আপত্তির জবাব

খাতামান্নাবীঈনের তাৎপর্য

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) খাতামান্নাবীঈন (সূরা আহযাব)। আল্লাহতা’লা তাঁকে হযরত আদম (আঃ)-এর বহু পূর্বেই খাতামান্নাবীঈন রূপে মনোনীত করেন। তিনি বলেন, “আমি আল্লাহ্‌র নিকট তখনও খাতামান্নাবীঈন হিসাবে লিপিবদ্ধ ছিলাম যখন আদম মাটিতে মিশে ছিলেন (শরহে সুন্নাহ্ আহমদ, মিশকাত, কঞ্জুল উম্মাল)। হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘হুজুর (সাঃ)-এর দুই কাঁধের মধ্যে নবুওয়তের মোহর অঙ্কিত ছিল, আর এই হলো খাতামান্নাবীঈন’ (তিরমিযী)।

‘খাতাম শব্দের অর্থ মোহর বা সেই আংটী যার উপর নাম খোদাই করা থাকে মোহর রূপে ব্যবহার করার জন্য’ (লিসানুল আরব, তাজুল উরুছ, সিহা জওহারী, কামুছ, মুন্তাহিউল আরব)।

উপরে উদ্ধৃত একটি হাদীস দ্বারাও একথা প্রমাণিত যে, মহানবী (সাঃ)- এর দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চিহ্ন অঙ্কিত ছিল যাকে খতমে নবুওয়ত বা মোহরে নবুওয়ত বলা হয়। এই হাদীসটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, খাতাম শব্দের অর্থ মোহর বৈ অন্য কিছু নয়। খাতাম শব্দের এর চাইতে উজ্জ্বল ব্যাখ্যা আর কিছু হতে পারে না। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘আমি খাতামান্নবীঈন আর এতে আমার কোন অহংকার নেই (দারেমী, ইবনে আসাকির, মিশকাত, কঞ্জুল উম্মাল)। এ থেকেও বুঝা যায় খাতামান্নবীঈন এমন একটি পদবী যা নবী করীম (সাঃ)-এর গৌরব ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। তিনি সবশেষে এসেছেন, সকল নবী থেকে তিনি কনিষ্ঠ, এর মধ্যে গৌরবের কী আছে? পরিবারের মধ্যে সবচাইতে ছোট ছেলেটি কি বলতে পারবে যে, আমি সবার ছোট আর এ জন্য আমি সবচাইতে সম্মানিত। তবে এজন্য আমি অহংকার করছি না। কখনো না। শেষ হওয়ার মধ্যে কোন গৌরব নেই। তাছাড়া মহানবী (সাঃ) তো শুধু শেষ নবীই নন, তিনি প্রথম নবীও-‘হুয়াল আউয়ালু ওয়া হুয়াল আখেরু’ (ইবনে আসারিক, কঞ্জুল উম্মাল)। এমনকি কোন কোন হাদীসে তাঁকে প্রথম মানুষও বলা হয়েছে (ইবনে সাদ মুরসালান, ইবনে আবি শায়েবা মসনদান, দুররে মনসুর)। মিরাজ কালেও তাঁকে ‘আস্‌সালামু আলাইকা ইয়া আওয়ালু ইয়া আখেরু’ বলে সম্ভাষণ জানানো হয়েছিল (বায়হাকী)।

