আহমদীয়াতের বিরুদ্ধাচরণের পটভূমি
পাকিস্তানের বর্তমান সরকার আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনার যে অভিযান চালাইয়া যাইতেছে, উহার কয়েকটি ধরণ রহিয়াছে। একটিতো হইল এই যে, দেশের নিরীহ জনসাধারণের উপর এই চাপ সৃটি করা হইতেছে এবং তাহাদের স্বার্থকে এই শর্তের সহিত বাঁধিয়া দেওয়া হইতেছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাহারা আহমদীয়া জামা’তের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ, ইমাম মাহ্দী ও মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা না করিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাহাদের কাজকর্ম চলিতে দেওয়া হইবে না। বস্তুতঃ পাকিস্তানের বর্তমান সরকার মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে তাহাদের নিজেদের দ্বারা মিথ্যা অপবাদ রটনাকে জনগণ কর্তৃক অপবাদ রটনার মিথ্যা রূপ দান করিয়াছে। এতদসত্ত্বেও ইহা এইরূপ কোন গণ-আন্দোলন নয়, যাহাতে লোকদের হৃদয় হইতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার ইচ্ছার উদ্রেক হয়। বরং দেশের বর্তমান আইন পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্য করিতেছে যে, সে হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাইবে। অন্যথা সে কোন কোন ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ হইতে বঞ্চিত থাকিয়া যাইবে। এমনকি কোন পাকিস্তানী ভোটাধিকারও লাভ করিতে পারে না, যদি সে হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা না করে। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তানের ভিতর হইতেও এবং বিদেশে বসবাসরত পাকিস্তানী প্রবাসীদের নিকট হইতেও এইরূপ বিপুল সংখ্যক দৃষ্টান্ত আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিতেছে যে, তাহারা এই ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাইতেছে এবং প্রকাশ্যে এই কথা বলিতেছে যে, “আমরা জানি না মির্যা সাহেব কি ছিলেন এবং প্রকৃতই কি খোদাতায়ালা তাহাকে প্রেরণ করিয়াছেন বা করেন নাই। অতএব এই পাপ আমাদের স্কন্ধে বর্তাইও না।” কিন্তু যেহেতু ইহা ব্যতীত তাহাদের কাজ চলিতে পারে না সেই হেতু জনগণকে আইনের দ্বারা বাধ্য করা হইতেছে। কাজেই পরিশেষে তাহাদের মধ্য হইতে বিপুল সংখ্যক লোক মিথ্যা অপবাদের উপর দস্তখত করিতে বাধ্য হইয়া পড়ে।
মিথ্যা অপবাদ রটনার দ্বিতীয় পন্থা এইভাবে গ্রহণ করা হইতেছে যে, আহমদীদিগকে তাহাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হইতেছে। তাহাদের উপর যুলুম নির্যাতন চালানো হইতেছে এবং তাহাদের উপর যাহারা যুলুম করে তাহাদের সাহায্য করা হইতেছে। আহমদীদের ধনসম্পদ যাহারা লুণ্ঠন করে তাহাদের হেফাযত করা হইতেছে এবং আহমদীদের জীবনের উপর হামলাকারীরা সরকারের ছত্রছায়ায় নিরাপদে ও শান্তিতে বাস করিতেছে। আহমদীদের পক্ষে সাক্ষ্যকে ছলে-বলে-কৌশলে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হইতেছে। কিন্তু বিরুদ্ধবাদী দলের কল্পিত সাক্ষ্যকেও গ্রহণ করিয়া লওয়া হইতেছে। মুদ্দাকথা, আহমদীদের উপর এই ধরনের বিপুল পরিমাণ চাপ বিদ্যমান রহিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ, আহমদীদিগকে চাকরী হইতে বঞ্চিত করা হইতেছে। আহমদী ছাত্রদিগকে শিক্ষার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইতেছে। দৈনন্দিন জীবনে এই ধরণের আরো বিভিন্ন চাপ এত বিপুলভাবে সৃষ্টি করা হইতেছে যে, তাহারা মনে করে যে, এইভাবে আহমদীরা অবশেষে অতিষ্ঠ হইয়া আহমদীয়াত পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়া যাইবে। কিন্তু যেমন কিনা সমগ্র জগদ্বাসী অবগত আছে এবং পাকিস্তানেও এখন এই ধারণা প্রবলভাবে সৃষ্টি হইতেছে যে, সরকারের এই সকল পন্থা সফল হয় নাই। বরং ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত ফল প্রকাশিত হইয়াছে। খোদার ফজলে আহমদীদের ঈমান এত দৃঢ়, শক্তিশালী ও তেজদীপ্ত হইয়াছে, তাহাদের স্বভাব চরিত্র এত উন্নত হইয়াছে এবং তাহাদের মধ্যে কোরবাণীর এত নূতন আকাংঙ্খা সৃষ্টি হইয়াছে যে, ইহার পূর্বে এইরূপ অবস্থা ও দৃঢ়তা দেখা যাইত না। এখন খোদার মেহেরবাণীতে আহমদীয়া জামা’তে এইরূপ সাহস, এইরূপ দৃঢ় সংকল্প এবং কোরবাণীর এইরূপ সুউচ্চ বাসনা সৃষ্টি হইয়াছে, যাহা পূর্বে দেখা যাইত না। অতএব ইহা আল্লাহতায়ালার বিশেষ আশীষ যে, এই দিক হইতেও সরকার তাহাদের বিরুদ্ধাচরণমূলক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হইয়াছে।
প্রথমোক্ত প্রচেষ্টার ব্যর্থতা সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয় যে, জামা’তের বন্ধুগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত সংবাদ হইতে জানা যায় যে, যে কোন অ-আহমদী পাকিস্তানী মুসলিম যখন মিখ্যার উপর দস্তখত করে তখন তাহার মধ্যে একটি ভীতি সঞ্চার হয়। তাহার হৃদয়ে এই প্রশ্ন উঠে যে, “যে ব্যক্তিকে আমি মিথ্যাবাদী বলিতেছি, আমি কি তাহার দাবী যাচাই করিয়া দেখিয়াছি? আমি কি তাহার দাবী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হইয়া এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি যে, তিনি মিথ্যাবাদী, না কি কেবলমাত্র নিজের পার্থিব স্বার্থের খাতিরে বাধ্য হইয়া এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে মিথ্যা অপবাদের উপর দস্তখত করিতে বাধ্য হইতেছি?”
এই সাধারণ অনুভূতি লোকদের মধ্যে সৃষ্টি হইতেছে। বস্তুতঃ মানুষের বিবেককে ঝাকুনী দেওয়ার জন্য যে উপকরণ আমরা সৃষ্টি করিতে পারি নাই, উহা আল্লাহর বিধান এইভাবে সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে। কেননা ইহার পুর্বে আহমদীয়াত সম্বন্ধে জানার অনাগ্রহ একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল এবং এই ব্যাপারে অজ্ঞতা ছিল সার্বজনীন। প্রকৃতপক্ষে যদিও সাধারণ মুসলমানেরা বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত তথাপি তাহাদের মধ্যে এইরূপ খুব কম লোক রহিয়াছেন, যাঁহারা জানেন তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস কি, ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও আদর্শগত ভিত্তি কি এবং ইসলামের ঐ ব্যবহারিক প্রয়োজন সমূহ কি, যেগুলি তাহাদের পূর্ণ করা উচিত। মোটকথা, এক ধরণের উদাসীন অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ফেরকার লোকেরা জীবন অতিবাহিত করিতেছিল এবং যেহেতু আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কোন জ্ঞান ছিল না, সেহেতু আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কোন আগ্রহ সৃষ্টি হইতেছিল না। তাহাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক ছিল, যাহারা জানিয়া ও বুঝিয়া আহমদীয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করিত। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি মৌলবীদের ভয়ে চাপের মুখে নীরব দর্শক সাজিয়া বসিয়াছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের প্রান্তে প্রান্তে আহমদীয়াতের চর্চা হইতেছে। এইরূপ এলাকাতেও হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের নাম পৌঁছিয়া গিয়াছে যেখানে কোন আহমদী কখনো কোন প্রকার প্রচারও করে নাই। বর্তমানে সেখানে কেবলমাত্র আহমদীয়াতের সঙ্গে লোকেরা পরিচিতই হইতেছে না বরং সেখানে মানুষের বিবেকে কাঁটার ঘাই দেওয়া হইয়াছে। কেননা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকেও এইরূপ একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হইয়াছে, যাহা তাহাদের জন্য সঙ্গত ছিল না। অতএব ইহার ফলশ্রুতিতে আহমদীয়াতকে বুঝার ও জানার ব্যাপারে খোদার ফজলে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি হইতেছে এবং ইহার নিদর্শনাবলী এখনই প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।
আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে আজকাল তৃতীয় প্রচেষ্টা বই পুস্তক ও লিটারেচার প্রকাশনার মাধ্যমে করা হইয়াছে এবং এইগুলি বিপুল পরিমাণে ছাপাইয়া বিতরণ করা হইয়াছে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় মিথ্যা অপবাদপূর্ণ লিফলেট দুতাবাসগুলির মাধ্যমে ছড়াইয়া হযরত ইমাম মাহদী মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হইয়াছে। ইহা বিশ্বজনীন আহমদীয়া জামাতের জন্য অশেষ মর্মপীড়ার কারণ হইয়াছে। বিশেষতঃ পাকিস্তানের আহমদীদের মর্মপীড়ার কারণ হইয়াছে, কারণ সেখানে দিবারাত্রি সংবাদপত্রেও এই চর্চাই চলিতেছে এবং বর্তমান সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করিয়া হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামকে গালিগালাজ দেওয়াইতেছে এবং সরকার নিজেও গালিগালাজ করিতেছে এবং এই ক্ষেত্রে কোন জাগতিক, মানবিক এবং নৈতিক আইন-কানুনের প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করা হইতেছে না।
