়া করতে বলেছেন যেন রাণী মুসলমান হয়ে যান (রুহানী খাযায়েন: ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৬-৫২৭ পৃ) আবার ৫৩৫ পৃষ্ঠায় রাণীকে বলেছেন যে, হে রাণী ভিক্টোরিয়া! আপনি জেনে রাখুন, মুসলমানরা আপনার বিশ্বস্ত প্রজা। তাই আপনি তাদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিবেন এবং তাদের মনোস্তুষ্টির ব্যবস্থা করবেন।’ বইয়ের ৫৪০ পৃষ্ঠায় নেক উলামাদের প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘সমস্ত প্রশংসা সেই মহান অস্তিত্বের- যিনি আধ্যাত্মিক আলেমদের এবং মোহাদ্দেসীনদের নবীদের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন এবং তাদের উত্তম তরবিয়ত করেছেন। যিনি রাণীকে মুসলমান হবার আহ্বান জানাচ্ছেন, যিনি মুসলমানদের মনোস্তুষ্টি করতে রাণীকে আহবান জানাচ্ছেন, যিনি আধ্যাত্মিক উলামাদের এত প্রশংসা করেছেন তিনি হঠাৎ তাদের এত জঘন্য ভাষায় গালি দিবেন- তা কেমন করে সম্ভব? যে ব্যক্তি হযরত মির্যা সাহেবের লেখা ‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’ বইটি মনোযোগ সহকারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পড়েছে সে এ জাতীয় কথা বলতেই পারে না।

এছাড়াও ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’-র অনুবাদ ‘বেশ্যার বংশধর’ করা ঠিক নয়। কেননা মির্যা সাহেব তথা লেখক নিজেই এ শব্দের অর্থ ‘বিদ্রোহী মানুষ’ করেছেন। মৌলবী সা’দুল্লাহ লুধিয়ানীকে ‘আঞ্জামে আথম’ পুস্তকে তিনি ‘ইবনু বাগা’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজেই এর অনুবাদ করেন: ‘হে বিদ্রোহী মানুষ’ (আল-হাকাম, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯০৭ সন)।

অতএব ‘যুররিয়াতুল বাগায়ার’ অর্থ হল বিদ্রোহীদের সন্তান। বলা বাহুল্য, আল্লাহ্ পক্ষ থেকে আদিষ্ট মহাপুরুষকে যারা অমান্য বা অবজ্ঞা করে তারা অবাধ্য ও বিদ্রোহী। এ বিষয়টিই তিনি আরবীতে উপস্থাপন করেছেন। প্রবাদ- প্রবচনে শাব্দিক অর্থ কখনও গ্রহণ করা হয় না বরং এর অন্তর্নিহিত একটি অর্থ থাকে। একথা সব ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আরবী জানা সব আলেমও এটি ভালভাবে জানেন। যেমন ‘ইবনুস সাবীল’ বলতে রাস্তার ঔরসজাত সন্তান বুঝায় হয় না বরং এ শব্দকে ‘পথিক’ বা ‘মুসাফির’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়। কেবল উন্মাদই ‘ইবনুস সাবীল’-এর অর্থ ‘পথিক’ না করে ‘পথের ঔরসজাত সন্তান’ করবে। তাই এমন ব্যক্তি যে নিজেকে নিজে গালি দেয়ার শখ রাখে সে ছাড়া অন্য কেউ ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’-র বিকৃত কোন অর্থ করবে না। আর লেখক যখন নিজের বক্তব্যে ব্যবহৃত কোন শব্দের অর্থ নিজেই করে দেন তখন কারও এতে অর্থ বিকৃতির অধিকার থাকে না। এর পরও যদি কেউ এর অর্থ ‘বেশ্যার বংশধর’ করেন তবে এটি অযথা নিজেকে নিজেই গাল দেয়ার মতো ব্যাপার হবে। মির্যা সাহেব এর জন্য দায়ী নন।

এখানে তার অপবাদের আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-

‘আল্লামা’ আপত্তি করেছেন, মির্যা সাহেব নাকি মৌলভী সা’দুল্লাহকে ‘হিন্দুর বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছেন।

পাঠকবৃন্দের জানা থাকা দরকার, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) মৌলভী সা’দুল্লাহ্ সম্পর্কে ‘হিন্দুযাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে ‘হিন্দুর ছেলে’। প্রকৃতপক্ষেই মৌলভী সা’দুল্লাহ লুধিয়ানী হিন্দু থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মৌলভী সা’দুল্লাহ্‌র পিতা হিন্দু ছিলেন। এখানে মির্যা সাহেব তার পিতৃপরিচয় তুলে ধরেছেন। কিন্তু এর অনুবাদ করতে গিয়ে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ হিন্দুর ছেলে না বলে ‘হিন্দুর বাচ্চা’ বলে বিকৃতকরে একে গালিররূপ দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন।