এই সব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (সাঃ)-এর নবুওয়ত হল মূল নবুওয়ত। এই নবুওয়তের পূর্ণ রূপই হল খাতামান্নবীঈন। খাতামান্নবীঈনই প্রকৃত মডেল। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ আগমনকারী নবী সবই হযরত খাতামান্নবীঈন (সাঃ)-এর বিকাশ আর এজন্যই তাঁকে বলা হয় নবীউল আম্বিয়া বা নবীগণেরও নবী (খতমে নবুওয়ত, ৪৬৮ পৃঃ)। এই মূল নবুওয়তের খণ্ড খণ্ড বিকাশ এক লাখ বা দুই লাখ চব্বিশ হাজার বার পৃথিবীবাসী দর্শন করেছে। মহানবী (সাঃ)-এর মোহরের ছাপ নিয়েই আদম (আঃ) থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগে অসংখ্য সত্য নবীর আবির্ভাব ঘটেছে। যাদের মধ্যে মোহাম্মদী নবুওয়তের ছাপ নেই তারা বাতিল। তারা কাজ্জাবরূপে পরিত্যক্ত। নবীদের সত্যতার মাপকাঠি এই মোহর। বাজারে যেমন ভেজালমুক্ত কোন আসল জিনিস খরিদ করতে হলে তার ট্রেড মার্ক দেখে খরিদ করতে হয় তেমনি সত্য নবীকে গ্রহণ করতে হলেও খাতামান্নবীঈন মার্কাটি দেখে নিতে হয়। যে দাবীকারকের মধ্যে খাতামান্নবীঈনের চিহ্ন আছে তিনিই সত্য নবী। আর যার মধ্যে খাতামান্নবীঈনের চিহ্ন মাত্র নেই সেই নবী নকল বা কাজ্জাব। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত যত নবীর আবির্ভাব হয়েছে তারা সবাই ছিলেন খাতামান্নবীঈনের এক একটি ‘কলা’ বা খণ্ড বিশেষ। স্বয়ং মহানবীর (সাঃ) আবির্ভাবের ফলে সকল কলা-ই পূর্ণতা প্রাপ্ত হল। ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দ্বারা একথাই বর্ণিত হয়েছে (সূরা মায়েদা)। অতএব এখন আর কোন নবী পূর্ববর্তী নবীদের ন্যায় আগমন করবেন না। তাই বলা হয়েছে-‘লা নবীয়া বাদী’ অর্থাৎ নবী করীম (সাঃ)-এর পর আর কোন নবী নেই। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে ঈসা (আঃ) পর্যন্ত যত ধরনের নবীর আবির্ভাব হয়েছে তদনুরূপ নবী আর আবির্ভূত হবেন না। ঐসব নবীদের মধ্যে হযরত ঈসা (আঃ) হলেন শেষ নবী। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) নবুওয়তের সর্বশেষ চূড়ান্ত বিকাশ। তাঁর নবুওয়তই হল মূল নবুওয়ত। তাঁর পূর্বের যত নবী তাঁরা সবাই তাঁর আংশিক ছবি। তারপর আর কোন আংশিক বিকাশের সার্থকতা নেই, আর এজন্যই ‘লা নবীয়া বাদী’।

এখন প্রশ্ন হল, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর পর উম্মতে মোহাম্মদীয়ার সংশোধনের এবং নেতৃত্ব প্রদানের জন্য কি কেউ পৃথিবীতে আগমন করবে না? ইসলামের সার্বিক দায়-দায়িত্ব কি মৌলবী-মৌলানা এবং পীর মশায়েখরাই পালন করবে এবং উম্মতে ওয়াহেদাকে নেতৃত্ব দিবে? যারা নিজেরাই বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন তারাই কি দিবে পথের দিশা? যারা একে অপরকে ফতোয়ার দ্বারা কাফের বানাতে ব্যস্ত তারাই কি সমগ্র মানব জাতিকে মসুলমান বানাবে? না-না-না।