বস্তুতঃ হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাষায় এমন সব কল্পিত গল্প-কাহিনী রচনা করিয়া ছাপান হইতেছে এবং সমগ্র বিশ্বে এইগুলি প্রচার করা হইতেছে যে, ইহা দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া যাইতে হয় এবং ইহাতে মানুষ অবাক হইয়া যায় যে, এই সভ্য যুগেও কি এইরূপ নৈতিক অধঃপতনের দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব? সরকারী পর্যায়ে নৈতিকতা-বিবর্জিত কথা প্রকাশিত হওয়াতো দূরের কথা, একজন সাধারণ মানুষের মধ্যেও যদি এই আচরণ দেখা যায় তাহা হইলে ইহাকে একটি ভয়ানক রকমের অধঃপতন বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। কোন সরকার যদি নাস্তিক সরকারও হয়, তবুও তাহারা দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিয়া থাকে। তাহাদের কথায় ও ভাষায় কিছু গাম্ভীর্য ও শালীনতা থাকে এবং তাহাদের প্রশাসনে কিছু পরিচ্ছন্নতা থাকে এবং কোন দলকে তাহারা যতই মন্দ ও দুশমন মনে করুক না কেন, তথাপি তাহারা জাগতিক ও আনুষ্ঠানিক রীতি-নীতিকে সর্বদা মানিয়া চলে। কিন্তু পৃথিবীতে একটি দেশই রহিয়াছে যেখানে এমন একটি অতুলনীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, তাহারা সকল নৈতিক রীতি-নীতিকে শিকায় তুলিয়া দিয়াছে এবং নৈতিক মূল্যবোধকে টুকরা টুকরা করিয়া নিক্ষেপ করিয়াছে। এই দেশটির নাম পাকিস্তান। এই দেশের সরকার আহরারদের এইরূপ একটি বাজারী ভাষা গ্রহণ করিয়াছে, যাহা কখনো লাহোরের মুচি দরজায় বা অমৃতসরের বাজার সমুহে শুনা যাইত, বা ঐ দিনগুলিতে শুনা যাইত যখন তাহারা কল্পিত “কাদিয়ান বিজয়ের” উদ্দেশ্যে হামলা করিত। এখন ঐ ভাষা পাকিস্তান সরকারের ভাষায় পরিণত হইয়াছে এবং এই সরকারের স্বভাব, তাহাদের আদর্শ এবং তাহাদের শাসন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আহরারদের রঙ্গে রঙ্গীন হইয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ সমগ্র বিশ্বে এই সরকারের এই রূপই প্রতিফলিত হইতেছে।
আজ আহমদীয়াতের উপর এবং হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের উপর মনগড়া অপবাদ আরোপ করা সরকারের একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়াইয়াছে। বস্তুতঃ এই ব্যাপারে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হইয়াছে। ইহার শিরোনাম হইল “কাদিয়ানীয়ত ইসলামের জন্য সঙ্গীন বিপদ।” ইহা পাকিস্তান সরকারের শ্বেত-পত্র। পাকিস্তান সরকার এই শ্বেতপত্রটি মহাসমারোহে ছাপাইয়া সমগ্র বিশ্বে বিপুলভাবে বিতরণ করিয়াছে। ইনশাআল্লাহ, আমি এই শ্বেত-পত্রে উত্থাপিত প্রত্যেকটি আপত্তির উত্তর প্রদান করিব। প্রথমে আমি এই বিরুদ্ধাচরণের পটভূমি বর্ণনা করিতে চাই।
এই বিরুদ্ধাচরণের পটভূমি সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয় যে, ইহা একটি রীতিমত গভীর ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। এই ব্যাপারে যে দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালানো হইতেছে, এই পটভূমি উহা প্রকাশ করিতেছে। বন্ধুগণ সাধারণতঃ ধারাবাহিকভাবে অবগত নহেন যে, কি হইতেছিল এবং এখন কি হইতেছে এবং ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর (তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমলের ঘটনাবলীর) সহিত বর্তমান ঘটনাবলীয় চেইনের কোন্ গ্রন্থিটি মিলিয়া যায়। বস্তুতঃ বর্তমান বিরুদ্ধাচরণের কিছু পটভূমিতো এইভাবে সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয় যে, জামা’তের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলিতেছে, উহা সুসংঘবদ্ধরূপে সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে এবং এখন বর্তমান আকারে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। অতঃপর এই পটভূমির আরো একটি দিক রহিয়াছে। ইহার সহিত বিদেশী শক্তির সম্পর্ক রহিয়াছে বা অন্য ধর্মের সম্পর্ক রহিয়াছে। বড় বড় ধনতান্ত্রিক শক্তি রহিয়াছে, যাহারা এই সকল প্রচেষ্টার পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছে। তাহাদের খুবই মন্দ অভিপ্রায় রহিয়াছে। ইহা রীতিমত একটি পরিকল্পনার আকারে আজ হইতে বহু বৎসর পূর্বে নীলনক্শার (Blue Print) রূপ ধারণ করিয়াছিল। বস্তুতঃ একটি পরিকল্পনার অধীনে কোটি কোটি টাকা আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে ব্যয় করা হইতেছে। নুন্যপক্ষে ২০ বৎসর হইতেতো আমিই অবগত আছি যে, কি হইতেছে। কেবলমাত্র ইহাই নহে বরং আমাদের বিরুদ্ধবাদী দলগুলিকে রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়া হইয়াছে এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অবস্থায় হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারেও ইহাদিগকে মাধ্যম বানানো হইয়াছে। ইহার অনেক বিস্তারিত দিক রহিয়াছে। যদি সুযোগ হয় বা প্রয়োজন বোধ করি, তাহা হইলে পরবর্তীতে এইগুলি সমন্ধে আলোচনা করিব।
অতএব যেমন কিনা আমি বলিয়াছি, আমাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্তমান অভিযান ও আন্দোলনের সহিত ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর বুনিয়াদ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ১৯৭৩ সনের আইনের মধ্যে পত্তন করা হইয়াছিল। বস্তুতঃ আইনে কোন কোন ধারা ও দফা সংযোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যাহাতে ইহার ফলশ্রুতিতে আহমদীয়া জামা’তকে অন্যান্য পাকিস্তানী নাগরিক হইতে একটি পৃথক এবং তুলনামূলকভাবে একটি নগণ্য মর্যাদা দেওয়া যায়। আমি ১৯৭৩ সনের আইন প্রবর্তন করার সময় এই বিপদকে অনুধাবন করিয়া হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস রাঃ-এর খেদমতে নিবেদন করিয়াছিলাম। অবশ্য ইহার পরে যেভাবেই সম্ভব ছিল আহমদীয়া জামাত বিভিন্ন পর্যায়ে এই বিরুদ্ধাচরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাবকে দূর করার চেষ্টা করিয়া আসিতেছিল। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকালীন সময়ে এই ধারণা বড়ই দৃঢ়রূপে সৃষ্টি হইল যে, ইহা কেবলমাত্র এখানকার সরকার করাইতেছে না, বরং ইহা একটি সুদীর্ঘ পরিকল্পনার চেইনের গ্রন্থি এবং এই ব্যাপারটি সম্মুখে অগ্রসর হইবে। যাহা হউক, ১৯৭৪ সনের আশংকা সম্পর্ণরূপে দেদীপ্যমান হইয়া বর্তমানে আমাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
১৯৭৪ সনে পাকিস্তানের অদৃষ্টে যে সরকার জুটিয়াছিল, উহার মধ্যে ও বর্তমান সরকারের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রহিয়াছে। ঐ সরকারের লজ্জা- শরমের বালাই ছিল। নিজেদের দেশের লোকদের নিকটও তাহাদের লজ্জা-শরম ছিল এবং বহির্বিশ্বের সরকারগুলির নিকটও তাহাদের লজ্জা বোধ ছিল, যদিও আহমদীয়াতের শত্রুতার ক্ষেত্রে তাহারা কম যায় নাই। অর্থাৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এবং জামা’তের ভিতের উপর সঙ্গীন আক্রমণ করার ক্ষেত্রে উভয় সরকারের মধ্যে এই দুশমনী এক ও অভিন্ন। তবুও ভুট্টো সাহেবের সময়কার সরকার এবং বর্তমান সরকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রহিয়াছে। ভুট্টো সাহেব একজন জননেতা ছিলেন এবং তিনি জনগণকে ভালবাসিতেন বলিয়াও দাবী করিতেন। তিনি চাহিতেন যে, তিনি নিজ দেশের জনগণের প্রিয় নেতা হইয়া থাকিবেন এবং তাহারা যেন এই ধারণা করে যে, অপরিহার্য প্রয়োজন ব্যতীত ধান্ধাবাজী করিয়া এবং একনায়কত্বের পন্থা অবলম্বন করিয়া তিনি দেশ শাসন করার অভিলাষী। বস্তুতঃ তিনি আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে ইহাকে একটি আদালতের রূপ দিলেন এবং জাতীয় সংসদে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। ইহাতে আহমদীয়া জামা’তকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে বহির্জগত সমালোচনা করার সুযোগ না পায়। প্রকৃতপক্ষে এইভাবে তিনি বহির্জগতে স্বীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিতে চাহিতেছিলেন। বহির্জগতেও তাঁহার আকাঙ্খা খুব প্রবল ছিল। তিনি কেবলমাত্র পাকিস্তানের নেতৃত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং তিনি স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তি আশ-পাশের এলাকাতেও বিস্তৃত করিতে চাহিতেছিলেন। যেভাবে পণ্ডিত নেহেরু প্রাচ্যের নেতা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন, অনুরূপভাবে ভুট্টো সাহেব প্রাচ্যের নেতা হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করিতেন। তিনি চাহিতেন যে, কেবলমাত্র পাকিস্তানের নেতা হিসাবেই নয়, বরং তিনি প্রাচ্যের এক মহান নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করিবেন এবং রাজনীতির ময়দানে জগদ্বাসীর নিকট স্বীয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করিবেন। অতএব এই কারণে এবং তদুপরি যেহেতু তাঁহার চোখে বহির্জগতের নিকট লাজ-লজ্জার বালাই ছিল, কাজেই তিনি চাহিতেন যে, দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাহিরে আহমদীয়া জামা’তের বিষয়টি এইরূপে উপস্থাপন করিতে হইবে, যাহাতে সকলে মনে করে যে তিনি সম্পূর্ণরূপে অসহায় হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং বিষয়টি তাহার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এতদসত্বেও তিনি জনগণের চাপ সরাসরি গ্রহণ করেন নাই, বরং আহমদীয়া জামা’তের প্রধান এবং তাঁহার সহিত কয়েকজন ব্যক্তিকে ডাকিয়া একটি সুযোগ দিলেন, যাহাতে তাহারা নিজেদের বক্তব্য পেশ করিতে পারেন। বস্তুতঃ দীর্য দিন ধরিয়া জাতীয় সংসদ এই বিষয়ে সময় ব্যয় করিল। অবশেষে জাতীয় সংসদের বাহানা ও অজুহাত ভুট্টো সাহেবের হস্তগত হইল এবং তিনি এই কথা বলিয়া দিলেন যে, আমি এখন কি করিতে পারি?