‘আল্লামা’ যদি এরপরও এসবকে কুরুচিপূর্ণ জঘন্য গালি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাহলে তার জন্য একটি শিক্ষনীয় ঘটনা তুলে ধরছি।

নিশ্চয় তিনি জানেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে সুহায়লের আগে মক্কার যে সব বড় বড় কাফের সর্দার হুদায়বিয়ার প্রান্তরে এসে চুক্তি করতে উদ্যত হয় তাদের মাঝে একজন ছিল উরওয়া। উরওয়া তার আলোচনার এক পর্যায়ে সাহাবীদের ঈমান এবং তাদের দৃঢ়তা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে বাজে মন্তব্য করে। তার এ কথায় পরোক্ষভাবে রসূলে করিম (সা.)-এর অবমাননাই নিহীত ছিল। তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) সহ্য করতে না পেরে রসূলে করীম (সা.)-এর উপস্থিতিতে বলেছিলেন,

فَقَالَ لَهُ أَبُو بَكْرِ الصِّدِّيقُ امْصُصْ بِبَطْرِ اللَّاتِ أَنَحْنُ نَفِرُّ عَنْهُ وَنَدَعُهُ

অর্থাৎ তখন আবু বকর (রা.) তাকে বললেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যাবো? (বুখারী কিতাবুশ শুরুত; ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত হাদীস নম্বর ২৫৪৭)

এটাকি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর অশালীন চরিত্রের রূপ ছিল নাকি রসূলে করিম (সা.)-এর সম্মান রক্ষার্থে এবং তাঁর অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল? যে অর্থে হযরত আবু বকর (রা.) কড়া জবাব দিয়েছেন সেই একই অর্থে হযরত মির্যা সাহেবের বক্তব্যও প্রযোজ্য হতে পারে।

আমরা আশা করি, হযরত আবু বকর (রা.) এর পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক উচ্চ মর্যাদা বিষয়ে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ ও দেওবন্দীদের কোন সংশয় নেই। আমরা আশা করি, দেওবন্দী আলেম হিসাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)- এর এই বক্তব্যটি আক্ষরিক অর্থে গালিগালাজ হিসাবে তারা নিবেন না বরং তাঁর আত্মাভিমান লক্ষ্য করে রসূলের সম্মান রক্ষাকারী হিসাবেই তাঁকে বিবেচনা করবেন।

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) কী কারণে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন,

“বিরুদ্ধবাদীদের সাথে লিখিত তর্কযুদ্ধের সময় আমার পক্ষ থেকে কিছুটা কঠোর বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কঠোরবাক্য ব্যবহারের সূচনা আমার পক্ষ থেকে হয় নি বরং এসব বক্তব্য চরম নোংরা আক্রমণের জবাবে লেখা হয়েছিল। বিরুদ্ধবাদীদের কথা এতই কঠোর ও নোংরা ছিল যার ফলে এর বিপরীতে এতটুকু কঠোরবাক্যের প্রয়োজন ছিল। একথার প্রমাণ হিসাবে আমি আমার পুস্তকাদির কঠোর বাক্য এবং বিরুদ্ধবাদীদের কঠোরবাক্য পাশাপাশি ‘কিতাবুল বারিয়‍্যাহ’ পুস্তকে তুলে ধরেছি। সেই সাথে এটিও মনে রাখতে হবে, আমি এসব বাক্য প্রত্যুত্তরে ব্যবহার করেছি। কঠোরবাক্যের সূচনা বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে হয়েছিল। আমি চাইলে এসব নোংরা ভাষা শুনেও ধৈর্য ধারণ করতে পারতাম, কিন্তু দু’টি কারণে আমি তাদের উত্তর দেয়া সমীচীন মনে করেছি। প্রথমত, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কঠোরভাষার উত্তর কঠোর ভাষায় পেয়ে যেন নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করে এবং ভবিষ্যতে যেন তারা শালীনতা বজায় রেখে আলোচনা করে। দ্বিতীয়ত, বিরুদ্ধবাদীদের চরম অবমাননাকর এবং উস্কানীমূলক এসব লেখার কারণে সাধারণ মুসলমানরা যেন উত্তেজিত হয়ে না যায় এবং কঠোরভাষার উত্তর কিছুটা কঠোর ভাষার দেয়া হয়েছে দেখে যেন তারা নিজেদেরকে একথা ভেবে আশ্বস্ত করতে পারে, যাক কঠোর বাক্যের বিপরীতে কিছুটা হলেও কঠোর ভাষায় জবাব দিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এভাবে যেন তারা বর্বরোচিত প্রতিশোধ গ্রহণ করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখে।” (কিতাবুল বারিয়‍্যাহ, রূহানী খাযায়েন ১৩শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১ ও ১২)।

(পুস্তকঃ হে ‘আল্লামা’! - প্রকৃত ইসলামই আমাদের ঠিকানা)

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।