তাই হাদীসে দেখা যায় এই উম্মতের মধ্যে আবির্ভূত হবেন ইমাম মাহদী (আঃ)। কোন কোন হাদীসে ইমাম মাহদী (আঃ)-কে ‘ঈসা ইবনে মারিয়ামা ইমামান মাহদীয়ান’ বা ঈসা ইবনে মরিয়ম বলা হয়েছে। (মসনদে আহমদ হাম্বল)। ঈসা ইবনে মরিয়ম একটি ছিফতি নাম। এই নাম কোন কালে কোন মানুষ দ্বারা রাখা হয়নি, এটি আল্লাহ্ প্রদত্ত নাম। তিনি মরিয়মের গর্ভজাত পুত্রকে এই খেতাবে ভূষিত করেছিলেন (আল ইমরান)। অনুরূপ হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-কেও আল্লাহ্‌তা’লা ‘মসীহা ঈসাবনা মারিয়মা’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। এর কারণস্বরূপ কেউ কেউ বলেছেন, ‘আল্ মাহদী আশবাহুন্নাছা বি ইসাবনে মারিয়ামা খালকান ওয়া খুলকান’ (আকমালুদ্দিন, ১৬৭ পৃঃ) অর্থাৎ ইমাম মাহদী (আঃ) আকৃতি ও প্রকৃতিতে ঈসা ইবনে মরিয়মের অনুরূপ হবেন। যদিও তিনি ঈসা ইবনে মরিয়মের অনুরূপ হবেন কিন্তু তিনি হবেন খাতামান্নবীঈন মোহাম্মদ মোস্তাফা আহমদ মুজতবা (সাঃ)-এর আত্মিক বিকাশ। কোরআন শরীফের সূরা জুমুআর “ওয়া আখারিনা মিনহুম লাম্মা ইয়ালহাকু বিহিম” এর মধ্যে একথা বর্ণিত হয়েছে। আখারিনদের মধ্যে মহানবী (সাঃ)-এর যে বিকাশ সেই বিকাশই হল ইমাম মাহদী (আঃ)। মহানবীর (সাঃ) পূর্ববর্তী নবীরা যেমন খাতামান্নবীঈনের আংশিক বিকাশ ছিলেন তেমনি ইমাম মাহদী (আঃ) শুধু ঈসা নবীর মসীলই হবেন না বরং তিনি হবেন সকল নবীর প্রতিবিম্ব বা বিকাশ। তাই হাদীসে বলা হয়েছে, “যারা আদম, শীস, নুহ, শাম, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, মূসা, ইউশা, ঈসা, শামউন, এবং মোহাম্মদ (সাঃ)-কে দেখতে চায় তারা যেন মাহদীকে দেখে নেয়” (বিহারুলআনওয়ার, জিলদ ১৩, পৃঃ ২০২)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “মাহদীর আসহাব রসূল করীম (সাঃ)-এর সাহাবীদের অনুরূপ হবেন। যদিও তারা অনারব হবেন এবং তাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট হাফেযে কোরআন থাকবেন। আর এই অনারব সাহাবীরা আরবীও বলবেন” (নজমুস সাকেব)।