কিন্তু বর্তমান সরকারের এই লাজ-শরমের বালাই নাই। কারণ না তাহারা জনগণের সরকার, না তাহারা বহির্জগতে জনমতের পরোয়া করে। একজন স্বৈরাচারী একনায়ক, একনায়কই হইয়া থাকে। অতএব বাহ্যতঃ সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, একনায়কের ইহা অনিবার্য বৈশিষ্ট যে, যাহা কিছুই হউক না কেন, এবং জগদ্বাসী যাহা কিছুই বলুক না কেন, সে উহার পরোয়া করিবে না। ইহা একনায়কের মজ্জাগত বৈশিষ্ট যে, সে চেষ্টা করিয়া দেখে মোফতে জগদ্বাসীর হৃদয় জয় করা যায় কিনা। যদি জয় করা যায় ভাল কথা। কিন্তু যদি না যায়, তবুও একনায়কতো পিছে হটে না। সুতরাং একনায়কের মধ্যে যে বেপরোয়া ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, উহা আমাদের বিরুদ্ধে তাহার বর্তমান অভিযানেও সম্পূর্ণরূপে উলঙ্গ হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে।
১৯৭৪ সনে সরকার নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আহমদীয়া জামা’তকে সুযোগতো দিয়াছিল এবং চৌদ্দ দিন ধরিয়া জাতীয় সংসদে প্রশ্নউত্তর চলিয়াছিল। জামা’ত নিজেদের বক্তব্য লিখিতভাবেও পেশ করিয়াছিল। কিন্তু ঐ সরকার বড়ই হুশিয়ার এবং চতুর সরকার ছিল। তাহারা জাতীয় সংসদ চলাকালীন সময়েই ইহা ধারণা করিয়া লইয়াছিল যে, যদি এই সকল কথা জনসাধারণ্যে প্রকাশ হইয়া পড়ে এবং প্রশ্ন-উত্তর সম্বলিত সংসদের কার্য বিবরণী এবং ইহার রোয়েদাদ জগতের সম্মুখে পেশ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। বরং বিপরীত ফল ফলিতে পারে এবং খুবই সম্ভব যে, জগদ্বাসী সপ্রসংশভাবে এই কথা স্বীকার করার পরিবর্তে যে, জামা’তকে সব ধরনের অধিকার দান করার পর একটি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহারা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা ভাবিবে এবং বলিবে যে, জামা’ততো এই কর্যক্রমের দরুন খুবই অধিক মজলুম প্রমাণিত হইয়াছে। কেননা আহমদীয়া জামাত তাহাদের বক্তব্যের সমর্থনে এত মজবুত ও শক্তিশালী দলিল-প্রমাণাদি উপস্থাপন করিয়াছে যে, ইহার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলাই যায় না যে তাহারা মুসলমান নয়। বস্তুতঃ তখনকার সরকার এই বিপদ এইভাবে প্রতিরোধ করিয়াছিল যে, আইনের বলে এবং আদেশক্রমে জামা’তকে নিষেধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, জাতীয় সংসদে যাহা কিছু কার্যক্রম গৃহীত হইতেছে ইহার কোন নোট বা রেকর্ড তাহারা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারে না এবং এই সিদ্ধ গ্রহণ করা হইয়াছিল যে, সরকার এই কার্যক্রমকে জগদ্বাসীর নিকট প্রকাশিত হইতে দিবে না।
এই কার্যক্রমের ফলাফল কি হইয়াছিল? তাহা এই ঘটনা হইতে জানা যায় যে, একদা জাতীয় সংসদের একজন সদস্যকে কোন এক উপলক্ষে এই প্রশ্ন করা হইয়াছিল যে, আপনারা এই কার্যক্রমকে কেন প্রকাশ করিতেছেন না? জাতীয় সংসদ আপনাদের বর্ণনানুযায়ী সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়াছে যে, আহমদীয়া জামাত ভ্রান্ত এবং ধর্ম-বিশ্বাসের দিক হইতে তাহাদের সহিত ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। তাহা হইলে সংসদের কার্যক্রম ছাপাইয়া তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস জগদ্বাসীর নিকট প্রকাশ করিয়া দিন। তিনি হাসিয়া উত্তর দিলেন, “তুমি ছাপানোর কথা বলিতেছ? শোকর কর যে আমরা ছাপাই নাই। আমরা ইহা ছাপাইয়া দিলে পাকিস্তানের অর্ধেক লোক আহমদী হইয়া যাইবে।” আমি মনে করি যে, এইরূপ বলা তাহার পক্ষে বিনয় ছিল। যদি পাকিস্তানের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিকট আহমদীয়া জামা’তের বক্তব্য প্রকৃতপক্ষেই পৌঁছিয়া যায়, তাহা হইলে কোন কারণই নাই যে, কিছু হতভাগ্য ব্যক্তি ব্যতীত (যাহারা সদা সর্বদাই বঞ্চিত থাকিয়া যায়) পাকিস্তানের সকল মানুষ আহমদী হইয়া যাইবে না। উক্ত হতভাগ্যদের অদৃষ্টে হেদায়েত থাকে না। কেননা وهي يضلل فلا هادي له যাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা হেদায়েত দিতে চাহেন না, পৃথিবীর কোন শক্তি তাহাদিগকে হেদায়েত দিতে পারে না। সুতরাং এইরূপ ব্যতিক্রমতো বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু আমি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্বন্ধে এই সুধারণা পোষণ করি যে, যদি তাহাদের নিকট, বিশেষভাবে বর্তমান যুগের বংশধরদের নিকট, যাহারা তুলনামূলকভাবে অধিক যুক্তিবাদী এবং অনুকরণে ততখানি বিশ্বাসী নয় যতখানি প্রাচীন লোকেরা বিশ্বাসী ছিলেন, আহমদীয়া জামা’তের বক্তব্য সঠিকভাবে পৌঁছিয়া যায় তাহা হইলে অনিবার্যরূপে তাহাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল খোদাতায়ালার অনুগ্রহে আহমদী মুসলিম হইয়া যাইবে। বস্তুতঃ বর্তমান সরকার তাহাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা এইভাবে করিয়াছে যে, তাহারা আহমদীয়া জামা’তের উপর একতরফা হামলাতো করিয়াছে, কিন্তু উত্তরের অনুমতিই দেয় নাই এবং আত্ম-পক্ষ সমর্থনের সুযোগই সৃষ্টি হইতে দেয় নাই। বস্তুতঃ জামা’তের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার পূর্বেই সরকার এইরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করিল যে, জামা’তের ঐ সকল লিটারেচার ও বই পুস্তক বাজেয়াপ্ত করিয়া লইল, যেগুলির মধ্যে তাহাদের ভবিষ্যতের আক্রমণের উত্তর মওজুদ রহিয়াছে। সরকারের পলিসিতে এই যে স্ব-বিরোধ দেখিতে পাওয়া যায় কিন্তু ইহার মধ্যে বাহ্যতঃ একটি নির্বুদ্ধিতার ব্যাপারও দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার মধ্যে নির্বুদ্ধিতার চাইতে অধিক রহিয়াছে ধূর্ততা ও চাতুরী। একদিকে ইহা বলা হইতেছে যে, হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের লিটারেচার এইজন্য বাজেয়াপ্ত করা হইতেছে যে, ইহাতে পাকিস্তানের লোকদের মনঃকষ্ট হয় এবং অন্যদিকে এইগুলির মধ্য হইতে কেবলমাত্র ঐ সকল কথাই ছাপানো হইতেছে, যেইগুলির দ্বারা তাহাদের মনঃকষ্ট হইয়া থাকে। ইহা কিরূপ নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ব্যাপার! তোমরা বলিতেছ এই কথা যে, হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকাদি তোমরা এইজন্য বাজেয়াপ্ত করিতেছ যে উহাদের দ্বারা মুসলমান জনসাধারণের বিশেষভাবে পাকিস্তানের জনগণের মনঃকষ্ট হয়। কিন্তু এই মনঃকষ্টের প্রতিকার এইভাবে করা হইয়াছে যে, ঐ অংশ যাহার দ্বারা মনঃকষ্ট হয় না, উহা প্রকাশ করাতো আইনগতভাবে বন্ধ কর দিয়াছ এবং যাহার দ্বারা তোমাদের ধারণানুযায়ী মনঃকষ্ট হয়, উহাকে সরকারী খরচে বিপুল পরিমাণে ছাপাইয়া দিতেছ। অতএব বাহ্যিকভাবে তো ইহা একটি স্ব-বিরোধ। কিন্তু এই স্ববিরোধ একটি চাতুরীর জন্য করা হইয়াছে। তাহারা এইরূপ জালেমানা এবং নাপাক হামলা অবশ্য অবশ্যই করিত। কেননা হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকাদিতেই আপত্তিসমূহের উত্তর মওজুদ রহিয়াছে এবং প্রত্যেক সংব্যক্তি, যিনি এইগুলি অধ্যয়ন করেন এবং ইহাদের পূর্বাপর সম্পর্ক দেখেন তাঁহারা দেখিবেন যে আপত্তিগুলি নিজে নিজেই দূর হইয়া যায়। বস্তুতঃ জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের সময়েও ইহাই হইতেছিল। হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস রাঃ আমাকেও তাঁহার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ দান করিয়াছিলেন । সংসদের কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে আমি এবং আমার অন্যান্য সঙ্গীরা এই ব্যাপারটি খুবই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করিয়াছি যে, যখনই হহরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকের উপর আক্রমণ করা হইয়াছে তখনই হযরত খলিফাতুল মসীহ সালেস রাঃ এই সূত্রের কিছু পুর্বের অংশ হইতে এবং কিছু পরের অংশ হইতে পড়িয়া শুনাইয়া দিতেন এবং ইহার পর কোন উত্তরের প্রয়োজনই থাকিত না। শ্রবণকারীদের চেহারায় প্রশান্তি আসিয়া যাইত। কেননা তাহারা বুঝিতে পারিত যে এই আক্রমণ কল্পিত এবং ইহা কাট-ছাট উদ্ধৃতির ফলশ্রুতি এবং সত্যের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। কোন কোন জায়গায় যখন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়িত, তখন তিনি ব্যাখ্যাও দান করিতেন। কিন্তু হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের রচনাগুলির মধ্যে যথেষ্ট উত্তর রহিয়াছে। যদি পূর্বাপর সম্পর্ক না রাখিয়া কেবলমাত্র একটি অংশকে পৃথক করিয়া ভ্রান্তভাবে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উত্থাপন করা হয়, তাহা হইলে ইহাতে মনঃকষ্ট হইতে পারে। কিন্তু তাঁহার রচনার উদ্দেশ্য ইহা নহে। হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালাম ঐ কধা বলিতে চাহেন নাই, যাহা তাঁহার প্রতি আরোপ করা হইতেছে। কিন্তু ইহাকে মনঃকষ্ট বানানো হইয়াছে, অথবা ইহাকে নিজেদের পক্ষ হইতে বিকৃত করিয়া ছাপানো হইয়াছে। সুতরাং ইহাই ছিল ঐ সরকারের ক্রিয়া-কর্মের কৌশল। বস্তুতঃ ইহার ফলশ্রুতিতে এই ঘটনার পূর্বেই বই-পুস্তকাদি বাজেয়াপ্ত করিতে আরম্ভ করা হইল। ইহাতেও তাহারা ক্ষান্ত হইল না। প্রেসও বাজেয়াপ্ত করা হইল এবং সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকাও বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।