রসূল করীম (সাঃ) বলে গেছেন, “আমার উম্মতের সর্বশেষ দল হল সর্বোত্তম। কেননা, প্রথম দলে রসূলুল্লাহ্ স্বয়ং রয়েছেন এবং সর্বশেষ দলে থাকবেন ঈসা ইবনে মরিয়ম (হুলিয়া আবু নায়ীম, কঞ্জুল উম্মাল)। এই হাদীসে আখারিনদেরকে উৎকৃষ্ট জামাত বলা হয়েছে। এবং উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা ইবনে মরিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হয়েছে। শেষ যুগে আগমনকারী এই ঈসাকে নবী করীম (সাঃ) একটি হাদীসের মধ্যেই চার বার ‘নবীউল্লাহ্’ বা আল্লাহ্ নবী বলে বর্ণনা করেছেন (মুসলিম)। শেষ যুগে আগমনকারী এই নবীর নবুওয়তকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। শেষ যুগে ঈসা (আঃ)-এর আগমনকে যারা অস্বীকার করবে তারা কাফের (রুহুল মায়ানী)। মুফতি মোহাম্মদ শফী বলেছেন, ‘আখেরী জামানায় আগমনকারী এই নবীর আগমনে খাতামান্নবীঈনের বিরোধ হয় না’ (খতমে নবুওয়ত, ১০৬ পৃঃ)। অন্যত্র বলেছেন, ‘অবশ্যই হযরত (সাঃ)-এর পরে তাঁর উম্মতের সংস্কার ও পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে যিনি আবির্ভূত হবেন, তিনি স্বীয় নবুওয়ত পদে বহাল থেকে আঁ হযরত (সাঃ)-এর প্রবর্তিত আদর্শ ও শিক্ষা দীক্ষার অনুসারী হয়েই এ উম্মতের পরিশুদ্ধি ও সংস্কারের দায়িত্ব পালন করবেন’ (মা’রেফুল কোরআন, ৭ম খণ্ড, ১৭৬ পৃঃ)। তিনি আরো বলেছেন, “এ ব্যাপারে তোমাদের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই যে, আল্লাহ্ কাকে নবুওয়ত দিচ্ছেন এবং কাকে দিচ্ছেন না। নবুওয়তের বন্টন তোমাদের হাতে নয় যে, কাউকে নবী করার পূর্বে তোমাদের মত নিতে হবে। এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ হাতে। তিনি মহান। উপযোগিতা অনুযায়ী একাজ সমাধা করেন (ঐ ৮০০ পৃঃ)। তিনি এ-ও বলেছেন, হযরত ঈসা (আঃ) অবতীর্ণ হওয়ার পরও সমস্ত লোক আঁ হযরত (সাঃ)-এর উম্মত হবে (খতমে নবুওয়ত, ৩৭২ পৃঃ)। তিনি মৌলানা জামী (রাহঃ)-এর কাব্য গাঁথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘ঈসা অবশ্যই নাজিল হবেন কিন্তু তিনি মহানবী (সাঃ)-এর দীন ও শরীয়তের অনুসারী হবেন, মূলের অধীনে শাখা হবেন মাত্র। শরীয়ত ও দীন হবে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর (ঐ ৪৩৫ পৃঃ)।

হ্যাঁ, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর শরীয়তই শেষ শরীয়ত এরপর আর কোন শরীয়তের আগমন হতে পারে না। রসূল করীম (সাঃ)-এর পরে আবির্ভূত নবী যিনি শেষ যুগে মসীহ্ রূপে আবির্ভূত হবেন তাঁর কোন নূতন শরীয়ত থাকবে না। তিনি হবেন শরীয়তে মোহাম্মদীর অনুসারী। এক কথায় মোহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত। অর্থাৎ উম্মতী নবী। তাইতো হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, হুযূর (সাঃ) বলেছেন, ‘এই উম্মতের নবীদের পরে উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলেন আবূ বকর ও ওমর’ (ইবনে আসাকির, কঞ্জুল উম্মাল)। এথেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, উম্মতে মোহাম্মদীতে আগমনকারী নবী ছাড়া অন্য সবার মধ্যে হযরত আবূ বকর (রাঃ) শ্রেষ্ঠ। এর পরবর্তী স্থান হযরত ওমর (রাঃ)-এর। এখন প্রশ্ন হল। এই উম্মতে কি কোন নবীর আবির্ভাব হবে? হ্যাঁ, আমরা জানতে পেরেছি, আখেরী জমানায় ঈসা ইবনে মরিয়ম তুল্য ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আবির্ভাব হবে। ঐ প্রতিশ্রুত মসীহ মোহাম্মদ (সাঃ)-এর শরীয়তের অধীনে একজন নবী হবেন।

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ্‌তা’লার নিকট আরজ করলেন যে, তাঁকে যেন উম্মতে মোহাম্মদীয়ার নবী বানিয়ে দেওয়া হয়। তখন আল্লাহ্‌তা’লা এর উত্তরে বললেন, “ঐ উম্মতের নবী তাদের নিজেদের মধ্যে থেকেই হবে” (হুলিয়া, আবু নয়ীম, খাছায়েছে কুবরা, নসরুত্তিব, খতমে নবুওয়ত, ৩৪৫ পৃঃ)। এ থেকে জানা যায় যে, মহানবী (সাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে নবীও জন্ম নিবে। এ ব্যাপারে আরও কয়েকটি হাদীস ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে বলা হয়েছে যে, এই উম্মতের নবী ছাড়া অন্য সবার মধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ) শ্রেষ্ঠ। এই উম্মতের মধ্যে অনেকেই যে নবুওয়তের যোগ্যতা সম্পন্ন তা মুফতী শফী সাহেব অকপটে স্বীকার করেছেন (দেখুন খতমে নবুওত, ২৯৯-৩০০ পৃঃ)। তিনি লিখেছেন, “এ উম্মতের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে নবুওয়তের যোগ্যতা রয়েছে।”

পবিত্র কোরআনে আছে ঈসা নবীকে ‘রাফা’ করা হয়েছে। মুফতি শফী সাহেব ‘রাফা’ এর অর্থ করেছেন, উচ্চ করা, সম্মানিত করা (মারেফুল কোরআন, ৫২৪)। তিনি অপর এক স্থানে ‘ছামা’ এর অর্থ করেছেন “প্রত্যেক সুউচ্চ বস্তুকে বলা হয় ছামা” (ঐ ৬০৪ পৃঃ)। তিনি মহাশূন্যকেও ছামা বলেছেন (ঐ)। অতএব ‘ছামা’ বা আকাশে জীবিত থাকার যেমন প্রশ্ন উঠে না তেমনি ‘রাফা’ দ্বারাও আকাশে উঠা বুঝায় না। ‘রাফা’ দ্বারা বুঝায় ঈসা (আঃ)-এর সম্মানকে উন্নীত করা হয়েছিল। তিনি স্বীকার করেছেন যে, “ঈসা ও ইদ্রিস আকাশে জীবিত---এগুলি ইসরাঈলী রেওয়ায়াত (ঐ ৭ম খন্ড, ৫১২ পৃঃ)। পবিত্র কোরআন বলে ঈসা (আঃ) মৃত।

শেষ যুগে আগমনকারী ঈসা নবী ইমাম মাহদী (আঃ) ব্যতীত অন্য কেউ নন। আর তাই মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘লাল মাহদীউ ইল্লা ঈসা’ (ইবনে মাজা)। অর্থঃ আগমনকারী ঈসা মাহদী ব্যতীত আর কেউ নয়। দুই ঈসা যে ভিন্ন ব্যক্তি তা নবী করীম (সাঃ)ও স্পষ্ট করে বলে দিয়ে গেছেন। তিনি ইসরাঈলী ঈসার যে আকৃতি বর্ণনা করেছেন তা থেকে পরবর্তীকালে আগমনকারী ঈসার আকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “আমি কাশ্‌ফে ঈসা ও মূসাকে দেখেছি, ঈসা লাল রংয়ের এবং তাঁর কেশ কোঁকড়ানো ও বক্ষঃ প্রশস্ত” (বোখারী)। অন্যত্র বলেছেন, “আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি যেন কা’বার তোয়াফ করছি, এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমার সম্মুখে এল যার বর্ণ গমের ন্যায়, কেশ সরল এবং লম্বা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? উত্তর হল ইনি মসীহ্ ইবনে মরিয়ম (বোখারী, কিতাবুল ফিতন, বাব যিক্‌রে দাজ্জাল)। এই দুই বর্ণনায় মূসার সঙ্গী ঈসার রং লাল, চুল কোঁকড়ানো। আর দাজ্জালের মোকাবেলায় আগমনকারী ঈসার রং গম বর্ণ এবং চুল সরল লম্বা। দুজনের রং যেমন ভিন্ন তেমনি চুলের অবস্থাও ভিন্ন।

দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৌলানা মোহম্মদ কাশেম নানুতবী (রাহঃ)। মৌলানা নানুতবী খাতামান্নবীঈনের পর নবীর আগমন সম্বন্ধে বলেছেন,-“যদি নবী (সাঃ)-এর যুগের পরে কোন নবী সৃষ্টি হন তাহলে খাতমিয়তে মোহাম্মদীতে কোন পার্থক্য সৃষ্টি হবে না” (তাহজিরুন্নাস ২৮ পৃঃ) তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের ধারণায় আঁ-হযরত (সাঃ)-এর ‘খাতাম’ হওয়ার এই অর্থ যে, তিনি পূর্ববর্তী নবীদের পরবর্তী যুগে এবং সকলের শেষে নবী রূপে এসেছেন। কিন্তু জ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট যে, যুগের দিক দিয়ে পূর্ব এবং পরের মধ্যে কোন সম্মান নেই। অতঃপর প্রশংসার দিক দিয়ে ৯ ‘ওয়ালাকির রসূলাল্লাহে ওয়া খাতামান্নাবীঈন’ কেমন করে সঠিক হবে?” (তাহজিরুন্নাস ৩ পৃঃ)। যেহেতু খাতামান্নবীঈন একটি গৌরবসূচক খেতাব তাই রসূল করীম (সাঃ) নিজেও বলেছেন, এই খেতাবের জন্য আমার কোন গর্ব নেই (পূর্বোক্ত)। একটি হাদীসে আছে, ‘আলা ইন্নাহু খালিফাতি ফি উম্মাতী ওয়া আলা ইন্নাহু লাইছা বাইনি ওয়া বাইনাহু নবীউন ওয়া রাসূলুন’ (তিবরানী) অর্থাৎ আগমনকারী ঈসা আমার উম্মতে আমার খলীফা হবেন। আর হে লোক সকল! ভালোভাবে শুনে এবং জেনে রাখ যে, তার এবং আমার মধ্যবর্তী কালে আর কোন নবী ও রসূল নেই। হযরত শাহ ওলীউল্লাহ্ (রহঃ) যিনি দ্বাদশ হিজরীর মুজাদ্দেদ ছিলেন, বলেছেন, “প্রতিশ্রুত ঈসার জন্য জরুরী যে, তাঁর মধ্যে সৈয়্যদুল মুরসালীন (সাঃ)-এর জ্যোতির প্রতিফলন থাকবে। তিনি মোহাম্মদ মোস্তাফা (সাঃ)-এর যিল্ল্‌ বা প্রতিবিম্ব হবেন, তাঁর বুরুজ হবেন (খায়রুল কাসীর, ৭২ পৃঃ)। তিনি বলেছেন, “সাধারণ মানুষ মনে করে, প্রতিশ্রুত ঈসা যখন পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন তখন তিনি শুধু একজন উম্মতী হবেন, নবী হবেন না। জেনে রাখ, একথা ভুল, এমন হবে না।” তিনি বলেছেন, “ঐ মসীহ মোহাম্মদ (সাঃ)-এর দ্বিতীয় রূপ হবেন” (দেখুন খায়রুল কাসীর)।

এই সব আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রসূল করীম (সাঃ)-এর পর আগমনকারী নবী ঈসা মসীহ খেতাব প্রাপ্ত ইমাম মাহদী (আঃ) একাধারে নবী এবং উম্মতী হবেন। তিনি কোন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নবুওয়ত নিয়ে আবির্ভূত হবেন না। তিনি হবেন বিশ্বনবী মহানবী (সাঃ)-এর আত্মিক বিকাশ। খাতামান্নবীঈনের মোহরের ছাপ নিয়েই তিনি আবির্ভূত হবেন। তাঁর আগমন মোহাম্মদ (সাঃ)-এর দ্বিতীয় আগমন রূপে পরিচিত হবে। তাঁর দ্বারা ইসলাম সমগ্র বিশ্বে জয়যুক্ত হবে।

(পুস্তকঃ খাতামান্নবিঈন ও আহমদীয়া মুসলিম জামাত - আলহাজ্জ আহমদ তৌফিক চৌধুরী)

আপনার উত্তর যোগ করুন

আপনার উত্তরটি একজন এডমিন রিভিউ করে অনুমোদন করবেন।