ইহা হইল ভীরুতা। ইহা সদা-সর্বদা দুর্বলতার লক্ষণ হইয়া থাকে। এইভাবে তাহারা নিজেদের পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়াছে। পৃথিবীর কোন শক্তি, যাহারা যুক্তি-প্রমাণে শক্তিশালী তাহারা অস্ত্র উঠাইয়া নেয়না এবং অন্যের বক্তব্য উপস্থাপনের পথে আইনগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া দেয় না। ইহা বিবেক- বুদ্ধির পরিপন্থী এবং তাহাদের নিজেদের স্বার্থেরও পরিপন্থী। এই জন্য এইক্ষেত্রে সকল আইনগত প্রচেষ্টা কাজে লাগানো হইতেছে যে, যে-কোন প্রকারে আহমদীয়া জামা’তের উপর আক্রমণতো করিয়া দেওয়া হউক, কিন্তু আহমদীয়া জামা’তকে উত্তরের সুযোগ দেওয়া হইবে না। ইহা জঘন্য ভীরুতা ও কাপুরুষতার লক্ষণ এবং পরাজয়ের শেষ স্বীকৃতি যে, দলিল-প্রমাণের ময়দানে তাহারা শুন্য ও রিক্ত। বস্তুতঃ একদিকে আহমদীয়া জামা’তের সদস্য সংখ্যা এত কম বলিয়া ঘোষণা করা হইতেছে যে তাহাদের সংখ্যা সত্তর-আশি হাজারের অধিক নয় এবং অন্য দিকে এই প্রোপাগাণ্ডা করা হইতেছে যে, আহমদীয়াত মুসলিম জাহানের জন্য বিপদ এবং এইরূপ একটি বিপদ ইতিপূর্বে মুসলিম জাহানে কখনো দেখা দেয় নাই। তাহারা প্রোপাগাণ্ডা করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, বরং তাহারা আহমদীয়াতের লিটারেচারও বাজেয়াপ্ত করিয়াছে। এই সকল কাজ সম্বন্ধে বড়ই গর্বের সহিত বলা হইতেছে যে, ‘দেখিয়াছ, এই বিপদ আমরা দূর করিয়া দিয়াছি’।
বস্তুতঃ পূর্ববর্তী সরকারের কাজের তুলনা করিয়া বর্তমান সরকার তাহাদের শ্বেতপত্রে লিখিয়াছে যে, যথার্থভাবেই পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদের ইহা একটি বড় কীর্ত্তি (অর্থাৎ আহমদীদিগকে সংখ্যালঘু অমুসলমান ঘোষণা করা - অনুবাদক)। কিন্তু এতদসত্ত্বেও উক্ত জাতীয় সংসদকে বর্তমান সরকারকে রহিত করিতে হইয়াছিল এবং উহার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হইয়াছিল যে উহার সকল সদস্য (ইল্লা মাশাআল্লাহ) চরিত্রহীণ ও দুস্কৃতিকারী। ইহার পরেও বৃর্তমান সরকার উক্ত জাতীয় সংসদের কীর্ত্তিকে স্বীকার করিয়াছে। যেহেতু ইহাদের চিন্তা ভাবনা তাহাদের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ এবং উভয়ের ধরণ করণ এক ও অভিন্ন, সেজন্য তাহাদের কীর্ত্তিকেতো স্বীকার করিতে হইবে। কেবল স্বীকার করিয়া নেওয়ার ব্যাপারই নয় বরং উক্ত সংসদের ইহা একটি বড়ই মহান কীর্তিও বটে, যাহার দ্বারা দৃশ্যতঃ একশত বৎসরের সমস্যা সমাধান করিয়া দেওয়া হইয়াছে (ভুট্টো সাহেব মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আহমদীদিগকে অমুসলমান ঘোষণা করিয়া তিনি একশত বৎসরের একটি পুরাতন সমস্যা সমাধান করিয়া দিয়াছেন - অনুবাদক)। কিন্তু তাহারা এই একশত বৎসরের সমস্যা সম্পূর্ণরূপে সমাধান করিতে পারে নাই। কেননা, এই ব্যাপারে যে সকল আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল, তাহা ইহাদের (অর্থাৎ বর্তমান জিয়াউল হক সরকারের) অদৃষ্টে লিপিবদ্ধ ছিল। বস্তুতঃ বর্তমান সরকার ঐ সকল আইন প্রণয়ন করিয়া আহমদীয়া জামা’তকে চিরকালের জন্য অচল করিয়া দিয়াছে এবং এখন আর মুসলিম জাহানের জন্য কোন বিপদ রহিল না।
প্রশ্ন এই যে, এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হইয়াছে এবং মুসলমানদিগকে কিভাবে এই বিপদ হইতে রক্ষা করা হইয়াছে? এই সম্বন্ধে সরকারী শ্বেতপত্রের পরিশেষে লেখা হইয়াছে যে, ‘আমরা সমস্যা এইভাবে সমাধান করিয়াছি যে একটি আদেশের বলে আহমদীয়া জামাতের তরফ হইতে আযান দেওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং তাহাদের নিজদিগকে মুসলমান বলা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এখন তাহারা কলেমা পড়িতে ও লিখিতে পারে না, তাহাদের মসজিদকে মসজিদ বলিতে পারে না, তাহারা মুসলমানের ধরণ-করণ অনুসরণ করিতে পারে না এবং তাহারা কুরআন করীমের আদেশ নির্দেশের উপর আমল করিতে পারে না। দেখ, এখন আমরা কত সন্তুষ্ট। আমরা কত বড় সাংঘাতিক সমস্যা সমাধান করিয়া দিয়াছি।’ অবশেষে তাহারা সমস্যা সমাধানের এই পন্থা উদ্ভাবন করিয়াছে। কিন্তু বোকামীরও একটা সীমা আছে। অর্থাৎ চালাকীর মধ্যেও কোন কোন সময় বোকামী নিহিত থাকে এবং ইহার কারণ এই যে, যে ব্যক্তির নিকট সত্য থাকে না, সে চালাকীর মাধ্যমে নিজ উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করে এবং সততা না থাকার দরুণ চালাকীর মধ্যে একটি বোকামী ঢুকিয়া পড়ে এবং তাহা নিশ্চয়ই নিজেকে প্রকাশ করে। এই জন্য এই আভ্যন্তরীণ স্ব-বিরোধ এবং এই বোকামীসমূহ - এই সব কিছুই একটি মিথ্যা চালাকীর ফল। নতুবা সৎ-বুদ্ধির দরুণ এই স্ব-বিরোধ সৃষ্টি হইতে পারে না।
সুতরাং বর্তমান সরকার এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছে এবং নিজদিগকে ভুট্টো সরকারের চাইতে অধিক চালাক মনে করিয়াছে এবং, বলিয়াছে যে তাহাদের তো ইহাই বোকামী ছিল যে, তাহারা জাতীয় সংসদে আহমদীদিগকে প্রশ্ন-উত্তরের সুযোগ দিয়াছিল। বস্তুতঃ শ্বেত-পত্রে এই কথাও লেখা হইয়াছে যে, প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবী করে তাহার সহিত আলাপ-আলোচনা করাই উচিত নয় এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে তাহাকে পরাস্ত করার চেষ্টা করাই বোকামী। এই জন্য তাহারা যে প্রতিকার উদ্ভাবন করিয়াছে, তাহা বাতীত আর কোন প্রতিকার নাই। কিন্তু এতদসত্বেও তাহারা সমগ্র বিশ্বে মিথ্যা অপবাদ রটনার জালেমানা কার্যকলাপ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। কুরআন করীম হইতে জানা যায় যে, জালিমদের প্রচেষ্টা তাহাদের কোন উপকারে আসে না। বলা হইয়াছে,
فَلَمَّآ أَضَآءَتْ مَا حَوْلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِى ظُلُمَـٰتٍۢ لَّا يُبْصِرُونَ
এইরূপ ব্যক্তি, যাহারা মুনাফিক, তাহারা দাবী করে একটা কিছু, কিন্তু আমল করে অন্য কিছু। তাহারা জ্ঞানের কথা বলে, কিন্তু জ্ঞানের সাথে সাথে নেহায়েত বোকামীপূর্ণ কাজও করিতে থাকে। তাহাদের প্রচেষ্টা কখনো তাহাদের কাজে আসে না। তাহারা আগুনতো নিশ্চয়ই লাগাইয়া দেয়, কিন্তু তাহারা আগুন হইতে যে তামাশা দেখিতে চায়, খোদাতায়ালা তাহাদিগকে ঐ তামাশা হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকেন। তিনি তাহাদের অন্তর্দৃষ্টির জ্যোতিঃ ছিনাইয়া নেন। আগুনতো তাহারা জ্বালানোর জন্য লাগাইয়া থাকে। কিন্তু ঐ আগুন তাহাদিগকে অন্তর্দৃষ্টির জ্যোতিঃ হইতেও বঞ্চিত করিয়া দেয় এবং অতঃপর তাহাদিগক এইরূপ অন্ধকারে ছাড়িয়া যায় যে, তাহারা কিছুই দেখিতে পারে না। বস্তুতঃ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধাচরণমূলক প্রচেষ্টাও কাৰ্য্যতঃ আহমদীয়া জামাতের ফায়দা ও লাভের কারণ হইয়াছে এবং আগামীতেও ইনশাআল্লাহ ফায়দার কারণ হইতে থাকিবে।
বর্তমানে আহমদীয়া জামাত এইরূপ যুগের মধ্য দিয়া অতিক্রম করিতেছে, যাহার সম্বন্ধে কুরআন করীমে আল্লাহতায়ালা বলেনঃ- عسى أن تكرهوا شيئا وهو خير لكم কোন কোন সময় এইরূপ হইয়া থাকে এবং তোমাদের সঙ্গেও এইরূপ হইবে যে, তোমরা কোন একটা বস্তুকে অপছন্দ কর, তোমাদের মনে কষ্ট হয় এবং তোমাদের ব্যথা লাগে, কিন্তু وهو خير لكم উহা তোমাদের জন্য কল্যাণের কারণ হয়। তোমরা শিশুদিগকে তিক্ত ঔষধ খাওয়াইয়া থাক, তাহাদিগকে ইঞ্জেকশান দিয়া থাক, তাহারা চিৎকার করিতে থাকে, তোমরা তাহাদের হাত ধরিয়া রাখ, এবং তাহাদের কোন কথাই শুন না। শিশুদের সহিত এই আচরণ এই জন্য করা হইয়া থাকে যে, উহার মধ্যে তাহাদের কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে। অনুরূপভাবে আল্লাহতায়ালা বলেন যে, আমরাও তোমাদের জন্য কোন কোন সময় এইরূপ তদবীর করিব, যাহাতে তোমাদের যারপরনাই কষ্ট হইবে। কিন্তু অবশেষে উহা তোমাদের জন্য কল্যাণের কারণ হইবে। বস্তুতঃ আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে পাকিস্তান সরকার সমগ্র বিশ্বে যে লিটারেচার ও পুস্তকাদি প্রকাশ করিয়াছে, ইহার একটি বড় উপকার এই হইয়াছে যে সারা বিশ্বে আহমদীয়া জামাত
মিথ্যা অপবাদ রটনার দ্বিতীয় পন্থা এইভাবে গ্রহণ করা হইতেছে যে, আহমদীদিগকে তাহাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হইতেছে। তাহাদের উপর যুলুম নির্যাতন চালানো হইতেছে এবং তাহাদের উপর যাহারা যুলুম করে তাহাদের সাহায্য করা হইতেছে। আহমদীদের ধনসম্পদ যাহারা লুণ্ঠন করে তাহাদের হেফাযত করা হইতেছে এবং আহমদীদের জীবনের উপর হামলাকারীরা সরকারের ছত্রছায়ায় নিরাপদে ও শান্তিতে বাস করিতেছে। আহমদীদের পক্ষে সাক্ষ্যকে ছলে-বলে-কৌশলে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হইতেছে। কিন্তু বিরুদ্ধবাদী দলের কল্পিত সাক্ষ্যকেও গ্রহণ করিয়া লওয়া হইতেছে। মুদ্দাকথা, আহমদীদের উপর এই ধরনের বিপুল পরিমাণ চাপ বিদ্যমান রহিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ, আহমদীদিগকে চাকরী হইতে বঞ্চিত করা হইতেছে। আহমদী ছাত্রদিগকে শিক্ষার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইতেছে। দৈনন্দিন জীবনে এই ধরণের আরো বিভিন্ন চাপ এত বিপুলভাবে সৃষ্টি করা হইতেছে যে, তাহারা মনে করে যে, এইভাবে আহমদীরা অবশেষে অতিষ্ঠ হইয়া আহমদীয়াত পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়া যাইবে। কিন্তু যেমন কিনা সমগ্র জগদ্বাসী অবগত আছে এবং পাকিস্তানেও এখন এই ধারণা প্রবলভাবে সৃষ্টি হইতেছে যে, সরকারের এই সকল পন্থা সফল হয় নাই। বরং ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত ফল প্রকাশিত হইয়াছে। খোদার ফজলে আহমদীদের ঈমান এত দৃঢ়, শক্তিশালী ও তেজদীপ্ত হইয়াছে, তাহাদের স্বভাব চরিত্র এত উন্নত হইয়াছে এবং তাহাদের মধ্যে কোরবাণীর এত নূতন আকাংঙ্খা সৃষ্টি হইয়াছে যে, ইহার পূর্বে এইরূপ অবস্থা ও দৃঢ়তা দেখা যাইত না। এখন খোদার মেহেরবাণীতে আহমদীয়া জামা’তে এইরূপ সাহস, এইরূপ দৃঢ় সংকল্প এবং কোরবাণীর এইরূপ সুউচ্চ বাসনা সৃষ্টি হইয়াছে, যাহা পূর্বে দেখা যাইত না। অতএব ইহা আল্লাহতায়ালার বিশেষ আশীষ যে, এই দিক হইতেও সরকার তাহাদের বিরুদ্ধাচরণমূলক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হইয়াছে।
প্রথমোক্ত প্রচেষ্টার ব্যর্থতা সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয় যে, জামা’তের বন্ধুগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত সংবাদ হইতে জানা যায় যে, যে কোন অ-আহমদী পাকিস্তানী মুসলিম যখন মিখ্যার উপর দস্তখত করে তখন তাহার মধ্যে একটি ভীতি সঞ্চার হয়। তাহার হৃদয়ে এই প্রশ্ন উঠে যে, “যে ব্যক্তিকে আমি মিথ্যাবাদী বলিতেছি, আমি কি তাহার দাবী যাচাই করিয়া দেখিয়াছি? আমি কি তাহার দাবী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হইয়া এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি যে, তিনি মিথ্যাবাদী, না কি কেবলমাত্র নিজের পার্থিব স্বার্থের খাতিরে বাধ্য হইয়া এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে মিথ্যা অপবাদের উপর দস্তখত করিতে বাধ্য হইতেছি?”
এই সাধারণ অনুভূতি লোকদের মধ্যে সৃষ্টি হইতেছে। বস্তুতঃ মানুষের বিবেককে ঝাকুনী দেওয়ার জন্য যে উপকরণ আমরা সৃষ্টি করিতে পারি নাই, উহা আল্লাহর বিধান এইভাবে সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে। কেননা ইহার পুর্বে আহমদীয়াত সম্বন্ধে জানার অনাগ্রহ একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল এবং এই ব্যাপারে অজ্ঞতা ছিল সার্বজনীন। প্রকৃতপক্ষে যদিও সাধারণ মুসলমানেরা বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত তথাপি তাহাদের মধ্যে এইরূপ খুব কম লোক রহিয়াছেন, যাঁহারা জানেন তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস কি, ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও আদর্শগত ভিত্তি কি এবং ইসলামের ঐ ব্যবহারিক প্রয়োজন সমূহ কি, যেগুলি তাহাদের পূর্ণ করা উচিত। মোটকথা, এক ধরণের উদাসীন অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ফেরকার লোকেরা জীবন অতিবাহিত করিতেছিল এবং যেহেতু আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কোন জ্ঞান ছিল না, সেহেতু আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কোন আগ্রহ সৃষ্টি হইতেছিল না। তাহাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক ছিল, যাহারা জানিয়া ও বুঝিয়া আহমদীয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করিত। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি মৌলবীদের ভয়ে চাপের মুখে নীরব দর্শক সাজিয়া বসিয়াছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের প্রান্তে প্রান্তে আহমদীয়াতের চর্চা হইতেছে। এইরূপ এলাকাতেও হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের নাম পৌঁছিয়া গিয়াছে যেখানে কোন আহমদী কখনো কোন প্রকার প্রচারও করে নাই। বর্তমানে সেখানে কেবলমাত্র আহমদীয়াতের সঙ্গে লোকেরা পরিচিতই হইতেছে না বরং সেখানে মানুষের বিবেকে কাঁটার ঘাই দেওয়া হইয়াছে। কেননা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকেও এইরূপ একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হইয়াছে, যাহা তাহাদের জন্য সঙ্গত ছিল না। অতএব ইহার ফলশ্রুতিতে আহমদীয়াতকে বুঝার ও জানার ব্যাপারে খোদার ফজলে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি হইতেছে এবং ইহার নিদর্শনাবলী এখনই প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।
আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে আজকাল তৃতীয় প্রচেষ্টা বই পুস্তক ও লিটারেচার প্রকাশনার মাধ্যমে করা হইয়াছে এবং এইগুলি বিপুল পরিমাণে ছাপাইয়া বিতরণ করা হইয়াছে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় মিথ্যা অপবাদপূর্ণ লিফলেট দুতাবাসগুলির মাধ্যমে ছড়াইয়া হযরত ইমাম মাহদী মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হইয়াছে। ইহা বিশ্বজনীন আহমদীয়া জামাতের জন্য অশেষ মর্মপীড়ার কারণ হইয়াছে। বিশেষতঃ পাকিস্তানের আহমদীদের মর্মপীড়ার কারণ হইয়াছে, কারণ সেখানে দিবারাত্রি সংবাদপত্রেও এই চর্চাই চলিতেছে এবং বর্তমান সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করিয়া হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামকে গালিগালাজ দেওয়াইতেছে এবং সরকার নিজেও গালিগালাজ করিতেছে এবং এই ক্ষেত্রে কোন জাগতিক, মানবিক এবং নৈতিক আইন-কানুনের প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করা হইতেছে না।
বস্তুতঃ হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাষায় এমন সব কল্পিত গল্প-কাহিনী রচনা করিয়া ছাপান হইতেছে এবং সমগ্র বিশ্বে এইগুলি প্রচার করা হইতেছে যে, ইহা দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া যাইতে হয় এবং ইহাতে মানুষ অবাক হইয়া যায় যে, এই সভ্য যুগেও কি এইরূপ নৈতিক অধঃপতনের দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব? সরকারী পর্যায়ে নৈতিকতা-বিবর্জিত কথা প্রকাশিত হওয়াতো দূরের কথা, একজন সাধারণ মানুষের মধ্যেও যদি এই আচরণ দেখা যায় তাহা হইলে ইহাকে একটি ভয়ানক রকমের অধঃপতন বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। কোন সরকার যদি নাস্তিক সরকারও হয়, তবুও তাহারা দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিয়া থাকে। তাহাদের কথায় ও ভাষায় কিছু গাম্ভীর্য ও শালীনতা থাকে এবং তাহাদের প্রশাসনে কিছু পরিচ্ছন্নতা থাকে এবং কোন দলকে তাহারা যতই মন্দ ও দুশমন মনে করুক না কেন, তথাপি তাহারা জাগতিক ও আনুষ্ঠানিক রীতি-নীতিকে সর্বদা মানিয়া চলে। কিন্তু পৃথিবীতে একটি দেশই রহিয়াছে যেখানে এমন একটি অতুলনীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, তাহারা সকল নৈতিক রীতি-নীতিকে শিকায় তুলিয়া দিয়াছে এবং নৈতিক মূল্যবোধকে টুকরা টুকরা করিয়া নিক্ষেপ করিয়াছে। এই দেশটির নাম পাকিস্তান। এই দেশের সরকার আহরারদের এইরূপ একটি বাজারী ভাষা গ্রহণ করিয়াছে, যাহা কখনো লাহোরের মুচি দরজায় বা অমৃতসরের বাজার সমুহে শুনা যাইত, বা ঐ দিনগুলিতে শুনা যাইত যখন তাহারা কল্পিত “কাদিয়ান বিজয়ের” উদ্দেশ্যে হামলা করিত। এখন ঐ ভাষা পাকিস্তান সরকারের ভাষায় পরিণত হইয়াছে এবং এই সরকারের স্বভাব, তাহাদের আদর্শ এবং তাহাদের শাসন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আহরারদের রঙ্গে রঙ্গীন হইয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ সমগ্র বিশ্বে এই সরকারের এই রূপই প্রতিফলিত হইতেছে।
আজ আহমদীয়াতের উপর এবং হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের উপর মনগড়া অপবাদ আরোপ করা সরকারের একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়াইয়াছে। বস্তুতঃ এই ব্যাপারে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হইয়াছে। ইহার শিরোনাম হইল “কাদিয়ানীয়ত ইসলামের জন্য সঙ্গীন বিপদ।” ইহা পাকিস্তান সরকারের শ্বেত-পত্র। পাকিস্তান সরকার এই শ্বেতপত্রটি মহাসমারোহে ছাপাইয়া সমগ্র বিশ্বে বিপুলভাবে বিতরণ করিয়াছে। ইনশাআল্লাহ, আমি এই শ্বেত-পত্রে উত্থাপিত প্রত্যেকটি আপত্তির উত্তর প্রদান করিব। প্রথমে আমি এই বিরুদ্ধাচরণের পটভূমি বর্ণনা করিতে চাই।
এই বিরুদ্ধাচরণের পটভূমি সম্বন্ধে ইহাই বলিতে হয় যে, ইহা একটি রীতিমত গভীর ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। এই ব্যাপারে যে দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালানো হইতেছে, এই পটভূমি উহা প্রকাশ করিতেছে। বন্ধুগণ সাধারণতঃ ধারাবাহিকভাবে অবগত নহেন যে, কি হইতেছিল এবং এখন কি হইতেছে এবং ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর (তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমলের ঘটনাবলীর) সহিত বর্তমান ঘটনাবলীয় চেইনের কোন্ গ্রন্থিটি মিলিয়া যায়। বস্তুতঃ বর্তমান বিরুদ্ধাচরণের কিছু পটভূমিতো এইভাবে সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয় যে, জামা’তের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলিতেছে, উহা সুসংঘবদ্ধরূপে সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে এবং এখন বর্তমান আকারে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। অতঃপর এই পটভূমির আরো একটি দিক রহিয়াছে। ইহার সহিত বিদেশী শক্তির সম্পর্ক রহিয়াছে বা অন্য ধর্মের সম্পর্ক রহিয়াছে। বড় বড় ধনতান্ত্রিক শক্তি রহিয়াছে, যাহারা এই সকল প্রচেষ্টার পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছে। তাহাদের খুবই মন্দ অভিপ্রায় রহিয়াছে। ইহা রীতিমত একটি পরিকল্পনার আকারে আজ হইতে বহু বৎসর পূর্বে নীলনক্শার (Blue Print) রূপ ধারণ করিয়াছিল। বস্তুতঃ একটি পরিকল্পনার অধীনে কোটি কোটি টাকা আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে ব্যয় করা হইতেছে। নুন্যপক্ষে ২০ বৎসর হইতেতো আমিই অবগত আছি যে, কি হইতেছে। কেবলমাত্র ইহাই নহে বরং আমাদের বিরুদ্ধবাদী দলগুলিকে রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়া হইয়াছে এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অবস্থায় হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারেও ইহাদিগকে মাধ্যম বানানো হইয়াছে। ইহার অনেক বিস্তারিত দিক রহিয়াছে। যদি সুযোগ হয় বা প্রয়োজন বোধ করি, তাহা হইলে পরবর্তীতে এইগুলি সমন্ধে আলোচনা করিব।
অতএব যেমন কিনা আমি বলিয়াছি, আমাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্তমান অভিযান ও আন্দোলনের সহিত ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। ১৯৭৪ সনের ঘটনাবলীর বুনিয়াদ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ১৯৭৩ সনের আইনের মধ্যে পত্তন করা হইয়াছিল। বস্তুতঃ আইনে কোন কোন ধারা ও দফা সংযোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যাহাতে ইহার ফলশ্রুতিতে আহমদীয়া জামা’তকে অন্যান্য পাকিস্তানী নাগরিক হইতে একটি পৃথক এবং তুলনামূলকভাবে একটি নগণ্য মর্যাদা দেওয়া যায়। আমি ১৯৭৩ সনের আইন প্রবর্তন করার সময় এই বিপদকে অনুধাবন করিয়া হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস রাঃ-এর খেদমতে নিবেদন করিয়াছিলাম। অবশ্য ইহার পরে যেভাবেই সম্ভব ছিল আহমদীয়া জামাত বিভিন্ন পর্যায়ে এই বিরুদ্ধাচরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাবকে দূর করার চেষ্টা করিয়া আসিতেছিল। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকালীন সময়ে এই ধারণা বড়ই দৃঢ়রূপে সৃষ্টি হইল যে, ইহা কেবলমাত্র এখানকার সরকার করাইতেছে না, বরং ইহা একটি সুদীর্ঘ পরিকল্পনার চেইনের গ্রন্থি এবং এই ব্যাপারটি সম্মুখে অগ্রসর হইবে। যাহা হউক, ১৯৭৪ সনের আশংকা সম্পর্ণরূপে দেদীপ্যমান হইয়া বর্তমানে আমাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
১৯৭৪ সনে পাকিস্তানের অদৃষ্টে যে সরকার জুটিয়াছিল, উহার মধ্যে ও বর্তমান সরকারের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রহিয়াছে। ঐ সরকারের লজ্জা- শরমের বালাই ছিল। নিজেদের দেশের লোকদের নিকটও তাহাদের লজ্জা-শরম ছিল এবং বহির্বিশ্বের সরকারগুলির নিকটও তাহাদের লজ্জা বোধ ছিল, যদিও আহমদীয়াতের শত্রুতার ক্ষেত্রে তাহারা কম যায় নাই। অর্থাৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এবং জামা’তের ভিতের উপর সঙ্গীন আক্রমণ করার ক্ষেত্রে উভয় সরকারের মধ্যে এই দুশমনী এক ও অভিন্ন। তবুও ভুট্টো সাহেবের সময়কার সরকার এবং বর্তমান সরকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রহিয়াছে। ভুট্টো সাহেব একজন জননেতা ছিলেন এবং তিনি জনগণকে ভালবাসিতেন বলিয়াও দাবী করিতেন। তিনি চাহিতেন যে, তিনি নিজ দেশের জনগণের প্রিয় নেতা হইয়া থাকিবেন এবং তাহারা যেন এই ধারণা করে যে, অপরিহার্য প্রয়োজন ব্যতীত ধান্ধাবাজী করিয়া এবং একনায়কত্বের পন্থা অবলম্বন করিয়া তিনি দেশ শাসন করার অভিলাষী। বস্তুতঃ তিনি আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে ইহাকে একটি আদালতের রূপ দিলেন এবং জাতীয় সংসদে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। ইহাতে আহমদীয়া জামা’তকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে বহির্জগত সমালোচনা করার সুযোগ না পায়। প্রকৃতপক্ষে এইভাবে তিনি বহির্জগতে স্বীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিতে চাহিতেছিলেন। বহির্জগতেও তাঁহার আকাঙ্খা খুব প্রবল ছিল। তিনি কেবলমাত্র পাকিস্তানের নেতৃত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং তিনি স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তি আশ-পাশের এলাকাতেও বিস্তৃত করিতে চাহিতেছিলেন। যেভাবে পণ্ডিত নেহেরু প্রাচ্যের নেতা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন, অনুরূপভাবে ভুট্টো সাহেব প্রাচ্যের নেতা হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করিতেন। তিনি চাহিতেন যে, কেবলমাত্র পাকিস্তানের নেতা হিসাবেই নয়, বরং তিনি প্রাচ্যের এক মহান নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করিবেন এবং রাজনীতির ময়দানে জগদ্বাসীর নিকট স্বীয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করিবেন। অতএব এই কারণে এবং তদুপরি যেহেতু তাঁহার চোখে বহির্জগতের নিকট লাজ-লজ্জার বালাই ছিল, কাজেই তিনি চাহিতেন যে, দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাহিরে আহমদীয়া জামা’তের বিষয়টি এইরূপে উপস্থাপন করিতে হইবে, যাহাতে সকলে মনে করে যে তিনি সম্পূর্ণরূপে অসহায় হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং বিষয়টি তাহার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এতদসত্বেও তিনি জনগণের চাপ সরাসরি গ্রহণ করেন নাই, বরং আহমদীয়া জামা’তের প্রধান এবং তাঁহার সহিত কয়েকজন ব্যক্তিকে ডাকিয়া একটি সুযোগ দিলেন, যাহাতে তাহারা নিজেদের বক্তব্য পেশ করিতে পারেন। বস্তুতঃ দীর্য দিন ধরিয়া জাতীয় সংসদ এই বিষয়ে সময় ব্যয় করিল। অবশেষে জাতীয় সংসদের বাহানা ও অজুহাত ভুট্টো সাহেবের হস্তগত হইল এবং তিনি এই কথা বলিয়া দিলেন যে, আমি এখন কি করিতে পারি?
কিন্তু বর্তমান সরকারের এই লাজ-শরমের বালাই নাই। কারণ না তাহারা জনগণের সরকার, না তাহারা বহির্জগতে জনমতের পরোয়া করে। একজন স্বৈরাচারী একনায়ক, একনায়কই হইয়া থাকে। অতএব বাহ্যতঃ সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, একনায়কের ইহা অনিবার্য বৈশিষ্ট যে, যাহা কিছুই হউক না কেন, এবং জগদ্বাসী যাহা কিছুই বলুক না কেন, সে উহার পরোয়া করিবে না। ইহা একনায়কের মজ্জাগত বৈশিষ্ট যে, সে চেষ্টা করিয়া দেখে মোফতে জগদ্বাসীর হৃদয় জয় করা যায় কিনা। যদি জয় করা যায় ভাল কথা। কিন্তু যদি না যায়, তবুও একনায়কতো পিছে হটে না। সুতরাং একনায়কের মধ্যে যে বেপরোয়া ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, উহা আমাদের বিরুদ্ধে তাহার বর্তমান অভিযানেও সম্পূর্ণরূপে উলঙ্গ হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে।
১৯৭৪ সনে সরকার নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আহমদীয়া জামা’তকে সুযোগতো দিয়াছিল এবং চৌদ্দ দিন ধরিয়া জাতীয় সংসদে প্রশ্নউত্তর চলিয়াছিল। জামা’ত নিজেদের বক্তব্য লিখিতভাবেও পেশ করিয়াছিল। কিন্তু ঐ সরকার বড়ই হুশিয়ার এবং চতুর সরকার ছিল। তাহারা জাতীয় সংসদ চলাকালীন সময়েই ইহা ধারণা করিয়া লইয়াছিল যে, যদি এই সকল কথা জনসাধারণ্যে প্রকাশ হইয়া পড়ে এবং প্রশ্ন-উত্তর সম্বলিত সংসদের কার্য বিবরণী এবং ইহার রোয়েদাদ জগতের সম্মুখে পেশ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। বরং বিপরীত ফল ফলিতে পারে এবং খুবই সম্ভব যে, জগদ্বাসী সপ্রসংশভাবে এই কথা স্বীকার করার পরিবর্তে যে, জামা’তকে সব ধরনের অধিকার দান করার পর একটি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহারা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা ভাবিবে এবং বলিবে যে, জামা’ততো এই কর্যক্রমের দরুন খুবই অধিক মজলুম প্রমাণিত হইয়াছে। কেননা আহমদীয়া জামাত তাহাদের বক্তব্যের সমর্থনে এত মজবুত ও শক্তিশালী দলিল-প্রমাণাদি উপস্থাপন করিয়াছে যে, ইহার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলাই যায় না যে তাহারা মুসলমান নয়। বস্তুতঃ তখনকার সরকার এই বিপদ এইভাবে প্রতিরোধ করিয়াছিল যে, আইনের বলে এবং আদেশক্রমে জামা’তকে নিষেধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, জাতীয় সংসদে যাহা কিছু কার্যক্রম গৃহীত হইতেছে ইহার কোন নোট বা রেকর্ড তাহারা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারে না এবং এই সিদ্ধ গ্রহণ করা হইয়াছিল যে, সরকার এই কার্যক্রমকে জগদ্বাসীর নিকট প্রকাশিত হইতে দিবে না।
এই কার্যক্রমের ফলাফল কি হইয়াছিল? তাহা এই ঘটনা হইতে জানা যায় যে, একদা জাতীয় সংসদের একজন সদস্যকে কোন এক উপলক্ষে এই প্রশ্ন করা হইয়াছিল যে, আপনারা এই কার্যক্রমকে কেন প্রকাশ করিতেছেন না? জাতীয় সংসদ আপনাদের বর্ণনানুযায়ী সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়াছে যে, আহমদীয়া জামাত ভ্রান্ত এবং ধর্ম-বিশ্বাসের দিক হইতে তাহাদের সহিত ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। তাহা হইলে সংসদের কার্যক্রম ছাপাইয়া তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস জগদ্বাসীর নিকট প্রকাশ করিয়া দিন। তিনি হাসিয়া উত্তর দিলেন, “তুমি ছাপানোর কথা বলিতেছ? শোকর কর যে আমরা ছাপাই নাই। আমরা ইহা ছাপাইয়া দিলে পাকিস্তানের অর্ধেক লোক আহমদী হইয়া যাইবে।” আমি মনে করি যে, এইরূপ বলা তাহার পক্ষে বিনয় ছিল। যদি পাকিস্তানের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিকট আহমদীয়া জামা’তের বক্তব্য প্রকৃতপক্ষেই পৌঁছিয়া যায়, তাহা হইলে কোন কারণই নাই যে, কিছু হতভাগ্য ব্যক্তি ব্যতীত (যাহারা সদা সর্বদাই বঞ্চিত থাকিয়া যায়) পাকিস্তানের সকল মানুষ আহমদী হইয়া যাইবে না। উক্ত হতভাগ্যদের অদৃষ্টে হেদায়েত থাকে না। কেননা وهي يضلل فلا هادي له যাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা হেদায়েত দিতে চাহেন না, পৃথিবীর কোন শক্তি তাহাদিগকে হেদায়েত দিতে পারে না। সুতরাং এইরূপ ব্যতিক্রমতো বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু আমি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্বন্ধে এই সুধারণা পোষণ করি যে, যদি তাহাদের নিকট, বিশেষভাবে বর্তমান যুগের বংশধরদের নিকট, যাহারা তুলনামূলকভাবে অধিক যুক্তিবাদী এবং অনুকরণে ততখানি বিশ্বাসী নয় যতখানি প্রাচীন লোকেরা বিশ্বাসী ছিলেন, আহমদীয়া জামা’তের বক্তব্য সঠিকভাবে পৌঁছিয়া যায় তাহা হইলে অনিবার্যরূপে তাহাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল খোদাতায়ালার অনুগ্রহে আহমদী মুসলিম হইয়া যাইবে। বস্তুতঃ বর্তমান সরকার তাহাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা এইভাবে করিয়াছে যে, তাহারা আহমদীয়া জামা’তের উপর একতরফা হামলাতো করিয়াছে, কিন্তু উত্তরের অনুমতিই দেয় নাই এবং আত্ম-পক্ষ সমর্থনের সুযোগই সৃষ্টি হইতে দেয় নাই। বস্তুতঃ জামা’তের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার পূর্বেই সরকার এইরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করিল যে, জামা’তের ঐ সকল লিটারেচার ও বই পুস্তক বাজেয়াপ্ত করিয়া লইল, যেগুলির মধ্যে তাহাদের ভবিষ্যতের আক্রমণের উত্তর মওজুদ রহিয়াছে। সরকারের পলিসিতে এই যে স্ব-বিরোধ দেখিতে পাওয়া যায় কিন্তু ইহার মধ্যে বাহ্যতঃ একটি নির্বুদ্ধিতার ব্যাপারও দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার মধ্যে নির্বুদ্ধিতার চাইতে অধিক রহিয়াছে ধূর্ততা ও চাতুরী। একদিকে ইহা বলা হইতেছে যে, হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের লিটারেচার এইজন্য বাজেয়াপ্ত করা হইতেছে যে, ইহাতে পাকিস্তানের লোকদের মনঃকষ্ট হয় এবং অন্যদিকে এইগুলির মধ্য হইতে কেবলমাত্র ঐ সকল কথাই ছাপানো হইতেছে, যেইগুলির দ্বারা তাহাদের মনঃকষ্ট হইয়া থাকে। ইহা কিরূপ নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ব্যাপার! তোমরা বলিতেছ এই কথা যে, হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকাদি তোমরা এইজন্য বাজেয়াপ্ত করিতেছ যে উহাদের দ্বারা মুসলমান জনসাধারণের বিশেষভাবে পাকিস্তানের জনগণের মনঃকষ্ট হয়। কিন্তু এই মনঃকষ্টের প্রতিকার এইভাবে করা হইয়াছে যে, ঐ অংশ যাহার দ্বারা মনঃকষ্ট হয় না, উহা প্রকাশ করাতো আইনগতভাবে বন্ধ কর দিয়াছ এবং যাহার দ্বারা তোমাদের ধারণানুযায়ী মনঃকষ্ট হয়, উহাকে সরকারী খরচে বিপুল পরিমাণে ছাপাইয়া দিতেছ। অতএব বাহ্যিকভাবে তো ইহা একটি স্ব-বিরোধ। কিন্তু এই স্ববিরোধ একটি চাতুরীর জন্য করা হইয়াছে। তাহারা এইরূপ জালেমানা এবং নাপাক হামলা অবশ্য অবশ্যই করিত। কেননা হযরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকাদিতেই আপত্তিসমূহের উত্তর মওজুদ রহিয়াছে এবং প্রত্যেক সংব্যক্তি, যিনি এইগুলি অধ্যয়ন করেন এবং ইহাদের পূর্বাপর সম্পর্ক দেখেন তাঁহারা দেখিবেন যে আপত্তিগুলি নিজে নিজেই দূর হইয়া যায়। বস্তুতঃ জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের সময়েও ইহাই হইতেছিল। হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস রাঃ আমাকেও তাঁহার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ দান করিয়াছিলেন । সংসদের কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে আমি এবং আমার অন্যান্য সঙ্গীরা এই ব্যাপারটি খুবই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করিয়াছি যে, যখনই হহরত মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের পুস্তকের উপর আক্রমণ করা হইয়াছে তখনই হযরত খলিফাতুল মসীহ সালেস রাঃ এই সূত্রের কিছু পুর্বের অংশ হইতে এবং কিছু পরের অংশ হইতে পড়িয়া শুনাইয়া দিতেন এবং ইহার পর কোন উত্তরের প্রয়োজনই থাকিত না। শ্রবণকারীদের চেহারায় প্রশান্তি আসিয়া যাইত। কেননা তাহারা বুঝিতে পারিত যে এই আক্রমণ কল্পিত এবং ইহা কাট-ছাট উদ্ধৃতির ফলশ্রুতি এবং সত্যের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। কোন কোন জায়গায় যখন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়িত, তখন তিনি ব্যাখ্যাও দান করিতেন। কিন্তু হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালামের রচনাগুলির মধ্যে যথেষ্ট উত্তর রহিয়াছে। যদি পূর্বাপর সম্পর্ক না রাখিয়া কেবলমাত্র একটি অংশকে পৃথক করিয়া ভ্রান্তভাবে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উত্থাপন করা হয়, তাহা হইলে ইহাতে মনঃকষ্ট হইতে পারে। কিন্তু তাঁহার রচনার উদ্দেশ্য ইহা নহে। হযরত আকদাস মসীহ মওউদ আলাইহেস সালাতু ওয়াস সালাম ঐ কধা বলিতে চাহেন নাই, যাহা তাঁহার প্রতি আরোপ করা হইতেছে। কিন্তু ইহাকে মনঃকষ্ট বানানো হইয়াছে, অথবা ইহাকে নিজেদের পক্ষ হইতে বিকৃত করিয়া ছাপানো হইয়াছে। সুতরাং ইহাই ছিল ঐ সরকারের ক্রিয়া-কর্মের কৌশল। বস্তুতঃ ইহার ফলশ্রুতিতে এই ঘটনার পূর্বেই বই-পুস্তকাদি বাজেয়াপ্ত করিতে আরম্ভ করা হইল। ইহাতেও তাহারা ক্ষান্ত হইল না। প্রেসও বাজেয়াপ্ত করা হইল এবং সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকাও বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।
ইহা হইল ভীরুতা। ইহা সদা-সর্বদা দুর্বলতার লক্ষণ হইয়া থাকে। এইভাবে তাহারা নিজেদের পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়াছে। পৃথিবীর কোন শক্তি, যাহারা যুক্তি-প্রমাণে শক্তিশালী তাহারা অস্ত্র উঠাইয়া নেয়না এবং অন্যের বক্তব্য উপস্থাপনের পথে আইনগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া দেয় না। ইহা বিবেক- বুদ্ধির পরিপন্থী এবং তাহাদের নিজেদের স্বার্থেরও পরিপন্থী। এই জন্য এইক্ষেত্রে সকল আইনগত প্রচেষ্টা কাজে লাগানো হইতেছে যে, যে-কোন প্রকারে আহমদীয়া জামা’তের উপর আক্রমণতো করিয়া দেওয়া হউক, কিন্তু আহমদীয়া জামা’তকে উত্তরের সুযোগ দেওয়া হইবে না। ইহা জঘন্য ভীরুতা ও কাপুরুষতার লক্ষণ এবং পরাজয়ের শেষ স্বীকৃতি যে, দলিল-প্রমাণের ময়দানে তাহারা শুন্য ও রিক্ত। বস্তুতঃ একদিকে আহমদীয়া জামা’তের সদস্য সংখ্যা এত কম বলিয়া ঘোষণা করা হইতেছে যে তাহাদের সংখ্যা সত্তর-আশি হাজারের অধিক নয় এবং অন্য দিকে এই প্রোপাগাণ্ডা করা হইতেছে যে, আহমদীয়াত মুসলিম জাহানের জন্য বিপদ এবং এইরূপ একটি বিপদ ইতিপূর্বে মুসলিম জাহানে কখনো দেখা দেয় নাই। তাহারা প্রোপাগাণ্ডা করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, বরং তাহারা আহমদীয়াতের লিটারেচারও বাজেয়াপ্ত করিয়াছে। এই সকল কাজ সম্বন্ধে বড়ই গর্বের সহিত বলা হইতেছে যে, ‘দেখিয়াছ, এই বিপদ আমরা দূর করিয়া দিয়াছি’।
বস্তুতঃ পূর্ববর্তী সরকারের কাজের তুলনা করিয়া বর্তমান সরকার তাহাদের শ্বেতপত্রে লিখিয়াছে যে, যথার্থভাবেই পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদের ইহা একটি বড় কীর্ত্তি (অর্থাৎ আহমদীদিগকে সংখ্যালঘু অমুসলমান ঘোষণা করা - অনুবাদক)। কিন্তু এতদসত্ত্বেও উক্ত জাতীয় সংসদকে বর্তমান সরকারকে রহিত করিতে হইয়াছিল এবং উহার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হইয়াছিল যে উহার সকল সদস্য (ইল্লা মাশাআল্লাহ) চরিত্রহীণ ও দুস্কৃতিকারী। ইহার পরেও বৃর্তমান সরকার উক্ত জাতীয় সংসদের কীর্ত্তিকে স্বীকার করিয়াছে। যেহেতু ইহাদের চিন্তা ভাবনা তাহাদের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ এবং উভয়ের ধরণ করণ এক ও অভিন্ন, সেজন্য তাহাদের কীর্ত্তিকেতো স্বীকার করিতে হইবে। কেবল স্বীকার করিয়া নেওয়ার ব্যাপারই নয় বরং উক্ত সংসদের ইহা একটি বড়ই মহান কীর্তিও বটে, যাহার দ্বারা দৃশ্যতঃ একশত বৎসরের সমস্যা সমাধান করিয়া দেওয়া হইয়াছে (ভুট্টো সাহেব মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আহমদীদিগকে অমুসলমান ঘোষণা করিয়া তিনি একশত বৎসরের একটি পুরাতন সমস্যা সমাধান করিয়া দিয়াছেন - অনুবাদক)। কিন্তু তাহারা এই একশত বৎসরের সমস্যা সম্পূর্ণরূপে সমাধান করিতে পারে নাই। কেননা, এই ব্যাপারে যে সকল আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল, তাহা ইহাদের (অর্থাৎ বর্তমান জিয়াউল হক সরকারের) অদৃষ্টে লিপিবদ্ধ ছিল। বস্তুতঃ বর্তমান সরকার ঐ সকল আইন প্রণয়ন করিয়া আহমদীয়া জামা’তকে চিরকালের জন্য অচল করিয়া দিয়াছে এবং এখন আর মুসলিম জাহানের জন্য কোন বিপদ রহিল না।
প্রশ্ন এই যে, এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হইয়াছে এবং মুসলমানদিগকে কিভাবে এই বিপদ হইতে রক্ষা করা হইয়াছে? এই সম্বন্ধে সরকারী শ্বেতপত্রের পরিশেষে লেখা হইয়াছে যে, ‘আমরা সমস্যা এইভাবে সমাধান করিয়াছি যে একটি আদেশের বলে আহমদীয়া জামাতের তরফ হইতে আযান দেওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং তাহাদের নিজদিগকে মুসলমান বলা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এখন তাহারা কলেমা পড়িতে ও লিখিতে পারে না, তাহাদের মসজিদকে মসজিদ বলিতে পারে না, তাহারা মুসলমানের ধরণ-করণ অনুসরণ করিতে পারে না এবং তাহারা কুরআন করীমের আদেশ নির্দেশের উপর আমল করিতে পারে না। দেখ, এখন আমরা কত সন্তুষ্ট। আমরা কত বড় সাংঘাতিক সমস্যা সমাধান করিয়া দিয়াছি।’ অবশেষে তাহারা সমস্যা সমাধানের এই পন্থা উদ্ভাবন করিয়াছে। কিন্তু বোকামীরও একটা সীমা আছে। অর্থাৎ চালাকীর মধ্যেও কোন কোন সময় বোকামী নিহিত থাকে এবং ইহার কারণ এই যে, যে ব্যক্তির নিকট সত্য থাকে না, সে চালাকীর মাধ্যমে নিজ উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করে এবং সততা না থাকার দরুণ চালাকীর মধ্যে একটি বোকামী ঢুকিয়া পড়ে এবং তাহা নিশ্চয়ই নিজেকে প্রকাশ করে। এই জন্য এই আভ্যন্তরীণ স্ব-বিরোধ এবং এই বোকামীসমূহ - এই সব কিছুই একটি মিথ্যা চালাকীর ফল। নতুবা সৎ-বুদ্ধির দরুণ এই স্ব-বিরোধ সৃষ্টি হইতে পারে না।
সুতরাং বর্তমান সরকার এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছে এবং নিজদিগকে ভুট্টো সরকারের চাইতে অধিক চালাক মনে করিয়াছে এবং, বলিয়াছে যে তাহাদের তো ইহাই বোকামী ছিল যে, তাহারা জাতীয় সংসদে আহমদীদিগকে প্রশ্ন-উত্তরের সুযোগ দিয়াছিল। বস্তুতঃ শ্বেত-পত্রে এই কথাও লেখা হইয়াছে যে, প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবী করে তাহার সহিত আলাপ-আলোচনা করাই উচিত নয় এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে তাহাকে পরাস্ত করার চেষ্টা করাই বোকামী। এই জন্য তাহারা যে প্রতিকার উদ্ভাবন করিয়াছে, তাহা বাতীত আর কোন প্রতিকার নাই। কিন্তু এতদসত্বেও তাহারা সমগ্র বিশ্বে মিথ্যা অপবাদ রটনার জালেমানা কার্যকলাপ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। কুরআন করীম হইতে জানা যায় যে, জালিমদের প্রচেষ্টা তাহাদের কোন উপকারে আসে না। বলা হইয়াছে,
فَلَمَّآ أَضَآءَتْ مَا حَوْلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِى ظُلُمَـٰتٍۢ لَّا يُبْصِرُونَ
এইরূপ ব্যক্তি, যাহারা মুনাফিক, তাহারা দাবী করে একটা কিছু, কিন্তু আমল করে অন্য কিছু। তাহারা জ্ঞানের কথা বলে, কিন্তু জ্ঞানের সাথে সাথে নেহায়েত বোকামীপূর্ণ কাজও করিতে থাকে। তাহাদের প্রচেষ্টা কখনো তাহাদের কাজে আসে না। তাহারা আগুনতো নিশ্চয়ই লাগাইয়া দেয়, কিন্তু তাহারা আগুন হইতে যে তামাশা দেখিতে চায়, খোদাতায়ালা তাহাদিগকে ঐ তামাশা হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকেন। তিনি তাহাদের অন্তর্দৃষ্টির জ্যোতিঃ ছিনাইয়া নেন। আগুনতো তাহারা জ্বালানোর জন্য লাগাইয়া থাকে। কিন্তু ঐ আগুন তাহাদিগকে অন্তর্দৃষ্টির জ্যোতিঃ হইতেও বঞ্চিত করিয়া দেয় এবং অতঃপর তাহাদিগক এইরূপ অন্ধকারে ছাড়িয়া যায় যে, তাহারা কিছুই দেখিতে পারে না। বস্তুতঃ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধাচরণমূলক প্রচেষ্টাও কাৰ্য্যতঃ আহমদীয়া জামাতের ফায়দা ও লাভের কারণ হইয়াছে এবং আগামীতেও ইনশাআল্লাহ ফায়দার কারণ হইতে থাকিবে।
বর্তমানে আহমদীয়া জামাত এইরূপ যুগের মধ্য দিয়া অতিক্রম করিতেছে, যাহার সম্বন্ধে কুরআন করীমে আল্লাহতায়ালা বলেনঃ- عسى أن تكرهوا شيئا وهو خير لكم কোন কোন সময় এইরূপ হইয়া থাকে এবং তোমাদের সঙ্গেও এইরূপ হইবে যে, তোমরা কোন একটা বস্তুকে অপছন্দ কর, তোমাদের মনে কষ্ট হয় এবং তোমাদের ব্যথা লাগে, কিন্তু وهو خير لكم উহা তোমাদের জন্য কল্যাণের কারণ হয়। তোমরা শিশুদিগকে তিক্ত ঔষধ খাওয়াইয়া থাক, তাহাদিগকে ইঞ্জেকশান দিয়া থাক, তাহারা চিৎকার করিতে থাকে, তোমরা তাহাদের হাত ধরিয়া রাখ, এবং তাহাদের কোন কথাই শুন না। শিশুদের সহিত এই আচরণ এই জন্য করা হইয়া থাকে যে, উহার মধ্যে তাহাদের কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে। অনুরূপভাবে আল্লাহতায়ালা বলেন যে, আমরাও তোমাদের জন্য কোন কোন সময় এইরূপ তদবীর করিব, যাহাতে তোমাদের যারপরনাই কষ্ট হইবে। কিন্তু অবশেষে উহা তোমাদের জন্য কল্যাণের কারণ হইবে। বস্তুতঃ আহমদীয়া জামাত সম্বন্ধে পাকিস্তান সরকার সমগ্র বিশ্বে যে লিটারেচার ও পুস্তকাদি প্রকাশ করিয়াছে, ইহার একটি বড় উপকার এই হইয়াছে যে সারা বিশ্বে আহমদীয়া জামাত
আপনার উত্তর যোগ করুন
আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।